ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শৈবাল এসকল জীবের নামের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এগুলো মূলত অণুজীব। কিন্তু আদৌ কী আমরা এই অণুজীবগুলোর প্রয়োজনীয়তা জানি? সমুদ্রে কার্বনের বৃদ্ধিতে অণুজীবদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
অণুজীবের গুরুত্ব সম্পর্কে জানার পূর্বে জানতে হবে, অণুজীব কী?
অণুজীব হল এককোষী জীব যাদের সাধারণত খালি চোখে দেখা যায় না এবং এরা একক-কোষীয় আকারে অথবা কোষের কলোনি হিসাবে থাকে। এগুলো জীবাণু বা অণুবীক্ষণিক জীব হিসাবেও পরিচিত কারণ এগুলো কেবল মাইক্রোস্কোপের নীচেই দেখা সম্ভব।
এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোর সংখ্যা মহাবিশ্বে যত নক্ষত্র রয়েছে তার চেয়েও সংখ্যায় আরো কয়েকগুণ বেশি৷ এগুলোকে পৃথিবীর আনাচে-কানাচেতে পাওয়া যায়। যেমন, সমুদ্রের গভীরে এবং আগ্নেয়গিরির ভেন্ট, হিমবাহ, গুহা এবং খনিতে।
এসকল অনুজীবই বায়ুমণ্ডলে বেশিরভাগ অক্সিজেন সরবরাহ করে। তাছাড়াও জীবের খাদ্য হজম করতে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিচালনা করতে সহায়তা করে। মানুষ সহ প্রাণীরা যখন মারা যায়, তখন জীবাণু তাদের পচনে সহায়তা করে, কার্বন, নাইট্রোজেন এবং ফসফেট মুক্ত করে যা নতুন জীবন তৈরি করে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে মানবদেহে প্রায় ৩৮ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া সারাক্ষণ বিচরণ করে।
সম্প্রতি মিয়ামির দক্ষিণে অবস্থিত মানাটি উপসাগরের পানির তাপমাত্রা প্রায় ১০১.১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে উঠেছিলো। তখন বিজ্ঞানীরা প্যারটফিশ, গ্র্যান্টস, কাঁটাযুক্ত গলদা চিংড়ি এবং প্রবাল প্রাচীরের উপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তাদের আরো ভাবিয়ে তোলে যে বিষয়টি তা হলো, সমুদ্রের মাইক্রোবায়োমের অদৃশ্য জগতের উপর এর প্রভাব যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। যেমন: ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শৈবাল এবং ভাইরাস।
আমরা যেভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার করছি, এভাবে চললে আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে, এমন জীবাণুর সংখ্যা এতটাই কমে যাবে যে পৃথিবী আমাদের বাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। প্রায় কয়েকশো বিলিয়ন জীবাণু বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীকে কার্বন-সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেনে ভেজা পরিবেশে রূপান্তরিত করেছে। সেই যুগে, বেশিরভাগ জীবাণুই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে থাকতো। আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তার বিশাল অংশ এই অণুজীবরাই উপজাত হিসেবে পরিবেশে ছাড়ে।
কার্বন এবং অন্যান্য দূষণকারী পদার্থ পৃথিবীর মাইক্রোবায়োমকে পরিবর্তন করে এবং গ্রহব্যাপী অণুজীবগুলোর জীবন ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই অসচেতন। পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের বেশির ভাগই উৎপন্ন করে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নামক এক ধরনের সামুদ্রিক জীবাণু। শুধু তাই নয় প্রতি বছর মানুষের দ্বারা উৎপাদিত কার্বনের প্রায় ৩০ শতাংশও ধ্বংস করে এই জীবাণু। তাই একে সামুদ্রিক জৈবিক কার্বন পাম্প বা জৈবিক পাম্প বলা হয়। তবে এই জীবাণুর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
সমুদ্রবিজ্ঞানী এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোল্লার জে. ক্রেগ ভেন্টার ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োলজিস্ট বলেন,
“যদি এই জৈবিক পাম্প কাজ করা বন্ধ করে দেয় তবে আমরা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বো।”
CO2-এর ক্রমবর্ধমান মাত্রা সমুদ্রের জলকে আরও অম্লীয় করে তোলে। এটি সমুদ্রের পানির পিএইচ পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। পিএইচ পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক সংবেদনশীল জীবাণুর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। জমিতে ব্যবহৃত সার, ফসফেট এবং নাইট্রোজেন বৃষ্টির সময় জমি থেকে বৃষ্টির পানির সাথে নদীতে চলে যায় যা পরবর্তীতে নদী থেকে সমুদ্রে প্রবাহিত হয়। এসব পদার্থ সমুদ্রে মৃত অঞ্চলের সৃষ্টি করছে যেখানে অক্সিজেনের মাত্রা এতই কম থাকে যে সেখানে কোন মাছ বা অন্যান্য সামুদ্রিক জীব জীবিত থাকতে পারেনা।
মেক্সিকো উপসাগরে মিসিসিপি নদীতে একটি মৃত অঞ্চল তৈরি হয়েছে যা আকারে নিউ জার্সির সমান। বাল্টিক সাগর থেকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার উপকূল থেকে গ্রেট লেকে পর্যন্ত মৃত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম ডেড জোন হল ওমান উপসাগরের ৬৩,৭০০-বর্গ-মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ডেড জোন যা আকারে প্রায় ফ্লোরিডার সমান।
মহাসাগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে সামুদ্রিক প্রবাল, ব্যাকটেরিয়া এবং জুক্সানথেলা নামক ক্ষুদ্র শৈবাল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। Zooxanthellae প্রবালের বর্জ্য অপসারণ এবং রোগজীবাণু প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। প্রবালের প্রাণবন্ত রং তৈরিতে সাহায্য করে। এ-সকল টিস্যুর ক্ষতি প্রবাল প্রাচীরের মৃত্যু, ব্লিচ নামক রোগের জন্য দায়ী। উত্তর আটলান্টিকের কিছু অংশে অধিক তাপমাত্রার ফলে ভিব্রিও নামক একটি বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া প্রজাতি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা মানুষের কলেরা সহ অন্ত্রের নানান রোগের সৃষ্টি করে।
বিজ্ঞানীরা শুধু এটাই বলতে পারবেন যে কীভাবে ফ্লোরিডার তাপমাত্রা সেখানে বসবাসকারী জীবাণুদের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী জ্যাক গিলবার্ট বলেছেন,
“একশো-ডিগ্রি ফারেনহাইট জল স্পষ্টতই মাইক্রোবায়োমকে পরিবর্তন করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা এর প্রভাব সম্পর্কে জানি না। অণুজীবগুলো অত্যন্ত অভিযোজনযোগ্য। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো আরও নিয়মিত হয়ে উঠলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে এবং খাদ্যশৃঙ্খলেও প্রভাব ফেলতে পারে।”
জেনেটিসিস্ট ক্রেগ ভেন্টারের একটি নতুন বই Voyage of the Sorcerer 2 এর Explorations into the Microbiome of the Oceans নামক অংশে বলা হয়েছে যে,
“পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি মানুষই দায়ী এবং মানুষই এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। তাছাড়া পৃথিবীর ক্ষুদ্র প্রাণীদের উপরও এর প্রভাব পড়বে। তাই স্বাভাবিকভাবেই অ্যাডেলি পেঙ্গুইন, বন্য টিউলিপ, পাইপার প্লোভার-এবং পূর্বোক্ত প্যারটফিশ এবং কাঁটাযুক্ত গলদা চিংড়ির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।”
ডুপন্ট বলেন,
“যা ঘটছে সে সম্পর্কে রাজনীতিবিদ এবং অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা কঠিন। তবে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১ সালে ৩৪ জন মাইক্রোবায়োলজিস্টের একটি দল ‘মানবতার প্রতি বিজ্ঞানীদের সতর্কতা-অণুজীব এবং জলবায়ু পরিবর্তন’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
বিজ্ঞানীরা উক্ত গবেষণায় মানবতাকে নজরে রেখেছেন এবং বলেছেন যে জলবায়ু পরিবর্তন অণুজীবদের উপর অনেক বেশি নির্ভর করবে, আর অণুজীবরা পরিবেশের জন্য অপরিহার্য।”
১৯৬২ সালে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী রাচেল কারসনদেওয়া একটি সতর্কবাণী দিয়েছিলেন যা সাইলেন্ট স্প্রিং নামে পরিচিত। সতর্কবাণী ছিল,
“ছয় দশক পরে আমরা উষ্ণ মহাসাগর, অনাকাঙ্ক্ষিত দাবানল, বন্যা, ফসলের ক্ষতি এবং সুপারস্টর্ম দেখতে চলেছি।”
তিনি ঠিক যা বোঝাতে চেয়েছিলেন আমরা এখন তাই দেখছি। এখন এটা বোঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য এই ক্ষুদ্রতম প্রাণীগুলোর প্রয়োজন কতটুকু। আর মানব সভ্যতা যে অনেকাংশেই এই অণুজীবগুলোর উপর নির্ভরশীল তাও প্রমাণিত।
মাহমুদুল হাসান ইহসান / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সাইন্টিফিক আমেরিকান