মানুষ সর্বদাই তার পূর্বপুরুষের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। আমাদের অর্থাৎ মানব জাতির উৎপত্তি এবং আমাদের পূর্বে যাদের আগমন ঘটে অর্থাৎ বিভিন্ন হোমিনিন প্রজাতির সাথে আমাদের সম্পর্ক খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। একটি প্রশ্ন সর্বদাই বিজ্ঞানীদের মাথায় এসেছে আর তা হলো, অন্যান্য হোমিনিনদের সাথে হোমো সেপিয়েন্সের কোনো যোগসূত্র আছে কী? তবে এধরনের কিছু প্রশ্নের উত্তর প্রমাণ-সহ দেয়া আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ছিলো বিজ্ঞানীদের কাছে। তবে এই অসম্ভব প্রশ্নের দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানী সাভান্তে পাবো। তিনি মানুষ এবং নিয়ান্ডারথাল-দের সম্পর্ক বের করেছেন। মানুষ কী নিয়ান্ডারথাল থেকে এসেছে?
তাহলে নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে যে কী ছিলো সাভান্তে পাবোর গবেষণা এবং কেন হোমিনিনদের সাথে হোমো সেপিয়েন্সের সম্পর্ক নির্ণয় করা এতটা অসম্ভব মনে হয়েছিলো অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাছে? চলুন জেনে নেয়া যাক।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, রসায়ন, জেনেটিক্স এবং পরিসংখ্যান মানুষ কোথা থেকে এসেছে তা বোঝার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবদান রাখে জেনেটিক্স। কোষ থেকে ডিএনএ বের করার এবং এর রৈখিক ক্রম পড়ার পদ্ধতির উদ্ভাবন জেনেটিক্সের কারণেই সম্ভব হয়েছে।
মানুষের জৈবিক অনন্যতা সৃষ্টির কারণ কী?
যখন একজন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন, তখন থেকেই তার সমস্ত কোষে ডিএনএ থাকে। পিতামাতা দুজনেই তাদের সন্তানের ডিএনএ তৈরিতে সমানভাবে অবদান রাখেন। ডিএনএ সাধারণত অপরিবর্তিত রূপে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হলেও বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ জৈবিক ত্রুটি এবং বাহ্যিক শক্তি যেমন সূর্যের শক্তি ডিএনএ তে ক্ষুদ্র পরিবর্তন ঘটায় যা সম্ভাব্য অন্যান্য পরিবর্তনের সাথে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়। এই পরিবর্তনগুলোর কারণেই দুটি ব্যক্তির ডিএনএ ক্রম কখনোই একরকম হয় না। উল্লেখ্য, ডিএনএ এর এই পরিবর্তন মাত্রা খুবই সামান্য (০.১%)। তবে এই সামান্য পরিবর্তনই প্রতিটি মানুষকে অনন্যতা দান করে।
ডিএনএ-র ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তনের একই ঘটনা একটি জীবের প্রতিটি প্রজাতিতে ঘটে। যখন প্রচুর পরিমাণে পরিবর্তন সংঘটিত হয়, তখন পূর্বে বিদ্যমান প্রজাতি হতে একটি নতুন প্রজাতির জন্ম হয়। বিভিন্ন প্রজাতির ডিএনএ সিকোয়েন্স অধ্যয়ন করে, কোন প্রজাতি কোনটি থেকে বিবর্তিত হয়েছে এবং কখন বিবর্তিত হয়েছিলো তা অনুমান করা সম্ভব।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে আফ্রিকায় ডিএনএ বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য ডিএনএ প্রমাণ এবং এই ধারণা হতে অনুমান করা হয় যে, আফ্রিকা হলো মানবজাতির দোলনা। আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স) এর প্রায় ১,৫০,০০০ বছর আগে আফ্রিকাতে বিবর্তন সংঘটিত হয়। হোমো সেপিয়েন্স অর্থাৎ, আমরা ৫০,০০০বছরের ও বেশি সময় ধরে আফ্রিকায় বিরাজমান ছিলাম এবং প্রায় ১,০০,০০০ বছর আগে অন্যান্য অঞ্চলে অন্বেষণ শুরু করতে বেরিয়ে এসেছি।
প্রধান বিবর্তনীয় কান্ড, Homo erectus, যাদের থেকে আধুনিক মানুষ বিবর্তিত হয়েছে এবং এই প্রজাতি প্রায় এক মিলিয়ন বছর আগে আমেরিকায় বসবাস করতেন। এই কাণ্ড হতেই অন্যান্য নতুন শাখার (হোমোর নতুন প্রজাতি) উদ্ভব ঘটে, যার বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যখন আমরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পশ্চিম এশিয়া এবং তারপরে ইউরোপে গিয়েছিলাম, তখন আমাদের সাথে Homo neanderthalensis বা আরো সহজভাবে নিয়ান্ডারথাল মানুষের সাথে দেখা হয়।
নিয়ান্ডারথাল মানুষ দেখতে একই রকম হলেও অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের থেকে আলাদা। নিয়ান্ডারথাল যা ৩০,০০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সাধারণত Homo heidelbergensis থেকে বিবর্তিত হয়েছিলো। আধুনিক মানুষ প্রায় ৭০,০০০ বছর ধরে নিয়ান্ডারথাল মানুষের সাথে সহাবস্থান করেছিলো। দক্ষ শিকারী ও আত্মরক্ষার শক্তি থাকা সত্ত্বেও নিয়ান্ডারথাল কেন বিলুপ্ত হলো তা নিয়ে জেনেটিস্টদের নানারকম মতবাদ ছিলো। তারা মনে করতেন যে যদি নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ খুঁজে বের করা যায় এবং সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয় তাহলে নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু কেউ এই সম্ভাবনাকে অন্বেষণ করার সাহস করেনি। কেননা, ডিএনএ একটি জৈবিক অণু হওয়ায় পরিবেশের বিভিন্ন পদার্থের সংস্পর্শে আসার ফলে হ্রাস পেতে থাকে। তাই হাজার হাজার বছরের সময় পাড়ি দিয়ে কোনো কোষের ডিএনএ ঠিক থাকবে তা বলা সম্ভব না। আর কেউ যদি কোষ থেকে ডিএনএ বের করতে সক্ষম হয়েও থাকে সেই ডিএনএ যে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য প্রাণীর স্পর্শ দ্বারা দূষিত হবে না তা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। এছাড়াও সবকিছু ঠিক করে গবেষণা শুরু করা হলেও ডিএনএ সিকোয়েন্সে গ্যাপ পাওয়া আরেকটি গুরুতর সমস্যা। অনেক বিজ্ঞানী এরকম গবেষণা শুরু করলেও মাঝপথেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
তবে এত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও একজন বিবর্তনীয় নৃবিজ্ঞানী, সাভান্তে পাবো এই সম্ভাবনাকে অন্বেষণ করার সাহস করলেন। জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকায় ফেল্ডহোফার গুহায় নিয়ান্ডারথালের একটি জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছিলো। এই জীবাশ্ম হতে ডিএনএ উদ্ধারের জন্য হাড়ের একটি ছোট নমুনা তৈরি করা হয়। তবে প্রাচীন ডিএনএ হতে জেনেটিক তথ্য পাওয়ার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় সাভান্তে পাবোকেও। নানারকম বাঁধা থাকা সত্ত্বেও তিনি এবং তার দল বাঁধাগুলো কাটিয়ে উঠার কৌশল পরিকল্পনা করেন এবং কাজ সম্পর্কিত প্রোটোকল তৈরি করেন।
২০১০ সালে, সাভান্তে পাবো এবং তার দল ক্রোয়েশিয়ার একটি গুহায় পাওয়া তিন ব্যক্তির দেহাবশেষ থেকে প্রথম নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হন। একই বছর দলটি সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় পাওয়া হাড়গুলোর বিশ্লেষণের মাধ্যমে হোমিনিনের আরেকটি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেন, যাকে এখন ডেনিসোভান বলা হয়। ২০১৪ সালে, তারা প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে বসবাসকারী নিয়ান্ডারথাল মহিলার একটি সম্পূর্ণ ডিএনএ ক্রম তৈরি করতে সক্ষম হন। নিয়ান্ডারথাল মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্যের পরিমাণ আধুনিক মানুষের তুলনায় কম পাওয়া যায়, খুব সম্ভবত এটি তাদের ছোট জনসংখ্যার ফল।
নিয়ান্ডারথালদের নিয়ে গবেষণার মাঝেই উঠে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য আর তা হলো, আধুনিক মানুষের মধ্যে নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ। নিয়ান্ডারথাল এবং মানুষের ডিএনএ ভ্যারিয়েন্টের ক্যাটালগগুলোর পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে সাভান্তে পাবো এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, নিয়ান্ডারথাল এবং মানুষের মাঝে আন্তঃপ্রজনন ঘটেছিলো এবং উর্বর সন্তান জন্মলাভ করেছিলো। আফ্রিকার বহির্ভূত মানুষ-দের ডিএনএ তে প্রায় ১-৪ শতাংশ নিয়ান্ডারথাল থেকে এসেছে, যা একটি গবেষণায় ২০ শতাংশ বলে দাবি করা হয়েছে।
আধুনিক মানুষ যখন আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো, তখন শুধু নিয়ান্ডারথাল প্রজাতিই নয় বরং ডেনিসোভান নামক ভিন্ন হোমিনিন প্রজাতির সাথেও তাদের দেখা হয়েছিলো। ২০১০ সালে ডেনিসোভান নিয়ে গবেষণা করার সময় উঠে আসে যে, নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানের মাঝেও আন্তঃপ্রজনন সম্পন্ন হয়। ডেনিসোভান আফ্রিকান বহির্ভূতদের ডিএনএ তে ৪-৬ শতাংশ অবদান রেখেছে। মজার বিষয় হলো, নিয়ান্ডারথালরা বিভিন্ন ভারতীয় জনসংখ্যার ডিএনএ তে ১.৮৯-২.৪৯ শতাংশ এবং ডেনিসোভানরা ০.০৮-০.৪০ শতাংশ অবদান রেখেছে। অর্থাৎ, ভারতে ডেনিসোভান মিশ্রণের পরিমাণ নিয়ান্ডারথালের তুলনায় কম।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আধুনিক মানুষ যদি নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানদের সাথে আন্তঃপ্রজনন সম্পন্ন করেই থাকে এবং উর্বর সন্তানও জন্মলাভ করে তবে এই প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হলো কীভাবে?
এর উত্তর হলো, মানুষ এবং নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভানদের মধ্যে মিলনের ফলে জন্ম নেয়া সন্তান (উর্বর সন্তান, যাদের বেশ কিছু শক্তিশালী জিন মানুষ ও নিয়ান্ডারথাল থেকে এসেছে) মানুষের সাথেই থেকে যায়। হাজার হাজার বছর ধরে এভাবে চলতে থাকায়, হোমিনিন প্রজাতির জনসংখ্যার আকার সংকুচিত হতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের প্যাথোজেন এবং জৈবিক বিবর্তনের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে অনেক নতুন তথ্য শিখতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় দেখা যায় যে, যখন মানুষ আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসে এবং নতুন হোমিনিনের সাথে মিলিত হয়, তখন তারা নতুন প্যাথোজেনের সম্মুখীন হয়। নিয়ান্ডারথালরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই রোগজীবাণুগুলোর সাথে বসবাস করে এবং লড়াই করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলো। ফলে মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালের মিলনে জন্ম নেয়া সন্তান এই প্রতিরোধী জিনগুলো পেয়েছিলো যেগুলো তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দৃঢ় করে তোলে। অর্থাৎ, নিয়ান্ডারথালরা ডিএনএ ইমিউন সিস্টেমের জিনে অবদান রেখেছে। এই জিনের ভ্যারিয়েন্ট বর্তমানে ইউরোপীয়দের মধ্যে পাওয়া গেছে, কিন্তু আফ্রিকানদের মধ্যে নয়।
প্রকৃতপক্ষেই, পাবোর আবিষ্কারগুলো চমকপ্রদ ছিলো এবং মানব বিবর্তনের অনেক ভুল তথ্যকে দূরীভূত করেন। তার গবেষণায় আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স) ও অন্যান্য হোমিনিনের মাঝে সম্পর্ক খুঁজে বের করা যায়। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি এবং তার দল কঠোর পরিশ্রম ও নিখুঁতভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে অসম্ভব এই অন্বেষণকে সম্ভব করে তোলেন এবং একারণেই এ বছর অর্থাৎ, ২০২২ সালে ফিজিওলোজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় সাভান্তে পাবোকে।