জীববৈচিত্র্যের এই পৃথিবীতে হরেক রকম কীট-পতঙ্গ, পাখি উড়ে বেড়ায়। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পাখির বংশবৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে শব্দ দূষণ এর কারণে পাখির বংশবৃদ্ধির উপর অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর ফলে অকালেই মারা যাচ্ছে অনেক পাখি।
সম্প্রতি গবেষণায় পাওয়া গেছে, শব্দ দূষণ এর কারণে পাখির বংশবৃদ্ধির হার কমে যায়। এই প্রভাব ডিমের ভিতরে ভ্রূণ অবস্থায় অথবা ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার পর উভয় অবস্থায় হতে পারে। শব্দ দূষণ এর ক্ষতিকর প্রভাব পাখির বেড়ে উঠা, স্বাস্থ্য ও প্রজননের উপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার সহ লেখক এবং অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মেরিন মাইলেট বলেন,
“পাখির বিকাশে শব্দের অনেক শক্তিশালী এবং সরাসরি প্রভাব রয়েছে যা আমরা আগে থেকে জানতাম। তবে আমরা সত্যি বিস্মিত, কারণ এই প্রভাব শুধু শক্তিশালী নয় বরং অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়।”
আগে গবেষকরা শুধু জানতেন, শব্দ দূষণ পাখিদের বেড়ে উঠার জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে মা পাখিদের বাচ্চার যত্ন নিতে এবং যোগাযোগ রক্ষা করতে কষ্ট হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না যে, শব্দ দূষণ সরাসরি পাখির ছানাদের ক্ষতি করে কিনা!
এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য মেরিন মাইলেট ও তাঁর দল জেব্রা ফিঞ্চ পাখির ডিমের উপর একটি পরীক্ষা করে। তাঁরা ডিমগুলোকে দুভাগ করে টানা পাঁচদিন একভাগকে নীরবতার মধ্যে রাখেন এবং অন্যভাগকে শব্দ দূষণময় পরিবেশে রাখেন। দূষণময় পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা শহরের যানজটের শব্দ, পাখির কলকলানি ইত্যাদির রেকর্ড বাজাতেন।
পরবর্তীতে ভ্রূণ থেকে অঙ্কুরিত হওয়ার পর আবার টানা নয়দিন এই পরিস্থিতি বজায় রাখেন। মা পাখিদের কোনো ক্ষতি না হওয়ার জন্য তাঁরা শুধু মাত্র ছানাগুলোকে আলাদা করে কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রেকর্ড শুনানোর জন্য নিয়ে যেতেন।
তাঁরা এই পরীক্ষার মাধ্যমে লক্ষ্য করেন, যে-সব ডিম শব্দ দূষণ এর মধ্যে থাকে, তাদের ডিম অঙ্কুরিত হওয়ার হার প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায়। এছাড়াও ওই ডিম থেকে যে-সব বাচ্চা ফোটে তারা অন্যান্য সাধারণ বাচ্চা থেকে প্রায় ১০ শতাংশ ছোট এবং ১৫ শতাংশ হালকা।
তাঁরা আরো আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করেন, এসব বাচ্চার লোহিত রক্ত কণিকার ঘনত্ব কম এবং ক্রোমোজোমের টিপস বা ডিএনএ এর ছোট অংশ ক্ষতিগ্রস্ত। যা কোষীয় চাপের একটি ইঙ্গিত বহন করে।
ছানাগুলো আর শব্দ দূষণ এর সংস্পর্শে না থাকার পরেও চার বছর পরে তাদের প্রজনন বয়সে উপনীত হয়েও এই প্রভাবগুলো অব্যাহত ছিল। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে শব্দ দ্বারা বিরক্ত পাখিরা তাদের সমবয়সীদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম সন্তান উৎপাদন করে।
মেরিয়েট বলেন,
“আমরা ওই পাখির ডিমগুলোকে দিনে প্রায় চার ঘণ্টার জন্য শব্দের সংস্পর্শে রেখেছিলাম কিন্তু এর প্রভাব এতই শক্তিশালী এটা দেখে আমরা অবাক।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী শ্রবণ বিশেষজ্ঞ রবার্ট ডুলিং বলেন,
“অসংখ্য গবেষণার ভিত্তিতে আমরা সাধারণত অনুমান করি যে খুব অল্পবয়সী পাখি, বিশেষ করে ডিমে; শব্দের প্রতি খুব কম বা কোন সংবেদনশীলতা নেই। কিন্তু এই গবেষণাটি আমাদেরকে শব্দ দূষণ এর বিশাল ও স্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ভীত করেছে।”
নেদারল্যান্ডসের লেইডেন ইউনিভার্সিটির ‘Acoustic Ecology and Behaviour’ এর অধ্যাপক হ্যান্স স্লাবেকোর্ন জানায়,
“আমি আসলেই এরকম বড় প্রভাব আশা করিনি। এই ক্ষতিকর প্রভাবের ক্রমবর্ধমান প্রকৃতি দিনশেষে আরো সমস্যার সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে যখন পাখিরা বিমানবন্দর বা ব্যস্ত সড়কের মত দূষিত এলাকার পাশে বসবাস করবে।”
ঠিক কি পরিমাণ বা কীভাবে শব্দ দূষণ পাখির ছানাদের ক্ষতি করে তা একটি রহস্য। মস্তিষ্কের শ্রবণ অংশগুলো বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সাথে সংযোগ স্থাপন করে যেমন: হরমোন নিয়ন্ত্রণ, আবেগ ও শেখা নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল। তবে এটি যুক্তিসংগত যে শব্দ দূষিত পরিবেশ স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে।
কাব্য বিশ্বাস / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সায়েন্স.অর্গ, সায়েন্স নিউজ