আমাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জিনিস সম্ভবত প্লাস্টিক। কিন্তু এই প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই এর বিকল্প বের করার প্রচেষ্টায় আছেন এবং তৈরি করতে চেয়েছেন এমন এক ধরনের উপাদান যা হবে সাধারণ প্লাস্টিকের মতোই মজবুত কিন্তু একইসাথে যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হবে না। এই গবেষণায় এবার যুক্ত হলো নতুন সম্ভাবনা “মৃত মাছির প্লাস্টিক”।
মৃত মাছির দেহ থেকে তৈরি করা সম্ভব এমন এক উপাদান যা কিনা হবে প্লাস্টিকের মতোই টেকসই একই সাথে বায়োডিগ্রেডেবল। অর্থাৎ যার ব্যবহার শেষে ফেলে দিলে তা মাটির সাথে মিশে যাবে।
সাম্প্রতিককালে এক গবেষণায় এমনই এক যুগান্তকারী তথ্য উঠে এসেছে। American Chemical Society (ACS) এর বাৎসরিক এক সভায় এই গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
Texas A&M University এর প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ক্যারেন উলি বলেন,
“গত ২০ বছর যাবৎ আমরা প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান যেমন – আখ বা আখ গাছ থেকে সংগ্রহকৃত গ্লুকোজ কে পচনশীল পলিমারে রূপ দেওয়ার উপায়ে তৈরি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি যা কিনা পরিবেশে পচনশীল।”
তিনি আরও বলেন,
“কিন্তু এই প্রাকৃতিক উপাদানগুলো এমন উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয় যা খাদ্য, জ্বালানি, কনস্ট্রাকশন এবং পরিবহনের কাজেও ব্যবহৃত হয়।”
অতঃপর ক্যারেন বিকল্প উপায় অনুসন্ধান শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে তার সহকর্মী জ্যাফরি টম্বারলিন তাকে “ব্ল্যাক সোলজার (Black Soldier)” নামক মাছি থেকে বেঁচে যাওয়া বর্জ্যপদার্থ ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।
এই প্রজাতির মাছির বর্জ্যপদার্থ ব্যবহারের একটি বিশেষ কারণও রয়েছে। এই মাছির লার্ভা খুবই উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায় কারণ তারা উচ্চমাত্রায় প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। যা পশুদের পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রজননে সক্ষম মাছির জীবনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত এবং প্রজননের পর তাদের মেরে ফেলা হয়। কিন্তু এই মাছির মৃতদেহ ক্যারেন উলির টিম কে নতুন একটি পথ দেখায়।
নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন আসছে মৃত মাছির প্লাস্টিকই কেন?
এর পিছনে রয়েছে একটি যুক্তিযুক্ত কারণ। মাছির দেহ এক প্রকার খোলসে আবৃত থাকে যার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো কাইটিন (Chitin) নামের এক ধরনের রাসায়নিক বস্তু।
কাইটিন হলো চিনি গঠিত এক ধরনের অবিষাক্ত, জৈব পচনশীল পদার্থ যা নানা ধরনের পোকামাকড় ও সামুদ্রিক জীবের খোলসে বিদ্যমান থাকে এবং একে শক্তপোক্ত করে। কাইটিন চিংড়ি এবং কাঁকড়ার খোলস থেকেও সংগ্রহ করা হয় যা নানা ধরনের দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু ক্যারেন উলির ল্যাবে কর্মরত ক্যাসিডি টিবেটস জানান, মাছি থেকে সংগ্রহকৃত কাইটিন পাউডার অন্য উৎস থেকে সংগ্রহকৃত কাইটিন থেকে অধিক বিশুদ্ধ এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য। কারণ মাছি থেকে যে পাউডার সংগ্রহ করা হয় তাতে হলুদাভ রং থাকে না এবং এর গঠনও অধিক ব্যবহারোপযোগী।
তাছাড়া কিছু মানুষের সামুদ্রিক খাবারে অ্যালার্জি আছে এবং এ ধরনের কাইটিন এর পাত্র সামুদ্রিক খাবারে অ্যালার্জি আছে এমন মানুষের জন্য ঝুঁকির কারণ হলেও হতে পারে। কিন্তু মাছি থেকে কাইটিন সংগ্রহ করা হলে সেই ঝুঁকি আর থাকছেনা।
যদিও জানা যায় অন্য একদল গবেষক মাছির লার্ভা থেকে পূর্বেই কাইটিন সংগ্রহ করেছিলেন কিন্তু উলি দাবি করেন যে তার টিমই সর্বপ্রথম পূর্ণবয়স্ক মাছি থেকে কাইটিন সংগ্রহ করেছে।
উলির ল্যাবে কর্মরত আরেকজন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট হেমিং গুয়ো মাছি থেকে সংগ্রহকৃত এসব কাইটিন থেকে অ্যাসিটাইল গ্রুপ অপসারণ করে তাকে কাইটোসান (Chitosan) নামক আরেক ধরনের পলিমারে রূপান্তর করেন। এই কাইটোসানকে পরবর্তীতে ক্রসলিংক করে ব্যবহারযোগ্য বায়োপ্লাস্টিক এ পরিণত করা যায়। এর মধ্যে একটি হলো পানি শোষণ উপযোগী হাইড্রোজেল (Super absorbent Hydrogel)।
এই হাইড্রোজেলটি তার ওজনের ৪৭ গুণ ওজন অবধি পানি শোষণ করতে সক্ষম। খরা এবং শুষ্ক মৌসুমে এই পদার্থটি ফসলি জমিতেও পানি ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করা যাবে। কাজ শেষে এই হাইড্রোজেলটি সম্পূর্ণরূপে মাটিতে মিশে যাবে আর এর রাসায়নিক উপাদানগুলো ফসলকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানেরও জোগান দিবে।
ক্যারেন ওলির টিম শীঘ্রই এই কাইটিনকে মনোমারিক গ্লুকোজামিন (Monomeric Glucosamine) এ পরিণত করার প্রজেক্ট শুরু করবেন এবং আশা করা হচ্ছে তারা পলিকার্বনেট এবং পলিইউরিথেন জাতীয় বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদনে সক্ষম হবেন যা কিনা সাধারণ উপায়ে পেট্রোকেমিক্যাল থেকে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এই প্রজেক্ট সফল হলে পেট্রোকেমিক্যাল এর বদলে মাছির দেহ থেকেই এই বায়োপ্লাস্টিকের অর্থাৎ, মৃত মাছির প্লাস্টিক উৎপাদন সম্ভব হবে।
উলি আরও জানান,
“সবশেষে ব্যবহারের পর আমরা প্লাস্টিকের বর্জ্যগুলোকে পুনরায় এসব মাছিদেরই খাওয়াতে চাই এবং পরবর্তীতে আমরা এসব মাছির পুনরায় প্রজনন ঘটিয়ে তাদের থেকে আবার নতুন করে প্লাস্টিক তৈরির উপাদান সংগ্রহ করতে চাই। এতে করে এসব পোকাগুলো প্লাস্টিক তৈরির কেবল উৎসই হবেনা বরং তারাই আবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক ভক্ষণ করবে। যা কিনা প্রকৃতপক্ষেই প্লাস্টিকের একটি পরিবেশবান্ধব এবং যুগোপযোগী উৎসের আবির্ভাব ঘটাবে।”
প্লাস্টিক দূষণ বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা। প্লাস্টিক মাটিতে পচে না। এরা বছরের পর বছর মাটিতে থেকে মাটির বিশুদ্ধতা নষ্ট করে এবং জীববৈচিত্র ধ্বংস করে। সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ নানাধরণের সামুদ্রিক জীবের অস্তিত্বও হুমকির মুখে ফেলছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং প্লাস্টিকের পরিবেশবান্ধব বিকল্প এখন অতীব জরুরি। আর এই বিকল্প হিসেবে মৃত মাছির প্লাস্টিক হতে পারে একটি সময় উপযোগী বস্তু!
লাবিব সাফওয়ান / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, এনিনিউজ, গ্রিনকুইন, দ্য টাইমস
+1
+1
+1
+1
+1
+1
+1