বৈচিত্র্যময় এই জগতে প্রাণীকূলের মত বৈচিত্র্যময় আর কিছু নেই। এর মধ্যে বৈচিত্র্যময় হল মাছ। পৃথিবীতে প্রায় ৩০-৪০ হাজার মাছের প্রজাতি পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রায় সকল মাছ সারাজীবন পানিতেই বসবাস করে থাকে। বিরল প্রজাতির কিছু মাছ রয়েছে যারা জলে ও স্থলে উভয় জায়গায় বসবাস করতে পারে। এমনই একটি মাছ মাডস্কিপার!
এদের জীবনচক্রে পানির চেয়ে মাটিতে-ই বেশি সময় ব্যয় করে এই মাছ। ‘সুনশেয়ন বে’ (suncheon bay) দক্ষিণ কোরিয়ার মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। এই জায়গাটি ডাঙাও নয়, আবার সাগরও নয়। ভাটার সময় সাগর ৮ কিলোমিটার সরে গিয়ে বিশাল কাদাভূমি জাগিয়ে তোলে।
মাডস্কিপারদের এই কাদাভূমির দাপুটে বাসিন্দা বলা হয়ে থাকে। এছাড়া ও আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, সামোয়া, টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জ, ক্রান্তীয়, উপ-ক্রান্তীয় এবং উষ্ণ অঞ্চল, ইন্দো-প্যাসিফিক এবং আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূলীয় অঞ্চলেও মাডস্কিপার মাছের দেখা মেলে। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বাস করে। এই মুহুর্তে প্রায় বত্রিশটি প্রজাতি এবং দশ প্রজন্মের মাডস্কিপার রয়েছে বলে জানা যায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হল ‘শাটল হপফিশ’।
গঠনঃ
বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পানি ছাড়া মাটিতে-ও মাডস্কিপার মাছ কোনো সমস্যা ছাড়াই বসবাস করতে পারে। মাছটির পানিতে চলার মত পাখনা এবং স্থলে চলার মত বিশেষ পাখনা দুটোই আছে।
এছাড়া মাডস্কিপার মাছ শরীরের ত্বকের মাধ্যমে শ্বাস গ্রহণ করতে পারে। সম্ভবত মাডস্কিপারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো পানিতে ও মাটিতে উভয় জায়গায় বেঁচে থাকার সক্ষমতা। মাডস্কিপার এমন মাছ যা প্রায়শই পানির চেয়ে মাটিতে বেশি সময় ব্যয় করে। আসলে এরা ডুবে যেতে পারে যদি তারা কখনই জল ছেড়ে যেতে না পারে।
অন্যান্য মাছের মতো, মাডস্কিপাররা ফুলকা দিয়ে শ্বাস নেয়, কিন্তু উপরন্তু তারা তাদের ত্বক এবং তাদের মুখ ও গলার আস্তরণের মাধ্যমে অক্সিজেন শোষণ করে। তারা তাদের পেক্টোরাল ফিন ব্যবহার করে নিজেদেরকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে বা একের পর এক স্কিপ বা লাফ দিয়ে ভূমির উপর দিয়ে যেতে সক্ষম। এদের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল লবণাক্ততার পরিসরে এরা বেঁচে থাকতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, মাছটি তাদের জীবনের তিন-চতুর্থাংশ সময় স্থলে বাস করে। এরা লম্বায় ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। এদের শরীরের রং বাদামি সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ মাডস্কিপার মাছের শরীরে উজ্জ্বল রঙের বিভিন্ন আকারের গোলাকার দাগের সৃষ্টি হয়। এই রঙিন দাগের কারণেই পুরুষ মাছটি নারী মাডস্কিপারকে আকর্ষণ করে। দাগগুলো সাধারণত লাল, সবুজ কিংবা নীল রঙের হয়ে থাকে।
মাডস্কিপারের মাথার উপরের দিকে থাকা বড় ফুলে ওঠা চোখ দেখতে মাছের চেয়ে ব্যাঙের চোখের মতো। প্রতিটি চোখ অন্য একটি থেকে স্বাধীনভাবে চলতে পারে মাডস্কিপাররা তাদের চারপাশে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত দেখতে পারে। বাতাসে তাদের দৃষ্টিশক্তি চমৎকার, কিন্তু পানিতে তাদের দৃষ্টি অতোটা ভালো নয়।
মাডস্কিপারের শরীরের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বক্ষের পাখনাগুলো অনেকটা সামনের দিকে এবং তাদের শরীরের বর্ধিত অংশের নিচে অবস্থিত। এই পাখনাগুলোই মূলত মাডস্কিপার পা হিসেবে ব্যবহার করে যা তাদের স্থলে হাঁটতে সহায়তা করে। মাডস্কিপার মাছের হাঁটতে পারার বৈশিষ্ট্যই অন্যান্য মাছ থেকে তাদের পৃথক করেছে।
বসবাসের স্থানঃ
শরীরের নিচের পাখনা দিয়ে এরা কাঁদামাটি পার হয়ে যেতে পারে এমনকি নিচু গাছেও উঠতে পারে। বিশেষ পাখনার সাহায্যে তারা দুই ফুট পর্যন্ত লাফ দিতে পারে। যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে মাডস্কিপার মাছ খুবই দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। জোয়ার ভাটার সময় এদের বিশেষ কোনো সমস্যা হয় না। জোয়ারের সময় পানিতে থাকে এবং ভাটার সময় খুব সহজেই কাঁদামাটি কিংবা শুষ্ক স্থলে থাকতে পারে। জোয়ার ভাটার পরিবর্তন থেকে নিজেদের স্বাভাবিক রাখতে তারা কাদামাটিতে গর্ত খুঁড়ে এবং তার মধ্যে অবস্থান করে।
ভাটার সময় গর্তের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত হয়। এই সময়ে মাছগুলিকে জমিতে পাওয়া যায় তবে শিকারীদের থেকে সুরক্ষার জন্য, শুকিয়ে যাওয়া রোধ করতে এবং তাদের ডিম পাড়া ও যত্নের জন্য গর্তের মধ্যে প্রবেশ করে। উচ্চ জোয়ারের সময়, মাছ সাধারণত গর্তের মধ্যে ফিরে যায়। যদিও তারা ভাটার জন্য অপেক্ষা করার সময় কখনও কখনও পাথর, শিকড় বা অন্যান্য জায়গায় বিশ্রাম নিতে দেখা যায়।
একবার পানি নেমে গেলে মাছগুলি তাদের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসে বা তাদের গর্ত থেকে নেমে আসে এবং কাদার উপর চলে যায়। এখানে তারা খাবারের সন্ধানে উপকূলে টহল দেয়। বেশিরভাগ মাডস্কিপার মাংসাশী এবং পোকামাকড়, কৃমি, ছোট ক্রাস্টেসিয়ান এবং কখনও কখনও ছোট মাডস্কিপার সহ বিভিন্ন ধরণের শিকার খায়। কিছু মাডস্কিপার শেওলাও খেয়ে থাকে।
পুরুষ মাছগুলো বেশ পরিশ্রমী স্বভাবের হয়। সাধারণত পুরুষ মাডস্কিপার গর্ত খুঁড়ে থাকে। প্রজনন প্রক্রিয়া, ডিম ফুটানো সবই এই গর্তের মধ্যে করে থাকে তারা। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ মাডস্কিপার গর্ত প্রস্তুত করার পর মাটির উপর উঠে আসে। প্রজননের পর পুরুষ মাছটিই বাচ্চা ফুটানো পর্যন্ত ডিমগুলো দেখে রাখে। ডিম থেকে মাছের বাচ্চা ফুটে গর্তেই। খাদ্য ছাড়াও চীনা ওষুধ শিল্পে মাডস্কিপার মাছ ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হয়।
মেহেদী হাসান মামুন/ নিজস্ব প্রতিবেদক