জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘Star Trek‘ এ সিলিকন এর তৈরি এলিয়েন ‘Horta‘-কে আমরা অনেকেই দেখেছি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাস্তবেও কি এমন জীবের অস্তিত্ব রয়েছে?
আমরা সবাই জানি, কার্বন হলো “বিল্ডিং ব্লক ফর লাইফ”। তবে কার্বনের সাথে একটি মৌলের বেশ মিল রয়েছে। মৌলটি হলো কার্বনের ঠিক নিচে অবস্থিত সিলিকন।
একই পরিবারের দুই ভাইয়ের চেহারা, চরিত্র ইত্যাদিতে প্রচুর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে, কার্বনের সাথে একই গ্রুপে অবস্থিত সিলিকনের সাথে বেশ মিল রয়েছে। কার্বনের পারমাণবিক সংখ্যা ৬টি এবং সিলিকনের ১৪ টি। উভয়ের যোজ্যতা স্তরে ইলেক্ট্রন সংখ্যা চারটি। এই মিলের কারণে সিলিকন ও কার্বনের ধর্মেও প্রচুর সাদৃশ্য দেখা যায়।
দুই ভাইয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকলেই তারা যেমন একই ব্যক্তি হয়ে যায়না, অনুরূপভাবে কার্বন এবং সিলিকন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হলেও তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সিলিকনের মধ্যে কার্বনের ঐ সকল গুণাবলী নেই যা কার্বনকে পৃথিবীতে একটি আলাদা গুরুত্ব দেয়।
কার্বন ও সিলিকনের মধ্যে যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তার উপর ভিত্তি করে অনেকে ধারণা করেন যে, কার্বনের ন্যায় সিলিকনেরও ক্ষমতা রয়েছে ‘বিল্ডিং ব্লক ফর লাইফ’ হয়ে উঠার। বিশেষ করে সাইন্স ফিকশন প্রেমীদের মধ্যে একাংশ তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। সাইন্স ফিকশন প্রেমীদের জন্য দু:সংবাদ, পৃথিবীতে সিলিকন সেসব চমকপ্রদ গুণাবলী দেখাতে পারেনা যা কার্বন সচরাচর দেখিয়ে থাকে।
এর কিছু উদাহরণ দেয়া যাক:
(১) পৃথিবীতে প্রাণীদের জৈবিক ক্রিয়ায় নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মজার কথা হলো, সিলিকন অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ায় সিলিকন-ডাই-অক্সাইড (SiO2) গঠন করতে পারে।
কিন্তু এটি সাধারণ তাপমাত্রায় কঠিন (৪০০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট লাগে একে গ্যাস বানাতে)। তাছাড়া দেহে থাকা কার্বন-ডাই-অক্সাইড রক্তের মাধ্যমে ফুসফুসে গিয়ে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সিলিকন-ডাই-অক্সাইড পানিতে দ্রবীভূত-ই হয়না। স্বাভাবিকভাবেই একটি কঠিন পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহার করা প্রাণীদের পক্ষে অসম্ভব।
(২) কার্বনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রিং গঠন। রিং গঠনের মাধ্যমে কার্বন যৌগ প্রচুর শক্তি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। নানা গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ, যেমন: চিনি তৈরিতেও এই রিং গঠন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অপরদিকে সিলিকন সাধারণত এধরনের রিং বানাতে পারেনা।
ফলে কার্বনের তুলনায় সিলিকনের যৌগ সংখ্যাও কম। তাই আমরা সিলিকন নির্মিত হরমোন, এনজাইম ইত্যাদি দেখতে পারিনা যা জীবদের জন্য অপরিহার্য।
(৩) একটি বিক্রিয়ায় দ্রাবক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীতে কার্বন ভিত্তিক জীবন তৈরিতে যে সকল বিক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে প্রায় সকল বিক্রিয়ায় দ্রাবকের ভূমিকা পালন করেছে পানি। (পানির অপর নাম জীবন এমনি এমনি বলা হয় না) কারণ পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন দ্রাবক নেই যা পানির মতো দ্রবীভূত করতে পারার ক্ষমতা রাখে ।
বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিক্রিয়কসমূহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কঠিন বা ঘন তরল আকারে থাকে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটানো প্রায় অসম্ভব। যদি দ্রাবক ব্যবহার হয় তাহলে বিক্রিয়কে থাকা অণুগুলো সেটিতে দ্রবীভূত হয় এবং সেগুলোর মধ্যে বিক্রিয়কের অণুগুলো গতিশীলতা লাভ করে। এই গতিশীলতার ফলে অণুগুলো সহজেই একে অপরের সাথে বিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। কিন্তু সিলিকন তো পানিতেই দ্রবীভূত হয়না। ফলে পৃথিবীতে সিলিকন ভিত্তিক জীবনের সম্ভাবনা আপনা আপনি নেই হয়ে যায়।
উপরোক্ত নানা কারণে পৃথিবীতে সিলিকনের পরিবর্তে আমরা কার্বন ভিত্তিক জীব দেখতে পাই।
মজার বিষয় হলো পৃথিবীতে সিলিকনের পরিমাণ কার্বনের চাইতে বেশি। তাছাড়া সামুদ্রিক অর্চিন এবং রেডিওলারিয়ার মতো প্রাণীদের শুধুমাত্র বহিঃকঙ্কাল সিলিকা (SiO2) দ্বারা তৈরি। শ্বাস নেওয়া বা শক্তি সঞ্চয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াসমূহে সিলিকনের কোন ভূমিকা নেই।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন-ই মানতে নারাজ যে ‘সিলিকন ভিত্তিক জীবন’ অসম্ভব। এ গ্রহে না হলেও অন্য কোন গ্রহে তো এটা সম্ভব হতেই পারে। এই ধারণা থেকে আলোচনায় আসে, শনি গ্রহের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ টাইটান।
টাইটানে কি সিলিকনের তৈরি এলিয়েন আছে?
টাইটানে অক্সিজেনের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ফলে সেখানে থাকা সিলিকনগুলো কঠিন সিলিকন-ডাই-অক্সাইড গঠনের কোন প্রশ্নই উঠে না। ফলে সিলিকন অণু যেমন সিলিকেন (SiH4) এবং পলিসাইলেন (একাধিক SiH4 গ্রুপের যৌগ) উৎপন্ন হবার সুযোগ পায়। তাছাড়া উপগ্রহটির সকল পানি কঠিন অবস্থায় বিরাজ করে।
টাইটানের পৃষ্ঠে তরল অবস্থায় থাকে ইথেন এবং মিথেন। মিথেন সিলিকনের বিক্রিয়ার জন্য বেশ ভালো একটি দ্রাবক। হাইড্রোজেন পরমাণুর উপস্থিতির কারণে সিলেন এবং জৈব যৌগের ধর্মের মধ্যে কিছু মিল পরিলক্ষিত হয়। সিলেন জারণ-বিজারণ এবং প্রতিস্থাপনের মতো বিক্রিয়া দেখাতে পারে যা সাধারণত জৈব যৌগসমূহ দেখায়।
তাহলে মিথেন দ্রাবক এবং সিলেনের সমন্বয়ে কি টাইটানে জীবনের আবির্ভাব ঘটানো সম্ভব, যেমনটা কার্বন এবং পানির মাধ্যেমে পৃথিবীতে হয়েছিল?
সম্ভবত না। দুর্ভাগ্যবশত, টাইটানের বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে কার্বনেরও উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে কার্বনের তুলনায় সিলিকনের উপস্থিতি খুব কম। ফলে হাইড্রোজেন সিলিকনের সাথে বিক্রিয়ার পূর্বেই কার্বনের সাথে বিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ সিলিকেন উৎপন্ন হতে পারেনা। তাছাড়া টাইটানে পানি কঠিন অবস্থায় থাকা সহ টাইটানের নানা পরিবেশগত প্রতিকূলতার কারণে সেখানে কার্বনভিত্তিক জীবনও তৈরি হয়না।
সিলিকন-ভিত্তিক জীবন আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত এর অস্তিত্ব আছে নাকি নেই, তা নিয়ে কল্পনা-জল্পনা চলতেই থাকবে। মহাবিশ্বের এই অসীম সম্ভাবনার মাঝে মানুষ হয়তো একদিন এ রহস্যেরও সমাধানও করেই ফেলবে।
আতিক হাসান রাহাত, সাজ্জাদ হোসেন জিনাস / যৌথ প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: স্মিথসোনিয়ান মাগ