খুব বিষণ্ণ বোধ করছেন গত কিছুদিন যাবত?
কিছুই ভালো লাগছে না? অকারণে মন খারাপ হচ্ছে? বিরক্তিবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে? কারণ ছাড়াই হয় কান্না পাচ্ছে অথবা রাগ হচ্ছে?
আপনি যদি হুট করেই মানসিক অবস্থার এমন পরিবর্তন লক্ষ্য করেন, তবে বিচলিত হবার কিছু নেই। সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার(SAD) নামক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে আপনার মানসিক এই বিষণ্ণতা দেখা দিয়েছে।
কি এই সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার?
সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার একটি ঋতু ভিত্তিক আবেগীয় সমস্যা। এটি একটি বিষণ্নতা সংশ্লিষ্ট রোগ যা ঋতু পরিবর্তনের সাথে ঘটে। সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারকে সিজনাল ডিপ্রেশন বা মৌসুমি বিষণ্ণতাও বলা হয়ে থাকে কারণ মৌসুমের আসা-যাওয়ার সাথেই এর সম্পর্ক এবং এটি খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। এটি সাধারণত হয়ে থাকে বর্ষাকালে ও শীতের সময়ে। সাধারণত শীতকালের আগে আসে ও বসন্তের শুরুতেই চলে যায় তবে গরমে এর প্রভাব কম। যেহেতু শীতকালে বেশি হয়, তাই এটি শীতকালীন বিষণ্ণতা বা উইন্টার ব্লুজ নামেও পরিচিত।
বয়স ও লিঙ্গ ভেদে যে কেউ এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। তুলনামূলকভাবে নারীরাই এতে আক্রান্ত হয় বেশি। আবার বয়স্কদের চেয়ে কমবয়সীদের মধ্যে ও বিষুবরেখা থেকে দূরে অবস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে এর হার বেশি দেখা যায়।
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার বা এসএডি এর কারণ কি?
এসএডির কারণ এখনও স্পষ্ট জানা যায়নি। ব্যক্তি বিশেষে এর কারণ পৃথক হতে পারে। জিনগত অস্বাভাবিকতা সিজনাল এফেকটিভ ডিসঅর্ডারের সন্নিহিত কারণ হতে পারে। আলো এসএডিকে প্রভাবিত করে বলে মনে করা হয়।
মৌসুমি বিষণ্নতার একটি কারণ হিসেবে দেখা হয় মস্তিষ্কে বায়োকেমিক্যাল ভারসাম্যহীন এক অবস্থাকে, যা শীতে দিনের সময়ের স্বল্পমেয়াদ ও স্বল্প সূর্যালোকের কারণে সৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে দিনের সময়কাল কমে আসে। দিনের আলো কমে যাওয়ার ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ সাইকেলের স্বাভাবিক ক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যা মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এর থেকে এই বিষণ্ণতা তৈরি হয়। অন্যদিকে রোদের আলো কম পাবার ফলে সেরোটোনিন হরমোন নিঃসরণের মাত্রাও কমে যায়, যা মুড পরিবর্তনের জন্য দায়ী। মৌসুমি বদল শরীরের মেলাটোনিনের মাত্রায়ও তারতম্য আনে, যা মেজাজ এবং ঘুমের ধরণকে প্রভাবিত করে। ঋতুর বদল ঘটার সাথে মানুষের অভ্যন্তরীণ বায়োলজিক্যাল ক্লকে এমন ছন্দের পরিবর্তন আসাটা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এর লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারের লক্ষণগুলো একেকজনের মধ্যে একেক রকম হয়। এগুলো হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে এবং ডিপ্রেশনের মতো অনেক লক্ষণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
সাধারণত দুই ধরণের এসএডি রয়েছে- শীতের সময় এবং গ্রীষ্মকালীন সময়।
শীতকালীন এসএডি এর লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
- ক্লান্তি বেড়ে যাওয়া
- অলসতা
- বিরক্তি বৃদ্ধি
- ঘুমের আধিক্য
- ঘুমের সময় বাড়ার পরেও কম শক্তির অনুভব
- খিদে বেড়ে যাওয়া। খাবারের রুচিতে পরিবর্তন, বিশেষ করে উচ্চমাত্রার কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাদ্যের প্রতি দুর্বলতা।
- ওজন বৃদ্ধি
- সব সময় দুঃখিত থাকা
- হতাশ, মূল্যহীন বা দোষী বোধ করা
- অশান্তি
- মানুষজন থেকে দূরে থাকা।
- কর্মচাঞ্চল্যের ঘাটতি
- সামাজিক ক্রিয়াকলাপে আগ্রহের অভাব
- জটিল চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া ও কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ দিতে অসুবিধা।
গ্রীষ্মকালীন এসএডি এর লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
- অশান্তি
- ঘুমের ব্যাঘাত বা নিদ্রাহীনতা
- অস্থিরতা বৃদ্ধি
- ক্ষুধামন্দা
- ওজন হ্রাস পাওয়া
- উদ্বিগ্ন হওয়া, অস্থির বোধ করা
- নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করা। মৃত্যু বা আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারে কাদের আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি?
পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা চারগুন বেশি। যাদের পরিবারে কারো এসএডি কিংবা অন্য কোনো মানসিক রোগের ইতিহাস আছে তাদের এই অসুখে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যারা আগে থেকেই বিষণ্নতায় ভোগেন, ঋতুভেদে সেই বিষণ্নতা অনেকাংশে বেড়ে এসএডির সূচনা ঘটায়।
বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার একটি সাধারণ ব্যাপার। ভিটামিন ডি এর ঘাটতির ফলেও বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখা যেতে পারে। ভৌগোলিক কারণে যারা শীতপ্রধান অঞ্চলে বসবাস করেন, তাদের ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কারণ শীতই হচ্ছে এই অসুখের আসল মৌসুম।
কিভাবে এর নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
এসএডিয়ের উপসর্গগুলি বিষণ্ণতা রোগের বিভিন্ন বিষয়ের পরিমাপের সাথে মিলিয়ে দেখার পর নির্ণয় করা হয়। রোগীর মানসিক অবস্থা নির্ণয় করার জন্য কিছু প্রশ্নাবলী ব্যবহার করা হয়।
ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সাধারণত লক্ষণগুলি কমে যায়। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে আরও দ্রুত সমস্যা সারানো যায়। সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার অ্যাসোসিয়েশন সাময়িক এই মানসিক সমস্যা কাটানোর জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী টিপস জানিয়েছে, যা এসএডি এর প্রভাবকে কমাতে বেশ কার্যকর।
সিজনাল ইফেক্টিভ ডিজঅর্ডার নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ
১। সূর্যালোকের সংস্পর্শে থাকা।
২। উপভোগ করেন এমন কাজ করার চেষ্টা করা। যত্নশীল এবং ইতিবাচক বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানো। বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করা।
৩। নিজেকে সবসময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা। কাজ করতে ইচ্ছা না করলেও, জোর করে নিজেকে ব্যস্ত না রাখলে বিষণ্ণতা বৃদ্ধি পাবে।
৪। স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অনুশীলন করা। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার অভ্যাস এসএডি লক্ষণগুলি হ্রাস করতে সহায়তা করে। যেমনঃ নিয়মিত ব্যায়াম করা, পর্যাপ্ত ঘুমানো, সুষম খাদ্য খাওয়া এবং স্ট্রেস কমানোর চেষ্টা করা।
৫। বাইরে বের হতে হবে। ঘরের বাইরের কাজে বেশি সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করতে হবে। সারাদিন ঘরের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকলে মন খারাপ হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায় অনেকটা। ছোটখাটো কোন কাজে অথবা কিছুটা হাঁটার জন্য হলেও বাসা থেকে বের হতে হবে। বাইরের আলো-বাতাস ও প্রাণচাঞ্চল্যে মন খারাপ ভাব কেটে যায়।
৬। যেহেতু শীতকালে এই সমস্যাটি বেশি দেখা দেয়, তাই অবশ্যই নিজেকে গরম কাপড়ে উষ্ণ রাখতে হবে। উষ্ণতা এসএডি কাটাতে কার্যকরি। সঙ্গে গরম পানীয় ও খাবার খাওয়ার প্রতিও যত্নশীল হতে হবে।
৭। চারপাশ আলোকিত করে রাখার চেষ্টা করতে হবে। শীতকালে দিনের সময়কাল কমে যাওয়ার পাশাপাশি, সূর্যের দেখা পাওয়াও কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাই বাসা ও ঘর যতটা সম্ভব আলোকিত করে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
৮। লাইট থেরাপিঃ এসএডিয়ের চিকিৎসার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হল লাইট থেরাপি। সূর্যের আলোর সংস্পর্শে কম থাকলে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হতে পারে, কিন্তু সামান্য আলোর উপস্থিতি মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এজন্য লাইট থেরাপির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এটি প্রাকৃতিক আলোর প্রতিলিপি তৈরি করে। উজ্জ্বল আলোর উৎস শরীরের সারকাডিয়ান রিদম বজায় রাখতে সাহায্য করে। লাইট থেরাপি কেবলমাত্র একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এবং অনুমোদিত ডিভাইসে ব্যবহার করা উচিত।
৯। ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
১০। অনেকে এন্টিডিপ্রেসেন্টস জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে উপকৃত হন।
এসএডি হলো বিষণ্নতা ব্যাধিগুলির একটি প্রকার যা সহজে ঠিক করা যেতে পারে, কারণ এটি মৌসুমী পরিবর্তন দ্বারা পরিবর্তিত হয়। দ্রুত শনাক্তকরণ এসএডি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
চিকিৎসা কখন প্রয়োজন?
উইন্টার ব্লুজ বা এসএডি খুবই সাময়িক একটি মানসিক সমস্যা। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে এই সমস্যা দেখা দেয় এবং কেটেও যায়। মাঝেমধ্যে বিষণ্ণতা তে আক্রান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক, তবে যদি মানসিক বিষণ্ণতা দীর্ঘসময় ধরে থাকে, আবহাওয়ার পরিবর্তনেও কোন পরিবর্তন না আসে এবং শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে, নেতিবাচক বা আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা আসে, তবে অবশ্যই মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রতি বছর একই সময়ে লক্ষণগুলি অনুভব করেন। সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার এর লক্ষণ গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। সঠিক চিকিৎসা না হলে এটি আরও খারাপ ও অপ্রতিরোধ্য হতে পারে। যা শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে ও প্রতিদিনের কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত করতে পারে, ক্ষতি করতে পারে সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্যের। চিকিৎসা এর জটিলতা প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
তাই, আপনি যদি মনে করেন যে আপনার হতাশা গুরুতর বা আপনি আত্মঘাতী চিন্তাভাবনাগুলি অনুভব করছেন, অবিলম্বে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
রেজুয়ানা ফাউজিয়া রিনাত/নিজস্ব প্রতিবেদক
এগুলো পড়ুন
একাকীত্ব ও ক্ষুধা, উভয়ক্ষেত্রেই মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া একই: গবেষণা নমুনা সংগ্রহের লক্ষ্যে চাঁদ এ চীনের মিশন চ্যাং ই-৫ নিত্যদিনের সঙ্গী স্মার্টফোনটিই কি হয়ে উঠছে আপনার মৃত্যুর কারণ? |
তথ্যসূত্রঃ হেলথ লাইন ; মায়োক্লিনিক , সাইকিয়াট্রি