“ট্রুথ সেরাম” বা “ভেরিটাসেরাম” নামের এক অদ্ভূত ওষুধের কথা আমরা অনেকেই বিশ্ববিখ্যাত বইয়ের সিরিজ হ্যারি পটার-এ পড়েছি। এ ট্রুথ সেরাম এর বর্ণনায় বলা হয়েছিলো যে কেউ যদি কোনভাবে এটি খেয়ে ফেলে, তাহলে কিছু সময়ের জন্য সে মিথ্যাকথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এটি এমন একটি মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ, যা আপনার চিন্তাশক্তি কেড়ে নিতে সক্ষম। এমনই ভয়ংকর কিছু ড্রাগ বা কেমিক্যাল এখন ছিনতাইকারী-রা ব্যবহার করছে। এই ভয়ংকর ড্রাগটির নাম হলো ‘শয়তানের শ্বাস’ বা ‘ডেভিলস ব্রেথ‘।
ট্রুথ সেরাম প্রয়োগ করলে দেখা যায়, সে যত চেষ্টাই করুক, একমাত্র সত্য ছাড়া কিছুই তার মুখ দিয়ে বের হবে না, তা যত প্রীতিকর বা অপ্রীতিকরই হোক না কেন। এই ধরণের ড্রাগ গুলো আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। এই বিষয়টির সুবিধা নিয়েই ছিনতাইকারী-রা ‘শয়তানের শ্বাস’-এর মতো মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ গুলো ব্যবহার করছে।
হ্যাঁ, বাস্তবেও এমন কিছু ওষুধের দেখা মেলে, এবং তারা বিভিন্নভাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, সোডিয়াম থিওপেন্টাল মেরুদণ্ড থেকে মস্তিষ্কে যাওয়া সিগন্যালের গতি কমিয়ে দেয়। এর ফলে মিথ্যা বলা, সোজা একটি লাইনে হাঁটা, বা কোনকিছুতে মনোযোগ দেওয়ার মতো জটিল কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যাপারটি অনেকটা ঘুম এবং সজ্ঞানের মাঝামাঝি একটি অবস্থায় থাকার মতো।
তবে ট্রুথ সেরাম খেলেই যে মানুষ সত্যি কথা বলবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এটি কেবল মানুষের মিথ্যা বলার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আবার ট্রুথ সেরামের প্রভাবে মানুষ শুধু অন্যকে খুশি করার জন্য এমন কথাও বলতে পারে যার মধ্যে মিথ্যা লুকিয়ে আছে। তাছাড়া মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ-এর ব্যবহার অনুমতি ছাড়া অবৈধও বটে, আবার আমাদের দেশে অনেক সময়ই এর ব্যবহার দেখা যায় ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টিদের কাছে।
বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল এ ধরণের ট্রুথ সেরাম বা মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ হিসেবে কাজ করে। তাদের কয়েকটির ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক:
স্কোপোলামিন (Scopolamine)- বিংশ শতাব্দীতে ডা. রবার্ট হাউসার প্রথম এ কেমিক্যালটিকে “ট্রুথ সেরাম” হিসেবে প্রচার করেন। ১৯২০ এবং ৩০ এর দশকে এটি আমেরিকার পুলিশদের ভেতর অনেক প্রচলিত হয়, এবং স্কোপোলামিন এর প্রভাবে আদায় করা জবানবন্দি বিচারকেরা প্রমাণ হিসেবে গ্রহণও করতেন। স্কোপোলামিন এর প্রভাব চলে যাওয়ার পর বক্তা কী বলেছে সে স্মৃতি তার থাকে না। ফলে অনেকেই এটি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতো। বর্তমানে এটিই পরিচিত ‘শয়তানের শ্বাস’ নামে ও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ছিনতাইকারী, ও হাইজ্যাকারদের দ্বারা।
স্কোপোলামিন স্কোপোলিয়া গাছের বীজ থেকে নিষ্কাশিত হয়, এবং পিল হিসেবে খাওয়া যায়। আজ এটি যাত্রায় বমিভাব এবং পার্কিন্সন’স এর চিকিৎসায় কাজে লাগে। তবে সবকিছুই ভালো হয়ে যায়নি; ডেট-রেপ ড্রাগ হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।
পেন্টোথাল/ সোডিয়াম থিওপেন্টাল- এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে শরীর মন্থর গতিতে তথ্য বিশ্লেষণ করে। এ ধরনের ওষুধকে বারবিটুরেট বলে, এবং চিকিৎসকেরা ব্যথা কমানো, মাংসপেশী শিথিল করা আর রক্তের প্রেশার কমানোর কাজে ব্যবহার করেন। তবে মাত্রাতিরিক্ত সেবনে এটি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
সোডিয়াম অ্যামিটাল/ অ্যামোবার্বিটাল– এটিও একধরণের বারবিটুরেট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনারা নিজেদেরকে শান্ত করতে এটি ব্যবহার করতো। এ কেমিক্যালটি আবার আসক্তিকরও। এখন এটি মাঝে মাঝে ইনসমনিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এরও মাত্রাতিরিক্ত সেবন মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
এখন আর ট্রুথ সেরাম হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয় না, কারণ এরপর ব্যবহারকারীর ভ্রান্ত স্মৃতি তৈরী হয়।
ইথাইল অ্যালকোহল (ethyl alcohol)- সহজ বাংলায় যাকে আমরা মদ বলে চিনি। সেটিও একধরণের ট্রুথ সেরাম! অবাক হচ্ছেন কি? যাদের মদপানের অভিজ্ঞতা আছে তারা একটু বেশী খেলেই বুঝবেন, শরীরের মাংসপেশী আস্তে আস্তে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, এবং আপনার জন্য মিথ্যা বলাও আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে মদ্যপেরা যে একেবারেই মিথ্যা বলতে পারেন না তা নয়। একে দুর্বল একটি ট্রুথ সেরাম বলা চলে।
তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কোন ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তার ট্রুথ সেরাম বের হয়নি। তার মানে আবার এও না যে তা ভবিষ্যতে কখনো তৈরী হবে না। তবে এখন পর্যন্ত নিখুঁত, শতভাগ কার্যকরী ভেরিটাসেরাম শুধু হ্যারি পটার-এর জগতেই বন্দি থাকবে। কিন্তু এই আংশিক কার্যকরী ওষুধগুলোর ক্ষতিকর ও অন্যায় ব্যবহার থেকে আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে। রাস্তায় আরো সাবধানে চলাচল করতে হবে যেন কোনো ছিনতাইকারী বা হাইজ্যাকার পার্টি এসব ড্রাগের ভুক্তভোগী করতে না পারে।
করোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলিতে ২০২৩ সালের ফিজিয়োলজি বা মেডিসিনে নোবেল জিতলেন ক্যাটালিন কারিকো এবং ড্রু ওয়েইসম্যান। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর...