আমাদের প্রত্যেককেই কখনও না কখনো, একবার হলেও, বিশেষ করে ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে লালা পরে বালিশ ভিজে যাওয়ার মত বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিষয়টি বিব্রতকর হলেও অনেকেই এটিকে ছোট বাচ্চাদের স্বভাব বলে আমলে নেন না, বরং হেলায় উড়িয়ে দেন। আসলেই কি লালা পরা নিয়ে ভাবনার মতো কিছুই নেই?! চলুন চিকিৎসাশাস্ত্র এ ব্যাপারে কি বলে জেনে নেওয়া যাক- ঘুমের মধ্যে কেন লালা পরে? এটা কি কোন রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে?
ড্রুলিং বা লালা পরা কি?
লালা হল একধরণের তরল বস্তু যা প্রাণীর মুখের লালা গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হয়। আমাদের ৩ জোড়া লালাগ্রন্থি থেকে দৈনিক ১-১.৫ লিটার পর্যন্ত লালা ক্ষরিত হয় এবং এতে টায়ালিন ও মল্টেজ নামক শর্করা বিশ্লেষী এনজাইম থাকে। জেগে থাকা অবস্থায় আমরা লালা পরতে দেই না, সাধারণত তা গিলে ফেলি। ঘুমে বিভোর থাকা অবস্থায় মুখের পেশীগুলো শিথিল থাকার কারণে এই গিলে ফেলা সম্ভব হয় না। এর ফলে মুখে জমে থাকা লালা অনেক সময় ঠোঁটের কোণের বাইরে ঝরে পরে। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এই ঘটনাকে ড্রুলিং বলে।
ড্রুলিং বা লালা ঝরা কি কোন রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে?
ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ড্রুলিং একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ সাধারণত ১৮-২৪ মাস না হওয়া পর্যন্ত শিশুরা ভালভাবে গিলতে ও মুখের পেশীগুলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে উঠতে পারেনা। ঘুমের সময়েও পেশীগুলো শিথিল অবস্থায় থাকে, তাই ঘুমের মধ্যে ড্রুলিং হওয়া স্বাভাবিক।
তাছাড়া বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা লালা পরা-র কারণ হতে পারে। স্ট্রোক বা সেরিব্রাল পালসি সহ একাধিক স্ক্লেরোসিস (এম এস) এর কারণে লালা পরতে পারে।
ড্রুলিং বা লালা ঝরার কারণ কি?
ড্রুলিং অসুস্থতাজনিত কারণে হতে পারে অথবা পেশীর অপূর্ণ গঠন বা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ সেবনের ফলে হতে পারে। অতিরিক্ত লালা উৎপাদন, গিলতে অসুবিধা বা পেশী নিয়ন্ত্রণে সমস্যা ড্রুলিং-এর পূর্বশর্ত।
- সর্দি বা সংক্রমণজনিত কারণে নাক বন্ধ অবস্থায় থাকলে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার কারণে লালা পরতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে ঘুমানোর সময় শ্বাস নেওয়ার জন্য যখন আপনি মুখ খুলে ঘুমাবেন; তখন লালা জমে তা বাইরে বেরিয়ে আসবে।
- উচ্চ অ্যাসিডিক উপাদানযুক্ত খাবার প্রায়ই অতিরিক্ত লালা উৎপাদনের কারণ হয়।
- গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রিফ্লেক্স ডিসঅর্ডার (জিইআরডি) এর কারণেও মুখ থেকে লালা পরতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো কিছু গিলতে অসুবিধা হয়। এ সমস্যায় যারা ভুগছেন; তাদের মুখ দিয়েও লালা ঝরতে পারে।
- কিছু ওষুধের কারণেও এমনটি ঘটতে পারে। অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ (বিশেষত ক্লোজাপাইন) এবং আলঝাইমারস চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধসহ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের কারণে ঘুমের মধ্যে অতিরিক্ত লালা ঝরতে পারে।
- এমএস, পারকিনসন ডিজিজ, মাসকুলার ডিসস্ট্রফি এবং এমনকি কিছু ধরণের ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও এ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের থুতু গিলতে অসুবিধা হয়।
- স্নায়ুজনিত বিভিন্ন ঝুঁকির কারণে মুখ দিয়ে লালা পরে থাকে। যারা নিদ্রাহীনতার সমস্যায় ভুগছেন; তাদের ক্ষেত্রেও এ সমস্যাটি নিয়মিত দেখা দিতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট, জ্বর, অ্যালার্জি বা সাইনাস সংক্রমণের কারণে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এসময় নাক বন্ধ থাকার কারণে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রেও মুখ দিয়ে লালা ঝরতে পারে।
- যদি মাউথ আলসার থাকে, সেক্ষেত্রেও মুখে থুতু বেড়ে যায়। এ কারণেও লালা ঝরতে পারে। এ সময় প্রতিরোধক ওষুধ খেলে সমস্যা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
ড্রুলিং বা লালা ঝরার চিকিৎসা কিভাবে করা হয়?
ড্রুলিং সবসময় চিকিৎসা করা হয় না। ডাক্তাররা সাধারণত ৪ বছরের কম বয়সী বা যাদের ঘুমের মধ্যে ড্রুলিং হয় তাদের কোন চিকিৎসার পরামর্শ দেন না। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসার সুপারিশ করা যেতে পারে। অত্যধিক ড্রুলিং এর জন্য ফুসফুসে লালা গিয়ে নিউমোনিয়া পর্যন্ত হতে পারে ।
চিকিৎসা কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে দেখা হয়, আপনার ডাক্তার এটি মূল্যায়ন করবেন এবং আপনার জন্য সবচেয়ে ভাল কাজ করে এমন পন্থা খুঁজে বের করবেন। নন-ইনভেসিভ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ওষুধ এবং ওরাল মোটর থেরাপি। আরও গুরুতর ক্ষেত্রে, আপনি এবং আপনার ডাক্তার ইনভেসিভ পদ্ধতির কথা বিবেচনা করতে পারেন, যার মধ্যে সার্জারি এবং রেডিওথেরাপির মতো চিকিৎসার বিকল্প রয়েছে।
১. ঘুমের অবস্থান
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঘুমের ভুল অবস্থানের কারণে মুখ দিয়ে লালা ঝরে থাকে। তাই প্রথমত, ঘুমের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। পেটে নয় বরং পিঠে ভর দিয়ে ঘুমান। তাহলে মুখে লালা জমতে পারবে না।
২. ঘরোয়া প্রতিকার
আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, লালা শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকের মতে, সাইট্রাসজাতীয় ফল খেলে লালা ঝরার সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। পাশাপাশি প্রচুর পানি পান করতে হবে। এতে শরীর হাইড্রেট থাকবে এবং লালা ঝরার সমস্যাও কমবে।
৩. ম্যান্ডিবুলার ডিভাইস
ম্যান্ডিবুলার ডিভাইস এমন একটি সরঞ্জাম, যা মুখে ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি আরামের সঙ্গে ঘুমাতেও পারবেন আর মুখ থেকে লালাও পরবে না।
৪. সিপিএপি মেশিন
ঘুমের মধ্যে যারা শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন, তারা এই মেশিন ব্যবহার করতে পারেন। স্লিপ অ্যাপনিয়ার সর্বাধিক প্রস্তাবিত চিকিৎসা হলো সিপিএপি মেশিন।
৫. সার্জারি
যাদের মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা পরে; তাদের ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে লালা গ্রন্থিগুলো অপসারণের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্নায়বিক সমস্যা থাকে। এ কারণেই ঘুমের মধ্যে তাদের অত্যধিক লালা ঝরে থাকে।
৬. বোটক্স ইনজেকশন
বোটক্স ইনজেকশনগুলি মুখের পেশীগুলিকে শক্ত করে লালা পরা-র প্রবণতা কমাতে সাহায্য করে।
৭. থেরাপি
স্পিচ এবং অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা ঠোঁট বন্ধ এবং গিলতে উন্নতি করতে পজিশনিং এবং ভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ শেখান। আপনার থেরাপিস্ট পেশীর স্বর এবং লালা নিয়ন্ত্রণের উন্নতিতে আপনার সাথে কাজ করবেন।
থেরাপিস্টরাও পরামর্শ দিতে পারেন যে আপনি আপনার ডায়েটে অ্যাসিডিক খাবারের পরিমাণ পরিবর্তন করার জন্য একজন ডায়েটিশিয়ানকে দেখতে পারেন।
৮. ওষুধ
কিছু ওষুধ লালা উৎপাদন কমাতে সাহায্য করে। তবে অনেক সময়ে এসব ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে, যেমনঃ মুখের ভেতরে শুকিয়ে যাওয়া।
৯. ঘুমানোর আগে যা মানবেন
ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে মিষ্টি জাতীয় কোনো খাবার কিংবা পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকুন। আর ঘুমানোর ১০-১৫ মিনিট আগে একটু টক কিংবা লবণ মিশ্রিত পানি পান করুন।
সর্বোপরি, ড্রুলিং বা লালা ঝরা সহজেই থেরাপি বা ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে সেটা আপনার চিকিৎসক ঠিক করবেন, কোনটি আপনার জন্য অধিক ফলপ্রসূ হবে।
মোঃ গালীব হাসান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ হেলথলাইন । ড্রুলিং; হেলথলাইন। লালা ঝরা থামানোর উপায়