মলাস্কা পর্বের প্রাণিদের একটি বিশেষ শ্রেণি Cephalopod – সেফালোপড। প্রায়শই মনে করা হয় যে সেফালোপডেরা ভিনগ্রহী প্রাণিদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এরকম ধারণার কারণ এদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা। সম্প্রতি সিটি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এর গবেষকরা সেফালোপড এর একটি সদস্য ক্যাটলফিশের ছদ্মবেশ ধারণের ব্যাপারে নতুন একটি সমীক্ষা প্রদান করেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ দৈহিক বৈশিষ্ট্য, কালি উৎপাদন ক্ষমতা এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সজ্জিত, রং পরিবর্তনকারী প্রাণী ক্যাটলফিশ প্রতিনিয়তই আমাদের অবাক করে দেয়।
ক্যাটলফিশ কী রকম:
নামের সাথে মাছ (Fish) কথাটি থাকলেও ক্যাটলফিশ মোটেও মাছ নয়। ক্যাটলফিশের দেহে একটি পুরু অভ্যন্তরীণ খোলস থাকে যা ক্যাটলবোন (Cuttlebone) নামে পরিচিত এবং স্পষ্টতই নামটি সেখান থেকে এসেছে। মলাস্কা পর্বের সেফালোপোডা শ্রেণির অর্ন্তগত ইউরোপীয় ক্যাটলফিশ বা Common Cuttlefish (Sepia officinalis) হলো সর্বাধিক পরিচিত এবং অন্যতম বৃহত্তম ক্যাটলফিশ প্রজাতি। প্রাণিটি মায়োসিন যুগে (প্রায় ২১ মিলিয়ন বছর আগে) বিবর্তিত হয়েছিল। ধারনা করা হয়, একটি বিলুপ্তপ্রায় সেফালোপড বর্গ যা বেলেমনিডা নামে পরিচিত তারা এর পূর্বপুরুষ। এদের শরীরের আকারের তুলনায় বেশ বড় মস্তিষ্ক ও তিনটি হৃদপিণ্ড রয়েছে এবং এদের রক্তের রং নীলাভ-সবুজ। ক্যাটলফিশ গুলো তাদের অন্য সেফালোপড আত্মীয়; যেমন অক্টোপাস এবং স্কুইডের মতো ছদ্মবেশ ধারণে পারদর্শী।
ছদ্মবেশ ধারণের কৌশল:
নিজেকে লুকোনোর জন্য এই রং পরিবর্তনকারী প্রাণী গুলো ক্রেমাটোফোর নামক বিশেষ ধরণের রঞ্জক কোষ ব্যবহার করে যা এদের ত্বকের নিচে পাওয়া যায়। যখন ক্যাটলফিশ তার পেশিগুলিকে নমনীয় করে, তখন রঞ্জকটি আশেপাশের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য বাইরের ত্বকে নির্গত হয়ে দেহের রং পরিবর্তন করে। তবে রং পরিবর্তন শুধু ছদ্মবেশ ধারণের জন্য ব্যবহার করা হয় না। এটি সঙ্গীদের আকৃষ্ট করতে এবং অন্যান্য ক্যাটলফিশের সাথে যোগাযোগ করতেও ব্যবহৃত হয়।
পূর্ব মতানুযায়ী, ক্যাটলফিশরা আশেপাশের পরিবেশের সাথে ছদ্মবেশের মাধ্যমে মিশে যাওয়ার জন্য প্রধান ৩টি রঞ্জক উপাদান (Pattern components) হতে ১টি গ্রহণ করে যা একটি সহজ প্রক্রিয়া। কিন্তু সম্প্রতি সিটি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ও অন্যান্য দ্বারা পরিচালিত এবং কারেন্ট বায়োলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা অনুসারে, ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য ইউরোপীয় ক্যাটলফিশরা পূর্ব ধারণার চেয়ে আরও জটিল পন্থা ব্যবহার করে। তারা বলেন, ছদ্মবেশ ধারণের জন্য ক্যাটলফিশরা প্রায় ৩০ টি রঞ্জক উপাদান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যা পূর্ববর্তী গবেষণার মতের সাথে সাংঘর্ষিক।
গবেষণাটির মূল সমীক্ষা জানায়:
ছদ্মবেশ ধারণের জন্য ক্যাটলফিশরা রঞ্জক উপাদানগুলোকে একত্রিত করে। আর রঞ্জক উপাদানগুলো নির্বাচন করার জন্য তারা দুটি স্নায়ুকৌশলকে ব্যবহার করে। একটি কৌশল হলো দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্তকরণ এবং অপরটি হলো সমুদ্রতলের পটভূমিকে (Seabed background) শ্রেণিবদ্ধকরণ। কৌশলগুলো একত্র করার জন্য একটি অনুক্রমিক মোটর-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (Motor-Control System) ব্যবহৃত হতে পারে।
এ গবেষণার জন্য গবেষকরা ১৫ টি ইউরোপীয় ক্যাটলফিশকে (Sepia officinalis) একটি ছোট পানির ট্যাঙ্কে মুক্তভাবে ছেড়ে দেন এবং ৭টি ভিন্ন ভিন্ন পটভূমিতে (Background) তাদের প্রভাবিত ছদ্মবেশী প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে ছবি তোলেন। এরপর এই প্রতিক্রিয়াগুলোকে সংবেদনশীল নিয়ন্ত্রনের দুটি মডেলের সাথে তুলনা করা হয়। যথা:
- বডি প্যাটার্ন মডেল (The body pattern model): এ মডেল অনুযায়ী ক্যাটলফিশ সমুদ্রতলের পটভূমিকে শ্রেণীবদ্ধকরণ করতে নিম্ন-স্তরের সংবেদনশীল সংকেতগুলিকে একত্রিত করে এবং দেহের নিদর্শন তৈরির জন্য অল্প সংখ্যক উপাদানিক অভিব্যক্তিকে একীভূত করে।
- বৈশিষ্ট্য মেলানো মডেল (The feature matching model): এ মডেল অনুযায়ী প্রতিটি উপাদান আশেপাশের দৃশ্যমান এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সংমিশ্রণের ওপর সম্পূর্ণ প্যাটার্নটি নির্ভরশীল।
‘পরিবেশ অনুযায়ী নিজের দেহের রঙ পরিবর্তন করতে পারার মতো ক্যাটলফিশের এই ভিনগ্রহী প্রাণিদের ন্যায় বৈশিষ্ট্যকে বিজ্ঞানীরা প্রাণিদের ছদ্মবেশ ধারণক্ষমতা নিয়ে চিন্তা করার একটি নতুন সুযোগের মতোই দেখছেন। এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল গুলো আমাদের ভবিষ্যৎ গবেষণাগুলোর জন্যেও নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে, যা আমাদেরকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে নির্দিষ্ট কোন বিষয় ও প্যাটার্নগুলো ক্যাটলফিশের দেহে এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সাহায্য করে এবং একইসাথে, তা আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করবে এই আর্টিফিশিয়াল রঙ পরিবর্তনের বিষয়টি কি ক্যাটলফিশগুলোর আশেপাশের পরিবেশেরও প্রতিনিধিত্ব করছে কি-না’, জানান প্রফেসর ক্রিস্টোফার টেইলর, গবেষণাটির একজন সহকারী লেখক।
আদনান সামি/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সাইটেক ডেইলি, কমন ক্যাটলফিশ, কারেন্ট বায়োলজি, আর্থ ডট কম