প্রতিবছর শীতের আগমন হয় নিয়ম করে। পিঠাপুলি ও সুন্দর শীতের সকালের উৎসবে সবাই মেতে উঠি। শীতের আগমন প্রকৃতিরই নিয়ম তা সত্যি, কিন্তু কিভাবে এলো এই নিয়ম? কোন ধরণের মহাজাগতিক ঘটনার জন্যে আসলে প্রতিবছর নিয়ম করে একই সময়ে শীত আসে?
“হিম হিম শীত শীত / শীত বুড়ি এলো রে”
আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শীতের আগমন আলোচিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই প্রান্তিককরণ শীতের আবির্ভাব বা গ্রীষ্মের বিদায় বছর জুড়ে এখানে একবারই ঘটে। কিন্তু পুরো পৃথিবী জুড়েই কি শীত এমনই? অবশ্যই না।
ঋতুর পরিক্রমায় কীভাবে এ গ্রহে ঘটে শীতের আগমন, এর বৈজ্ঞানিক আলোচনা জানব আমরা এখানে। এ বছর উত্তর গোলার্ধে আনুষ্ঠানিক শীত শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর রাত ০৯ টা ৫৮ মিনিটে। বিষুবরেখার দক্ষিণাঞ্চলে এই একই মুহূর্তে ছিল আনুষ্ঠানিক গ্রীষ্মের সূচনা। এই সময় দুটি উত্তর গোলার্ধে ও দক্ষিণ গোলার্ধে ছিল যথাক্রমে winter solstice ও summer solstice।

‘Winter Solstice’ কী?
Solstice শব্দটির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় অয়নান্ত বিন্দু। নিরক্ষরেখা থেকে সূর্যের দূরতম অবস্থান Solstice। Winter solstice যে গোলার্ধে ঘটে সেই গোলার্ধের নিরক্ষরেখা ঐ বছরে সূর্যাপেক্ষা সর্বাধিক দূরত্বে অবস্থান করছে। ঠিক উল্টোভাবে বিপরীত গোলার্ধে বছরের ঐ সময়ে সূর্যের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আলো পায়। আর সেখানে ঘটে Summer Solstice।

Solstice ঘটার কারণ :
Solstice ঘটার প্রধানত দুটো কারণ রয়েছে।
- প্রথমত, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর যে কক্ষপথ রয়েছে এই কক্ষে পৃথিবী প্রায় ২৩.৪ ডিগ্রি কাত হয়ে ঘূর্ণন কাজ চালায়। এই কাত হয়ে থাকার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধবাসীরা সারা বছরে কখনোই সম পরিমান সূর্যরশ্মি পায় না। ফলে দুই গোলার্ধে ভিন্ন ভিন্ন মৌসুম চলতে থাকে। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তর গোলার্ধ সূর্য অভিমুখে হেলতে থাকে এবং বসন্ত ও গ্রীষ্মের আগমন ঘটে।সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত উত্তর গোলার্ধ সূর্যের উল্টোদিকে হেলতে থাকে এবং শরৎ ও শীতের সূচনা হয়। এই সময়ে দক্ষিণ গোলার্ধে ঠিক বিপরীত কার্যক্রম চলতে থাকে। প্রতি বছর দুটো মুহূর্তকে solstice বলা হয়, যখন পৃথিবীর অক্ষগুলি সূর্যের দিকে সর্বাপেক্ষা কাত হয়ে থাকে। যখন গোলার্ধ সূর্যের দিকে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকে তা ওই গোলার্ধে সবচেয়ে বড় দিন। আর গোলার্ধ যখন সূর্যের বিপরীত দিকে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকে তা ওই গোলার্ধে সবচেয়ে বড় রাত।
উত্তর গোলার্ধে Summer Solstice সাধারণত ২১ জুনের কাছাকাছি সময়ে হয়ে থাকে। আর Winter Solstice হবে ২২ ডিসেম্বরের কাছাকাছি কোন সময়ে। তাই এ দুটি তারিখ উত্তর গোলার্ধে যথাক্রমে সবচেয়ে বড় দিন ও সবচেয়ে বড় রাত হিসেবে পালিত হয়।
- Solstice ঘটার দ্বিতীয় কারণ পৃথিবীর কোথায় সূর্যকে দেখা যাবে এর উপর নির্ভর করে। উত্তর গোলার্ধে যখন Summer Solstice হয় তখন সূর্য সরাসরি ক্যান্সার অব ট্রপিক এর উপর অবস্থান করে (দ্রাঘিমাংশ ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর)। এই সময় আপনি যতই উত্তরে যেতে থাকবেন সূর্যকে ততটাই মাথার উপর উপুড় থাকা অবস্থায় দেখতে পাবেন। আর উত্তর গোলার্ধে শীতের সময় সাধারণত সূর্য সরাসরি মকর ক্রান্তির উপর অবস্থান করে।

অন্যান্য গ্রহের Solstice :
সাধারণ ভাবেই পৃথিবী একমাত্র গ্রহ নয় যেখানে অয়নান্ত ও বিষুবীয় বিষয়াদি রয়েছে। নিজ অক্ষে কাত হয়ে ঘোরা যেকোনো গ্রহেই দেখা যাবে এবং স্বাভাবিকভাবেই কিছু কারণ আছে যার জন্য পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলোর ঋতুতে জলবায়ুগত পরিবর্তন সমান না। এখানে প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রহগুলোর তাদের নিজ অক্ষে সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকা। যেমন শুক্র গ্রহ তার অক্ষে মাত্র ৩ ডিগ্রি কাত হয়ে ঘূর্ণন কাজ চালায়। ফলে পৃথিবীতে শীত ও গ্রীষ্ম দুই ঋতুর মাঝে সূর্যের আলো পাওয়ার যে বিশাল তারতম্য, শুক্রে তা এতটা দেখা যাবে না।
এখানকার আরও একটি কারণ হচ্ছে গ্রহগুলোর কক্ষপথের দৈর্ঘ্য। একটি ব্যাপারে অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা রয়েছে। মনে রাখা দরকার সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথ কোনটিই পুরোপুরি বৃত্তাকার নয়। বরং সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ উপবৃত্তাকার পথে আবর্তন করে। সূর্যের কাছের গ্রহগুলোর তুলনায় দূরের গ্রহগুলোর কক্ষপথ বেশি উপবৃত্তাকার। যেমন পৃথিবীর তুলনায় মঙ্গল। ফলে মঙ্গলের একটি পূর্ণ বার্ষিক ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে পৃথিবীর তুলনায় সময় বেশি লাগবে ও সেখানকার মৌসুমগুলোও লম্বা হবে।
এভাবেই আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করে বছরে ঋতু পরিবর্তন হয় এবং দিন ও রাতের দৈর্ঘ্যে তারতম্য দেখা যায়।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ মাসরুল আহসান
তথ্যসূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
+1
+1
+1
+1
+1
3
+1
+1