সময়ের আবর্তে যুগ গড়িয়ে বহুযুগ। জীবন গড়িয়ে যায় মৃত্যুতে আর জানার ইচ্ছে গড়িয়ে যায় নতুন আবিষ্কারে। এ সকল চলমান জিনিস একজন মানুষের জীবনে চলমান থাকে শেষ অবধি। নতুন প্রশ্নের উত্তরে ভেসে আসে হাজারো অজানা দিগন্ত, যার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মানব মস্তিষ্ক। আর সেই দিগন্তে আলোকপাত করলেই উঠে আসে চমকপ্রদ একেকটা নতুন সত্য।
মানুষ! স্রষ্টার সৃষ্টি জগতের সবথেকে প্রভাবশালী প্রাণী। যারা নিজেদের বুদ্ধিবলে দাপিয়ে বেড়ায় সব সৃষ্টিকুলের ঊর্ধ্বে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে, এত বড় বড় প্রাণী জীবজগতে কিন্তু মানুষ কীভাবে তাদেরকে বশে নিতে পারে? কীভাবে কর্তৃত্ব পরিচালনা করে? কী এমন আছে মানুষের মস্তিষ্কে যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণিদের থেকে আলাদা করে?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আসুন জেনে নিই কিছু তথ্য।
প্রাইমেট:
মানুষ, বানর, হনুমান, গরিলা ও লেমুর জাতীয় স্তন্যপায়ীদের নিয়ে গঠিত উন্নত হাত, পা ও বড়ো মস্তিষ্কবিশিষ্ট একটি বর্গ। মানুষ ব্যতীত সবাই এদের বৃক্ষচারী জীবনে অভিযোজিত, কিন্তু ভূচর (স্থলে চরে বেড়ায় এমন)। এদের বেশির ভাগ গাছের পাতা, ফল ও বিভিন্ন শাকসবজি খায়, আবার কেউ কেউ পতঙ্গভুক। প্রাইমেটরা আকারে ও ওজনে ভিন্ন। মারমোসেটের আকার ৩০ সেমি, ওজন ১ কেজিরও কম, অথচ গরিলার উচ্চতা দাঁড়ানো অবস্থায় ২০০ সেমি ও ওজন সর্বাধিক ৩৫০ কেজি। বানর, হনুমান, গরিলা ও মানুষকে উঁচু স্তরের প্রাইমেট; Simian বা Anthropod বলা হয়।
উঁচু স্তরের প্রাইমেটরা আবার দুটি বড়ো দলে বিভক্ত:
১। Platyrrhini (পশ্চিম গোলার্ধের বানর)
২। Catarrhini (পূর্ব গোলার্ধের বানর, হনুমান ও মানুষ)
জীবিত প্রায় ১৮০ প্রজাতির প্রাইমেটের মধ্যে পূর্ব গোলার্ধের প্রাইমেট প্রজাতির সংখ্যা ৮৩। এই বর্গে মানুষই কেবল সম্পূর্ণ খাড়া হয়ে হাঁটতে পারে। প্রায় ১৮০ প্রজাতির প্রাইমেটের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ২৫ প্রজাতি আছে। আর বাংলাদেশে আছে ১০টি প্রজাতি ।
ডরসোল্যাটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স:
ডরসোল্যাটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (DLPFC বা Dorsolateral Prefrontal Cortex) হলো প্রাইমেট মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের একটি এলাকা। এটি মানব মস্তিষ্ক এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক প্রাপ্ত অংশগুলির মধ্যে একটি। এটি পরিপক্কতার একটি দীর্ঘ সময়ের মধ্য দিয়ে যায় যা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী হয়। DLPFC একটি শারীরবৃত্তীয় কাঠামো নয়, বরং একটি কার্যকরী কাঠামো। এটি মানুষের মধ্যবর্তী ফ্রন্টাল গাইরাসে অবস্থিত ।
FOXP2 জিন:
FOXP2 জিন ফর্কহেড বক্স P2 নামক প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা প্রদান করে। এই প্রোটিন একটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর, যার মানে এটি অন্যান্য জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি একটি ফর্কহেড ডোমেন নামে পরিচিত একটি অঞ্চলের মাধ্যমে এই জিনগুলির ডিএনএর সাথে সংযুক্ত করে। গবেষকরা সন্দেহ করেন যে ফর্কহেড বক্স P2 প্রোটিন শত শত জিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যদিও এর কিছু লক্ষ্যমাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফর্কহেড বক্স P2 প্রোটিন জন্মের আগে এবং পরে মস্তিষ্ক সহ বিভিন্ন টিস্যুতে সক্রিয় থাকে। এটি মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে স্নায়ু কোষের বৃদ্ধি এবং তাদের মধ্যে সংকেত প্রেরণ। এটি সিনাপটিক প্লাস্টিসিটির সাথেও জড়িত, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন এবং অভিজ্ঞতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য নিউরন (সিনাপ্স) এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
প্রাইমেট প্রজাতির প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে কোষের প্রকার বিশ্লেষণ করে ইয়েল গবেষকরা দেখেছেন, যে প্রোটিনগুলো আমাদের মানুষ করে তোলে তা আমাদের নিউরোসাইকিয়াট্রিক রোগের জন্য সংবেদেনশীল ।
গবেষণার জন্য, গবেষকরা বিশেষভাবে ডোরসোলেটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে (ডিএলপিএফসি) একটি একক কোষের আরএনএ-সিকোয়েন্সিং কৌশল ব্যবহার করে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, শিম্পাঞ্জি, ম্যাকাক এবং মারমোসেট বানরের DLFPC থেকে সংগৃহীত কয়েক হাজার কোষে জিনের এক্সপ্রেশন লেভেল তৈরি করেন। গবেষকরা ডোরসোলেটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সকে মানুষের পরিচয়ের মূল উপাদান হিসেবে দেখলেও তারা এটা নিশ্চিত হতে পারেননি যে এটি মানুষের কোন বৈশিষ্ট্যকে অনন্য করে যা মানুষের প্রজাতি আলাদা হিসেবে ব্যপ্ত করে।
পার্থক্যগুলো সূক্ষ্মভাবে বুঝার জন্য গবেষকরা প্রথমেই জানার চেষ্টা করেছিলো যে কি এমন স্বতন্ত্র কোষ আছে যা মানুষ এবং অন্য প্রাইমেট প্রজাতির মধ্যে উপস্থিত আছে? অতঃপর কোষগুলোকে একই ধরনের অভিব্যক্তির উপর বিশ্লেষণ করে ১০৯ টি ভাগের প্রাইমেট কোষের ধরন প্রকাশ করে। যার মধ্যে ৫টি ভাগ ছিলো ব্যতিক্রম।
এর মধ্যে রয়েছে একটি ধরন হচ্ছে মাইক্রোগ্লিয়া বা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট ইমিউন সেল। যেটি শুধুমাত্র মানব মস্তিষ্ক-এর মধ্যে উপস্থিত ছিল এবং দ্বিতীয় ধরনেরটি শুধুমাত্র মানুষ এবং শিম্পাঞ্জিদের মাঝে বিদ্যমান।
মাইক্রোগ্লিয়া সহ কোষগুলো মস্তিষ্কের রক্ষণাবেক্ষণে ভূ্মিকা রাখে।
সেস্তান বলেছিলেন,
“আমরা মানুষ অন্যান্য প্রাইমেট প্রজাতির তুলনায় একটি অনন্য জীবনধারা সহ একটি ভিন্ন পরিবেশে বাস করি; এবং মাইক্রোগ্লিয়া-সহ গ্লিয়া কোষগুলি এই পার্থক্যগুলির জন্য খুব সংবেদনশীল। মানুষের মস্তিষ্কে পাওয়া মাইক্রোগ্লিয়ার ধরন পরিবেশের প্রতি একটি অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া উপস্থাপন করতে পারে।”
মাইক্রোগ্লিয়াতে জিনের অভিব্যক্তির বিশ্লেষণ আরেকটি মানব-নির্দিষ্ট বিস্ময় প্রকাশ করেছে FOXP2 জিনের উপস্থিতি। এই আবিষ্কারটি ব্যাপক আগ্রহ জাগিয়েছে কারণ FOXP2 এর রূপগুলি মৌখিক ডিসপ্র্যাক্সিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে। অন্যান্য গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে FOXP2 অন্যান্য নিউরোসাইকিয়াট্রিক রোগ যেমন অটিজম, সিজোফ্রেনিয়া এবং মৃগীরোগের সাথে যুক্ত ।
সেস্টান এবং তার সহকর্মীরা খুঁজে পেয়েছেন যে এই জিনটি মাইক্রোগ্লিয়াতে উত্তেজক নিউরনের একটি উপসেটে প্রাইমেটের নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি এবং মানব-নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি প্রদর্শন করে।
সেস্তানের ল্যাবের পোস্ট ডক্টরাল সহযোগী এবং সহ-প্রধান লেখক শাওজি মা বলেছেন,
“FOXP2 কয়েক দশক ধরে অনেক বিজ্ঞানীকে কৌতূহলী করে তুলেছে, কিন্তু তখনও আমাদের কোন ধারণা ছিল না যে এটি মানুষ বনাম অন্যান্য প্রাইমেট প্রজাতির মধ্যে একটি পার্থক্য তৈরি করে। আমরা FOXP2 অনুসন্ধান সম্পর্কে অত্যন্ত উত্তেজিত কারণ তারা ভাষা এবং রোগের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে নতুন দিকনির্দেশ খুলে দিয়েছে।”
পুরো এই গবেষণাটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ দ্বারা অর্থায়ন করা হয়েছিল।
মানব মস্তিষ্ক! জীবজগতের সবথেকে রহস্যময় জিনিস। যার মাঝে লুকিয়ে আছে অপ্রকাশিত অনবদ্য ঘটনা। একে বিশ্লেষণে বহুযুগ থেকে বিজ্ঞানীরা কাজ করেই চলছে। নতুন নতুন জৈবিক ঘটনা পাল্টে দিচ্ছে আমাদের মতাদর্শ। যেনো এক মায়ার ইন্দ্রজাল এই মানব মস্তিষ্ক। যেখানে শুধু প্রতিটা নতুন দিগন্তে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়।
তথ্যসূত্র: সায়েন্সডেইলি