১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরনার্থী শিবিরগুলোতে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়লে এর একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে ইন্ট্রাভেনাস (শিরায় স্যালাইন) ব্যবহার করা হলেও তা ছিলো খুব স্বল্প পরিমানে। তখনও এই আবিষ্কৃত খাবার স্যালাইন ব্যবহার করে ৩৭০০ অসুস্থ রোগীর মধ্যে ৯৬ শতাংশ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠেছিলো। যার অবদানে প্রাণ বাঁচলো এই এতগুলো মানুষের, আমরা কি তার অর্থাৎ এই খাবার স্যালাইন এর আবিষ্কারকের কথা জানি? তিনি হলেন ড. রফিকুল ইসলাম, যার আবিষ্কৃত স্যালাইন-এর সাহায্যে প্রতিদিন ডিহাইড্রেশন সম্পর্কিত রোগগুলো থেকে আরোগ্য লাভ করছেন হাজার হাজার মানুষ।
১৯ শতকের সবচেয়ে বড় একটি ভয়াবহ রোগের নাম ডায়রিয়া। তবে বর্তমানে কোন ব্যক্তির ডায়রিয়া হলেই সর্বপ্রথম চিকিৎসা হিসেবে স্যালাইন গ্রহন করে থাকে যা আমাদের আশে পাশে যেকোনো দোকানে পাওয়া যায়। আর না পাওয়া গেলেও আমরা হাফ লিটার পানির মধ্যে এক মুঠো গুড় বা চিনি ও এক চিমটি লবণ দিয়ে সহজেই বাড়িতেই স্যালাইন বানিয়ে নিতে পারি।
ড. রফিকুল ইসলাম ১৯৩৬ সালে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পর আইসিডিআরবি তে যোগদান করেন এবং ২০০০ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যান। এছাড়াও তিনি ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং হাইজিন বিষয়ে ইংল্যান্ড থেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন।
ড. রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশী চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী। তিনি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ (আইসিডিডিআরবি) বাংলাদেশ-এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন ঔষধ নিয়ে গবেষণা করেন। ড. রফিকুল ইসলাম-এর ওষুধগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল খাবার স্যালাইন (ওরস্যালাইন)।
তবে এই খাবার স্যালাইন নিয়ে গবেষণা শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। আইসিডিডিআরবি থেকে সংগ্রহ করা কাগজপত্রে দেখা যায় ১৯৬৪ সালে ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল মেডিকেল রিসার্চ ইউনিট গ্লুকোজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও বাই কার্বোনেট ব্যবহার করে কলেরা রোগীর ওপর একটি গবেষণা করে। যদিও তার ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।
আবার ১৯৬৭ সালের গবেষণায় কিছু ত্রুটি থাকায় তখনকার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয় নি। এরপর বিজ্ঞানী ডেভিড নেলিন ও রিচার্ড এ ক্যাস ঢাকায় এই স্যালাইন বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং সেখানে রিসার্চ ফেলো হিসেবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশী রফিকুল ইসলাম ও মজিদ মোল্লা। সেই গবেষণার ফলাফলাই ১৯৬৮ সালের ল্যানসেটে এ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, গ্লুকোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম বাই কার্বোনেট ও পটাশিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণের ফলে এই ডায়রিয়া রোগে সুফল পাওয়া যায়। যা পরবর্তীতে মহাখালীর কলেরা হাসপাতাল এবং ১৯৭১ শরণার্থীশিবিরে ওআরএস ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গিয়েছিলো।
তার আবিষ্কৃত এই খাবার স্যালাইন ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতি দেয়া হয়। এছাড়াও বাড়িতে কিভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করতে হয় তা শিখাতে ব্রাক প্রতিষ্ঠানটি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাছাড়া, এই খাবার স্যালাইন এর ব্যাপক প্রচারণার ফলে “ঢাকা স্যালাইন” নামেও পরিচিত লাভ করে। তার এই আবিষ্কার ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যান্সেট “বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন ইউনিসেফ এর সাহায্যে বর্তমানে প্রায় প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন এরও বেশি ওরস্যালাইন এর প্যাকেট উৎপদান হয়ে থাকে।
কোটি মানুষের জীবন বাঁচানো এই খাবার স্যালাইন এর উদ্ভাবক ৬ ই মার্চ ২০১৮ সালে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
তার ব্যাপরে আইসিডিডিআর এর একজন প্রাক্তন বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াহেদ বলেন যে “ড. রফিকুল ইসলাম খুবই ইন্ট্রোভার্ট এবং তার গবেষণার ব্যাপারে অনেক আগ্রহী ছিলেন।”
আল আমিন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ ডেইলি স্টার, ইউনিসেফ, প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া