রাতে ঘুম থেকে উঠে ঘন ঘন প্রস্রাব করতে যাওয়ার ঠেলায় ঘুমের বারোটা বাজছে, শুতে যাবার পর বারবার প্রস্রাবের বেগ বা তাড়না অনুভব করছেন। ভাবছেন ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন না তো! পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবের কারণে সারাদিন থাকছেন ক্লান্ত। অল্পেই রিয়েক্ট করছেন বা রেগে যাচ্ছেন কথায় কথায়।
যদিও, চা, কফি, অ্যালকোহল বেশি খেলেও রাতে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়তে পারে। তাছাড়া বডি ক্লক পরিবর্তন হলেও এই ধরণের সমস্যা দেখা যায়। এটা Nocturia-র অন্যতম প্রধান কারণ।
অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন Nocturia আবার কী?
আমরা সবাই জানি রক্তের পরিস্রাবণের মাধ্যমে বৃক্কে মূত্র তৈরি হয়। একজন সুস্থ মানুষের বৃক্কে দৈনিক 800-2000 মিলিলিটার মূত্র উৎপন্ন হয়। পানি গ্রহণের পরিমাণ এবং বৃক্কের কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে এই পরিমাণের তারতম্য ঘটতে পারে। ঘুমের সময় যাতে বারবার ঘুম থেকে উঠে প্রস্রাব করতে যেতে না হয়, সেজন্য আমাদের শরীর ঐ সময় কম প্রস্রাব তৈরি করে যা সাধারণত অপেক্ষাকৃত ঘন হয়। এর ফলে আমরা অনায়াসেই 6 থেকে 8 ঘন্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘুমাতে পারি। কিন্তু প্রতি রাতে যদি আপনাকে দুই বা ততোধিক বার প্রস্রাব করার জন্য ঘুম থেকে উঠতে হয়, তাহলে আপনার Nocturia হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।
Nocturia or Nocturnal Polyuria কি?
চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘নকচুরিয়া’ (Nocturia or Nocturnal Polyuria) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে আপনাকে রাতে বারবার ঘুম থেকে উঠে প্রস্রাব করতে যেতে হয়। নকচুরিয়া যে কেবল আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোতেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, এটি হতে পারে রেচনতন্ত্রের কোনো রোগের পূর্বাভাস ও। চল্লিশের কোঠায় অনেক পুরুষই এই সমস্যার সম্মুখীন হন। পঞ্চাশের পর থেকে এই সমস্যা আরও বাড়ে।
যে সমস্ত কারণে Nocturia হয়ে থাকে
লাইফস্টাইলের ধরণ থেকে শুরু করে কোনো নির্দিষ্ট ওষুদের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কিংবা অন্য কোনো রোগ বিভিন্ন কারণে নকচুরিয়া হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নকচুরিয়া বেশি দেখা যায়, তবে এটি যেকোনো বয়সেই ঘটতে পারে। নিচে নকচুরিয়ার কারণগুলো তুলে ধরা হলো –
-
চিকিৎসাবিদ্যা শর্ত
নকচুরিয়ার সাধারণ কারণ হল মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI) বা মূত্রাশয় সংক্রমণ। এর ফলে সারা দিন এবং রাতে ঘন ঘন জ্বলন্ত সংবেদন এবং বারবার প্রস্রাবের তাড়না অনুভূত হতে পারে। চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন। অন্যান্য কি কি রোগের কারণে নকচুরিয়া হয়ে থাকে:
-
প্রোস্টেটের সংক্রমণ বা বৃদ্ধি
-
মূত্রাশয় প্রল্যাপস
-
অতি সক্রিয় মূত্রাশয় (Overactive Bladder-OAB)
-
মূত্রাশয়, প্রোস্টেট বা পেলভিক এলাকার টিউমার
-
উদ্বেগ
-
কিডনি সংক্রমণ
-
শোথ বা নীচের পায়ে ফুলে যাওয়া
-
স্নায়বিক ব্যাধি, যেমন মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, পারকিনসন্স ডিজিজ বা মেরুদন্ডের কম্প্রেশন
হার্ট বা লিভারের ফেইলিউরের মতো অঙ্গ ব্যর্থতায় (অর্গান ফেইলিউর) আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও নকচুরিয়া (Nocturia) সাধারণ।
-
গর্ভাবস্থা
নকচুরিয়া গর্ভাবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। এটি গর্ভাবস্থার শুরুতে বা পরবর্তীতেও বিকশিত হতে পারে। কারণ হিসেবে মনে করা হয় ক্রমবর্ধমান গর্ভাশয় কর্তৃক মূত্রাশয়ের উপর চাপ।
-
ওষুধ
কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে নকচুরিয়া হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার কিছু ওষুধের জন্য এমনটি হতে পারে। অ্যান্টি সাইকিয়াট্রিক ড্রাগ বা কিডনির ওষুধ খেলেও প্রস্রাব বেশি পায়।
-
জীবনধারার পছন্দ
নকচুরিয়ার আরেকটি সাধারণ কারণ হল অত্যধিক তরল গ্রহণ। চা, কফি কিংবা অ্যালকোহল বেশি খেলেও রাতে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়তে পারে। কর্মসূত্রে অনেককেই রাত জেগে কাজ করতে হয়। বডি ক্লক পরিবর্তন হলেও নকচুরিয়ার মতো সমস্যা দেখা যায়।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
কত ঘন ঘন প্রস্রাব করেন? কী পান করেন এবং কতটা পান করেন তা রেকর্ড করার জন্য কয়েক দিনের জন্য একটি ডায়েরি মেনে চলতে পারেন। এতে নকচুরিয়া নিশ্চিত করতে ডাক্তারের সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর আগে থেকে আপনার কাছে থাকবে। তাছাড়া আপনার অবস্থা বিবেচনা করে ডাক্তার আপনাকে কিছু টেস্ট করার পরামর্শ দিতে পারে।
যেমন:
-
ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার জন্য রক্তে শর্করার পরীক্ষা
-
রক্তের গণনা এবং রক্তের রসায়নের জন্য অন্যান্য রক্ত পরীক্ষা
-
প্রস্রাব বিশ্লেষণ
-
ইমেজিং পরীক্ষা, যেমন আল্ট্রাসাউন্ড বা সিটি স্ক্যান
-
ইউরোলজিক্যাল পরীক্ষা, যেমন সিস্টোস্কোপি
প্রতিকার
নকচুরিয়ার চিকিৎসা দুইভাবে করা যেতে পারে। যথা:
১. লাইফ স্টাইলের ধরনের পরিবর্তন আনার মাধ্যমে
২. মেডিসিন বা চিকিৎসার মাধ্যমে।
এক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসক আপনার শারীরিক অবস্থা অনুসারে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে আপনার জন্য ভালো হবে সেটি নির্ধারণ করবেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করবেন। যেহেতু, নকচুরিয়া ডায়াবেটিস, মূত্রনালীর সংক্রমণ এর মত রোগের সাথে সম্পর্কিত তাই লক্ষণ প্রকাশ হবার সাথে সাথে দ্রুত কোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন।
Nocturia -র আশঙ্কা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে
-
ঘুমাতে যাওয়ার 2 থেকে 4 ঘণ্টা আগে তৃষ্ণা অনুযায়ী (অতিরিক্ত পানি পান না করা) পানি পান করা।
-
অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলা।
-
যে সমস্ত ওষুধ সেবনের ফলে নকচুরিয়া প্রবণতা বেড়ে যায় ঐ সমস্ত ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রাতের পরিবর্তে দিনে খাওয়া যেতে পারে।
-
আপনি ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রস্রাব করতে পারেন।
যেহেতু নকচুরিয়া আপনার ঘুমের চক্রকে প্রভাবিত করে, তাই যথাসময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করলে এটি স্লিপ ডিপ্রাইভেশন, ক্লান্তি, বদ মেজাজের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ মোঃ গালীব হাসান
তথ্যসুত্রঃ Healthline, Verywell Mind