একটি ড্রোন টমেটো বাগানের উপর ঘুরছে এবং ইওয়ান্টেং চাও স্মার্টফোনের সাহায্যে এটি নিয়ন্ত্রন করছে। ড্রোনটির সাথে কৃত্রিম গান মেশিন সংযুক্ত অবস্থায় আছে যার ভিতরে অনেকগুলো ছোট ছোট সূচঁ আছে। চাও ফোনের সাহায্যে পরিচালনা করে মেশিনটিকে এবং তার আদেশেই সূচঁগুলো ড্রোন থেকে এসে টমেটো গাছের কান্ডে বিদ্ধ হয়ে বিলীন হয়ে যায়।
চাও হাসলেন। তিনি মূলত টমেটো গাছের কান্ডে সূচঁটি বিদ্ধ করার চেষ্টা করতে করতে এক সপ্তাহ অতিবাহিত করেছেন। তিনি বলেন, “বেশির ভাগ সময়ই আমি এটি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।”
চাও ক্যামব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এম আই টি-র একজন প্রকৌশলী যিনি বায়োমেটেরিয়াল নিয়ে কাজ করছেন। ড্রোনে ছিল এক ধরনের সূচঁ যা তার দল উদ্ভিদের মধ্যে ওষুধ প্রয়োগ করার জন্য ডিজাইন করেছে। এটি ছিলো তার পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন।
মানুষের মতো গাছপালাও অসুস্থ হয়। কোভিড-১৯ যেমন মানুষকে অসুস্থ করে ফেলছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে তেমনি গাছপালার রোগের মহামারীও অন্যান্য ফসলের ঝোপ এবং কলা, কমলা ইত্যাদির গোটা বন উজাড় করে ফেলে। মূলত গাছের রোগের চিকিৎসার জন্য কৃষকরা বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করে।
যেসব রোগের জীবানু উদ্ভিদের মাঝে বিস্তার করে সেসব জীবানুকে কিছু কেমিক্যাল স্প্রে টার্গেট করে ধ্বংস করে ফেলে। আবার কিছু স্প্রে সেইসব জীবানু বহনকারী পোকাকে ধ্বংস করে। চাও উল্লেখ করেন, “প্রায় ৫ শতাংশেরও কম কেমিক্যাল উদ্ভিদের অভ্যন্তরে যায়।” এছাড়া বাকি কেমিক্যাল গুলো চারপাশের মাটি এবং জলে মিশে যায়।
বেনেডেটো ম্যারেলি, এম আই টি-র একজন প্রকৌশলী ও চাও এর টিমমেট, বলেন, “এটি পরিবেশ বা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়।” তবে স্প্রে কখনো কখনো কিছু রোগ নিরাময় করতে পারে না কারন ওষুধ কখনোই গাছের সঠিক অংশগুলো তে পৌছাতে পারে না।
গাছে ওষুধ প্রয়োগ করার জন্য কৃষকদের আরও সুনির্দিষ্ট উপায়ের প্রয়োজন। ম্যারেলি এবং চাও আশা করেন যে তাদের উদ্ভাবিত সিস্টেমটি হয়তো ঠিকভাবে কাজ করবে। তারা এটির নাম দিয়েছেন “ফাইটোইঞ্জেক্টর”।
রেশমের মতোই তীক্ষ্ণ
ফাইটোইঞ্জেক্টর একটু ভিন্ন ধরনের। এটি খুব ভিন্নভাবে উদ্ভিদের মাঝে ওষুধ সরবরাহ করে। এটি বিশেষভাবে নির্মিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূচঁ যা উদ্ভিদের কান্ড ছিদ্র করে গেঁথে যাওয়ার মাধ্যমে ওষুধ ছড়িয়ে দেয়।
চিকিৎসা প্রকৌশলীরা ইতোমধ্যে মানুষের জন্যও এইরকম সূচঁ তৈরি করেছেন যা ব্যথামুক্ত এবং সহজেই ব্যবহারযোগ্য। ব্যান্ডেজ যেমন ত্বকের সাথে লেগে থাকে তেমনি এগুলোও একজন ব্যক্তি ত্বকের সাথে লাগিয়ে রাখতে পারবে।
চাও এবং ম্যারেলি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এগুলো যদি মানুষের জন্য কাজ করে তবে গাছের জন্য কেন নয়?
তারা এই সূচঁগুলো সিল্ক দিয়ে তৈরি করেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বেশির ভাগ সিল্কই নরম কাপড়। তবে উপাদানটি মেডিক্যাল ইমপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ম্যারেলি বলেন, “সিল্কের সূচঁগুলো প্লাস্টিকের মতো দেখতে”। তবে প্লাস্টিকের মতো হলেও জীবন্ত দেহের ক্ষেত্রে এটি অনুকূল।
এম আই টি টিম খুব তাড়াতাড়ি সমস্যায় পড়েছিল কারন এই রকম সিল্কের তৈরি ক্ষুদ্র সূঁচগুলো মানুষের ক্ষেত্রে কাজ করলেও গাছগুলিতে কাজ করে না এবং সূঁচগুলো ঠিকভাবে বিলীন হয় না। ঠিকভাবে বিলীন করার জন্য এটির আরও পানির অনু দরকার ছিল। এটি তৈরি করাতে চাও এর দলকে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
বিভিন্ন আকৃতির ফাইটোইনজেক্টর বিভিন্ন ধরনের গাছের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। তারা পরীক্ষা করেছিলেন ওষুধগুলো প্রতিটি গাছের মধ্যে কতটুকু কার্যকরী এবং ওষুধগুলো শিকড় বা পাতাগুলোতে ঠিকমতো পৌছাতে পারছে কিনা। এই পরীক্ষাগুলোতে দেখা যায় যে ছোট সূঁচগুলো বেশ কার্যকরী।
উচ্চ-প্রযুক্তি চাষ
এই প্রাথমিক পরীক্ষাগুলোতে গবেষকরা ট্যুইজার বা তাদের হাত দিয়ে সূচঁগুলো প্রয়োগ করতেন গাছের উপর। তবে বিশাল জায়গার ক্ষেত্রে এই সূচঁগুলো প্রয়োগ করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু ড্রোনের সাহায্যে এটা তুলনামূলক সহজে সম্ভব।
এরপরেও কিছু সমস্যা আছে। চাও বলেন তার লক্ষ্যে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন ছিল। প্রকৃত খামারে ড্রোনগুলো বাতাস, বৃষ্টিপাত এবং অন্যান্য কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। ছোট সূচঁ দিয়ে কাণ্ডগুলোর অনুসন্ধান এবং ছিদ্র করা স্পষ্টভাবেই একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।
যদিও ফাইটোইঞ্জেক্টর অন্যান্য ক্ষেত্রেও কাজ করে। মূল্যবান গাছগুলোর জন্য কৃষকেরা হাত দ্বারাও সূচঁ গুলো প্রয়োগ করার জন্য রাজি। এমনকি সূচঁগুলো প্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহারযোগ্য। এগুলো উদ্ভিদের জিনকে সংশোধন করতে পারে। এই ধরনের পরিবর্তন গাছগুলোকে আরও উৎপাদনশীল এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সক্ষম করে তুলতে পারে।
কিংসন ওয়ে নামক একজন বায়োইঞ্জিনিয়ার আছেন যিনি এই গবেষণায় অংশ নেন নি তবে তিনিও এই ধারণার সাথে পরিচিত। তিনি নর্থক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত। তার দলও উদ্ভিদের জন্য মাইক্রোনিডল/ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই সূচঁগুলো তৈরির কাজ করছে।
ওয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন কারন এম আই টি টিম এর মাধ্যমে ওষুধ সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং সেগুলো শুধু কান্ডে নয় বরং বিস্তৃতভাবে উদ্ভিদের সব অংশে কাজ করতে সক্ষম ছিলো। এই সিল্ক মাইক্রোনিডলগুলোর অনেক রকম ব্যবহারযোগ্যতা আছে।
একটি গাছের যে পরিবহন অংশগুলো পুষ্টি গ্রহণ করে সেই অংশগুলো খুব সূক্ষ্ম। তিনি আরও বলেন, “যদি কোনো সূচঁ সেটির নিশানা হারিয়ে ফেলে তবে সেই সূচঁটি আর কাজ করবে না।” এছাড়াও, এম আই টি টিম কেবলমাত্র সাইট্রাস(লেবু), টমেটো এবং তামাক উদ্ভিদের মধ্যে পরীক্ষা করেছে। ওয়েই আশা করেন এই কৌশলটি অন্য ক্ষেত্রেও কাজ করবে।
ম্যারেলি জানিয়েছেন তাদের এই সিস্টেমটি আরও উন্নত করতে হবে। তিনি বলেন, “বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কেবল মানুষের জন্য নয়, উদ্ভিদেরও প্রযুক্তির অনেক প্রয়োজন আছে।”
শামসুন নাহার প্রিয়া/ নিজস্ব প্রতিবেদক