প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩,৫০০ এরও বেশি বাচ্চা ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যায়। এমনটা প্রায় হঠাৎ শিশুমৃত্যু সিনড্রোম (SIDS) বা শ্বাসরোধ দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারণে ঘটে। যখনই শিশুর ঘুমের কথা আসে, তখন কিছু কুসংস্কার পূর্ণ পরামর্শ শিশুর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই, আজকে এই প্রতিবেদনে চলুন জেনে নিই আপনার শিশুর নিরাপদ ঘুমের জন্য প্রচলিত কিছু মিথ নিয়ে।
মিথ-১: আপনার শিশু নিরব ঘরে সবচেয়ে ভাল ঘুমায়।
কথাটি সত্য না। প্রকৃতপক্ষে, সম্পূর্ণ নিরবতায় আপনার শিশুর পক্ষে ঘুমাতে কষ্ট হতে পারে কারণ গর্ভাশয় কোলাহলপূর্ণ, এতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের চেয়ে আরও জোরে শব্দ থাকে এবং ২৪ ঘন্টা চলমান। নয় মাস ধরে, আপনার ছোট্ট শিশুটি প্ল্যাসেন্টার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রক্তের ছন্দময় ছোঁয়াতে ঘুমায়। এছাড়াও, নীরব ঘরে ঘুমানো অবস্থায়, রাস্তায় যখন জোরে ট্রাক চলে বা রাতে অন্য কোন কারণে সেই নীরবতা ভেঙে যায় তখন আপনার শিশুর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, কোলাহলপূর্ণ স্থানে সম্ভাবনাটা কম থাকে।
অর্থাৎ সত্য হল, আপনার শিশু কোলাহলপূর্ণ স্থানে সবচেয়ে ভাল ঘুমাবে।
মিথ-২: কখনই ঘুমন্ত শিশুকে জাগ্রত করবেন না।
এ কথাটিও সত্য না বরং আপনার ঘুমন্ত শিশুটিকে “জেগে উঠো এবং ঘুমাও” নামক একটি কৌশল ব্যবহার করে সর্বদা জাগানো উচিত। এটি আস্তে আস্তে আপনার বাচ্চাকে স্ব-স্বাচ্ছন্দ্য নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা শেখায়। কৌশলটি যেভাবে কাজ করে- কোন এক দিনকে তার জীবনের প্রথম দিন হিসাবে শুরু করে, তাকে অল্প ছোঁয়াতে জাগিয়ে তুলুন। চোখ ধীরে ধীরে না খোলা পর্যন্ত তার ঘাড় বা পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দিন। অর্ধ ঘুম হলে খুব শীগ্রই, সে আবার ঘুমে চলে যাবে।
মিথ ৩: কিছু বাচ্চা মোড়ানো (Swaddling) অবস্থায় ভালো ঘুমাতে পারে না কারণ তারা মুক্ত অবস্থায় থাকতে চায়।
আপনার বাচ্চা প্রথম প্রথম মোড়ানো প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে পারে, তাই দেখে মনে হবে সে এটিকে ঘৃণা করে। তবে এটি ভাববার কোনো প্রয়োজন নেই, তাদের গর্ভে থাকা অবস্থায় সুরক্ষার যে অনুভূতি ছিল, তা দরকার হয়। আপনার শিশুকে মোড়ানো অবস্থায় না রাখলে, হাত পা নাড়াচাড়া করবে, হাত দ্বারা মুখে এবং চোখে আঘাত করবে। ফলে সারা রাত সহজেই চমকে চমকে উঠে যাবে। এভাবেই তার ভালো ঘুম হবে না।
অতএব সত্য হলো, মোড়ানো অবস্থায় আপনার শিশু ভালো ঘুমায় তাই আপনারা শিশুকে এতে অভ্যস্ত করা উচিৎ।
মিথ ৪: বাচ্চাদের তাদের নিজস্ব ঘরে ঘুমোতে শেখানো উচিত।
বাচ্চাদের স্বাবলম্বী হিসেবে বড় হতে দীর্ঘ সময় লাগে। তাই তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। প্রকৃতপক্ষে আপনার সদ্যজাত বাচ্চাকে অন্য ঘরে ঘুমাতে দেওয়া (খাওয়ানো এবং ডায়াপারের পরিবর্তনের জন্য) অসুবিধাজনক এবং বিপজ্জনকও হতে পারে। আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স বাচ্চাদের পিতামাতার ঘরে (সর্বদা তাদের নিজের বিছানায়) কমপক্ষে ছয় মাস ঘুমানোর পরামর্শ দেয়। এ সহজ অনুশীলন হঠাৎ শিশুমৃত্যু সিনড্রোমের (SIDS) হারকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে।
মিথ-৫: মোড়ানো(swaddling) অবস্থায় ঘুম পদ্ধতি শিশুর দু’মাস হওয়ার পর বন্ধ করা উচিত।
সোয়াডলিং কান্না কমায় এবং ঘুম বাড়ায়। তবে নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্বাভাবিক অবস্থায় ঘুমানো বাচ্চার চেয়ে, বাচ্চার পেটের দিকে কাপড় মোড়ানো (swaddling) অবস্থায় ঘুম এসআইডিএস (SIDS) এর দ্বিগুণ ঝুঁকি বাড়ায়। তাই, শিশু বিশেষজ্ঞ একাডেমী এখন ২ মাসের পর বাচ্চাকে মোড়ানো অবস্থায় ঘুম পদ্ধতিকে বন্ধ করার পরামর্শ দিচ্ছে।
কনজিউমার প্রোডাক্টের সুরক্ষা কমিশনের আট বছর পর্যালোচনার সংগ্রহ তথ্যে, মাত্র ২২টি অজানা কারণে আকস্মিক মৃত্যুর রিপোর্ট করা হয়েছিল যা শিশু সোয়াডলিং (swaddling) এর সাথে সম্পর্কিত; এমন শিশুর মধ্যে প্রায় ৫০% ঘুমের পরিধানযোগ্য কম্বলের মধ্যে ছিল এবং ৯০% পেটের উপর ভর দিয়ে ঘুমানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। হঠাৎ শিশু মৃত্যুর কারণ হিসাবে দুর্ঘটনাজনিত শ্বাসরোধ ও এসআইডিএস (SIDS), সোয়াডল্লিং কে দেখানো হয়। তবে এই আট বছরে, শিশুর সোফা স্লিপিং এর সাথে সম্পর্কিত ১,০২৬ টি মৃত্যুর খবরও সুরক্ষা কমিশনে জানানো হয়।
যদিও সোয়াডলিং কিছু তাত্ত্বিক ঝুঁকির পরিচয় দেয়, তবে হঠাৎ অজানা কারণে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকির বৃদ্ধিতে এর সত্যিকারে কোন প্রমাণ নেই। বরং শিশুদের কান্নাকাটি কমাতে এবং ঘুমকে বাড়িয়ে তোলার জন্য সোয়াডলিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অবিচ্ছিন্ন ঝাঁকুনি, শিশু নির্যাতন, গাড়ী দুর্ঘটনা এবং এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ ঘুমের অভ্যাসগুলি যা ৭০% ঘুমে শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী -এসবের ঝুঁকি কমাতে সোয়াডলিং একটি শক্তিশালী পদ্ধতি।
আমরা চাই, শিশুরা নিরাপদে যেন ঘুমায় তবে আমরা চাই না যে তারা সোয়াডলিং এর জন্য কোন ঝুঁকিতে থাকুক।এই জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য, এমআইটি-প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী এবং প্রখ্যাত শিল্প ডিজাইনার ইয়ভেস বেহারের একটি দল একত্রিত হয়ে এমন এক ধরণের সোয়াডলিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যা শিশুদের নিরাপদে ঘুমাতে ভুমিকা রাখে। হ্যাপিয়েস্ট বেবি কোম্পানি পদ্ধতিটিকে স্নু(Snoo) নামে প্রকাশ করেছিল, যা বিশ্বের প্রথম প্রতিক্রিয়াশীল বেসিনেট। এই সোয়াডলিং পদ্ধতিটি শিশুর কোনও ঝুঁকি ছাড়াই সোয়াডলিং এর উপকারীতাগুলো প্রদান করে।
মিথ ৬: বাচ্চাদের পিঠে ভর দিয়ে ঘুমানো পদ্ধতির মাধ্যমে এসআইডিএস (SIDS) এর সমাধান হয়েছে।
১৯৯৪ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ-এর নেতৃত্বাধীন ব্যাক টু স্লিপ ক্যাম্পেইন ঘুমের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হ্রাস ঘটিয়ে সাড়ে ৫ হাজার থেকে কমিয়ে ৩৫০০-এ নামিয়ে আনে। তবে, গত ১৭ বছর ধরে এ অগ্রগতি পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঠিকই প্রতি বছর ঘুমের মধ্যে ৩,৫০০ শিশু মারা যায়। যদিও অনেক শিশুকে পিঠে ভার দিয়ে ঘুমাতে দেয়া হয়, ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে দুর্ঘটনাজনিত দমবন্ধ এবং শ্বাসরোধে শিশু মৃত্যুর হার চারগুণ বেড়েছে। এর পিছনের কারণ কী?
উত্তর হলো শিশুর অনিরাপদ ঘুমানোর অভ্যাস। ৭৫% অজানা কারণে শিশু মৃত্যুর শিকার হয় প্রাপ্তবয়স্কদের বিছানায়, সোফায় এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে বেশিরভাগ পিতামাতারা নিরাপদ ঘুমের ABC (Alone, On the Back, in a Crib) গুলো অনুসরণ করার সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করেন কিন্তু আসলে অর্ধেকেরও কম এটি অনুসরণ করেন। ক্লিনিকাল ল্যাকটেশন জার্নালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাতের শেষে প্রায় ৬০% বাচ্চা তাদের বেসিনেট থেকে তাদের পিতামাতার বিছানায় চলে যায়।
ব্যাক টু স্লিপ ক্যাম্পেইনের ভয়াবহ, অনিচ্ছাকৃত পরিণতিটি হল এটি শিশুদের ঘুমকে আরও খারাপ করে। বাচ্চারা যখন স্টিলের এবং শান্ত স্ক্রিবে ঘুমায়, শুধু তখনই তারা তাদের পিছনে ভর দিয়ে ভালো ঘুমাতে পারে না । যখন শিশুরা একা ভাল ঘুমাতে পারে না, তখন বাবা-মা তাদের সাথে বিছানা ভাগাভাগি করে, ফলে অনেক শিশুর শ্বাসরোধে মৃত্যু হয়।
পিতামাতারা তাদের শিশুদের পিঠে ভর দিয়ে ঘুমাতে দিক,এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ,তবে পাশাপাশি তাদের সন্তানের ভালো ঘুমের জন্য আরও সরঞ্জাম ব্যবহার করা শুরু করা উচিত। বাচ্চাদের ভালো ঘুমের জন্য কার্যকর তিনটি উপায়: শব্দ, মোড়ানো (Swaddling) এবং দোলনা।
স্নাগ সোয়াডলিং (Snug Swaddling) ভালো ঘুমে ভুমিকা রাখে, তবে উপরে বর্ণিত হিসাবে শিশু বিশেষজ্ঞরা এখন সুপারিশ করেন যে, বাবা-মা ২ মাস বয়সের পর যেন সোয়াডলিং বন্ধ করে। দোলনাও শিশুর ভালো ঘুমের জন্য দুর্দান্ত, তবে আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স সন্ধান পেয়েছে যে, রকার এবং সুইংয়ের মতো সিটিং ডিভাইসগুলিতে ঘুমানো শিশুর মাথাটি সামনে গড়িয়ে যেতে পারে এবং দুর্ঘটনাজনিত শ্বাসরোধ ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
উপরোক্ত সমস্যাগুলির সমাধান হিসেবে ব্যবহার করা হয় স্নু(Snoo) বিছানা। এটি নিরাপদ দোলা, যা সম্পূর্ণ সমতল, তবে বাচ্চাটি এতে গড়াতে পারে না এবং নিরাপদ কিছু শব্দ দেয়। যখন বাচ্চা কান্নাকাটি করে শব্দটি বাড়ে এবং নরম হয় যখন শিশু শান্ত হয়। মায়ের গর্ভের উদ্দীপনার মতো সকল মাত্রাকে সঠিকভাবে সরবরাহ করার জন্য এটি ডিজাইন করা হয় যা শিশুর ঘুম বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত।
প্রায় ২০ বছর ধরে, জনস্বাস্থ্যের শিক্ষামূলক প্রচুর কর্মসূচি সত্ত্বেও আমরা শিশুর ঘুমের মধ্যে মৃত্যুর হারকে হ্রাস করতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে, শিশুর ঘুমের কার্যকারিতা সম্পর্কে সচেতন হলে একদিকে যেমন অনেক বেবি সিনড্রোম এর সমাধান হয়ে যাবে, অন্যদিকে অন্যদেরও শিশুর কান্নার কারণে যেসব সমস্যায় ভোগেন তারও সমাধান হয়ে যাবে।
তাই, শিশু মৃত্যুতে ভূমিকা রাখে এমন কারণগুলো সম্পর্কে নতুন পিতামাতাকে জানিয়ে এবং উপরে উল্লিখিত শিশুর ভালো ঘুমের টিপসগুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করে শিশু স্বাস্থ্যে ভুমিকা রাখার অনুরোধ রইল।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সিএনএন