আমরা প্রায় এই বাক্যটি শুনি, “লাঠি এবং পাথর আমার হাড় ভেঙ্গে দিতে পারে কিন্তু মানুষের মুখনিঃসৃত শব্দ আমার মস্তিষ্কে আঘাত করে।” মানুষের কথার দ্বারা মস্তিষ্কে আঘাত করা আসলেই সম্ভব। কারণ মানুষের মুখনিঃসৃত কথাগুলো এমন একটি মাধ্যম হিসাবে কাজ করে যা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ আচরণ উপলব্ধি করতে আমাদের সাহায্য করে।
একটি হৃদয়বিদারক ব্রেক-আপ বার্তা পাওয়া থেকে শুরু করে কঠোর সমালোচনা, অপমান বা উপহাসসহ আমরা সকলেই আঘাতমূলক কথার দ্বারা মানসিক কষ্টের অভিজ্ঞতা পেয়েছি। তবুও কীভাবে শব্দগুলো মানুষের জন্য আক্রমণাত্মক হয় এবং সেগুলো মানুষকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে তা একটি জটিল রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।
কিন্তু যখন আমরা এই আপত্তিকর শব্দগুলোর মুখোমুখি হই তখন আমাদের মস্তিষ্কে কী ঘটে?
ফ্রন্টিয়ার্স ইন কমিউনিকেশনে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বারবার মৌখিক অপমানের স্বল্পমেয়াদী প্রভাব পরীক্ষা করে ভাষা এবং আবেগের মধ্যে জটিল সম্পর্কের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি (EEG) এবং ত্বকের কন্ডাক্টেন্স রেকর্ডিংয়ের মতো উন্নত কৌশলগুলো ব্যবহার করে গবেষকরা কীভাবে অপমান আমাদের মস্তিষ্কে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু রহস্য উন্মোচন করেছেন। এই মিথস্ক্রিয়াগুলোতে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে কাজ করলেও অপমানের খারাপ প্রভাবের অন্তর্নিহিত সঠিক প্রক্রিয়াগুলো বোঝা যায় না।
মস্তিষ্ক যেভাবে শারীরিক এবং মানসিক ব্যথা প্রক্রিয়া করে তা অনেকটা একইরকম। ব্যথার একটি কেন্দ্রবিন্দু আছে। এর অর্থ এই নয় যে শারীরিক ব্যথার কারণে মস্তিষ্কে যে প্রক্রিয়ায় সংকেত যায় ঠিক একইরকমভাবে নেতিবাচক কথার সংকেত মস্তিষ্কে যায়। বরং এটি বোঝায় যে একইরকমভাবে কোথাও আঘাত লেগেছে। ফলে আমরা কেমন অনুভব করি তার উপর এটি প্রভাব ফেলে।
প্রথমে জানা যাক শারীরিক ব্যথা কিভাবে অনুভূত হয়। শারীরিক ব্যথা সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো এটি নোসিসেপ্টর দ্বারা শনাক্ত করা হয়, যা মস্তিষ্কে সংকেত দেয়। Nociceptive ব্যথা কেবল তখনই ঘটে যখন শরীর এমন কিছু শনাক্ত করে যা শরীরের ক্ষতি করতে পারে। যেমন গরম বা ঠান্ডা তাপমাত্রা বা শারীরিক শক্তি। Nociceptors শরীরের ত্বক, পেশী, হাড় বা সংযোগকারী টিস্যুর শারীরিক ক্ষতি অনুভব করে। আপনি যদি ভুলবশত আপনার হাত খুব গরম কিছুর কাছে রাখেন তাহলে আপনার ত্বকের নোসিসেপ্টরগুলো ত্বক পুড়ে যাওয়ার আগে আপনার অঙ্গটিকে দূরে টেনে নেওয়ার জন্য একটি রিফ্লেক্স তৈরি করতে সক্রিয় হবে।
ডাঃ মারিজন স্ট্রুইকসমা এবং তার দল এই রহস্য উদঘাটনের জন্য একটি মিশনে যাত্রা শুরু করে। তারা প্রশংসা এবং নিরপেক্ষ মূল্যায়নের তুলনায় মৌখিক অপমানের প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্তির সংবেদনশীলতার মধ্যে পার্থক্য আছে কিনা তা তদন্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।
গবেষকরা এই অনুমান পরীক্ষা করার জন্য ৭৯ জন মহিলা অংশগ্রহণকারীদের উপর EEG (electroencephalogram) এবং ত্বকে কন্ডাক্টেন্স ইলেক্ট্রোড স্থাপন করা হয়েছিল।
এই অংশগ্রহণকারীরা অপমান, প্রশংসা, এবং নিরপেক্ষ বর্ণনামূলক বিবৃতি অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
আশ্চর্যজনকভাবে, একটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাগারের পরিবেশেও মানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে অপমান একটি শক্তিশালী উদ্দীপনা হিসাবে প্রমাণিত হয়। এসময় মনোযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ফ্রিকোয়েন্সি হিসেবে কাজ করে।
আবেগগত প্রভাব বোঝা যদিও কঠিন কারণ গবেষণাটি একটি কৃত্রিম পরিবেশে পরিচালিত হয়েছিল। এতে দেখা যায় ইতিবাচক শব্দগুলোর তুলনায় নেতিবাচক শব্দগুলোর প্রতি আমাদের মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা বেশি। মৌখিক অপমান প্রশংসার তুলনায় একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া জাগিয়েছে। অপমানের মানসিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে স্মৃতিতে থাকে। ফলে সেগুলো আমাদের মস্তিষ্কে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে যায়।
এটি আমাদের সকলের-ই জানা যে, আমাদের মৌখিক বাক্যগুলো মানুষে মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলার সক্ষমতা রাখে। তাই বিজ্ঞানীরাও এ নিয়ে গবেষণায় বেশ আগ্রহী। ভবিষ্যতে গবেষকরা গবেষণার মাধ্যমে এই প্রভাবগুলোকে আরও বাস্তবসম্মত পরিস্থিতিতে অন্বেষণ করতে পারে যাতে অপমানের কারণে হওয়া মানসিক এবং জ্ঞানীয় প্রতিক্রিয়াগুলো গভীরভাবে বোঝা যায়।
মাইশা নিজাম / নিজস্ব প্রতিবেদক
সোর্স: সাইকোলোজি টুডে, মিডিয়াম.কম