বলা হয়ে থাকে, একজন শিশুর সবথেকে নিরাপদ স্থান হলো মাতৃক্রোড়। জন্মের পর শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে তাকে বড় করার দায়িত্বটাও মায়ের ওপরই বর্তায়। শিশুর জন্য কোন খাবারই এর থেকে বেশি নিরাপদ না। কিন্তু এখন সেই নিরাপদ জায়গাটাতেও একটু একটু করে সন্দেহ ঢুকতে শুরু করছে। প্রথমবারের মতো মায়ের বুকের দুধেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক- গবেষকদের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল অন্তত তাই বলছে।
গবেষণার অংশ হিসেবে ইতালিতে, ৩৪ জন সুস্থ মায়ের কাছে থেকে বুকের দুধের নমুনা নেওয়া হয়েছিলো। সেই নমুনাগুলোর মধ্যে তিন-চতুর্থাংশে (75%) মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে গবেষকরা। এর আগেও প্লাস্টিক কিংবা এর কেমিক্যাল বিভিন্ন সামুদ্রিক জীবে পাওয়া গেছে, উদাহরণস্বরূপ- phthalates– যা প্লাস্টিক নরম করতে ব্যবহার হয়, তা বুকের দুধেও পাওয়া যায়।
সেই মায়েরা কোন ধরনের প্লাস্টিক মোড়কজাত খাবার-পানীয় গ্রহণ করেন, কিংবা এমন কসমেটিকস/ পার্সোনাল জিনিস ব্যবহার করেন যাতে প্লাস্টিক আছে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু এমন কোনো কিছু পাওয়া যায়নি যা মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে। তাই গবেষকদের ধারণা- চারপাশের পরিবেশ থেকেই হয়ত মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করছে।
কয়েকবছর আগে যখন সামুদ্রিক মাছগুলোর অন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেলো, তখন সী-ফুড সেফটি আলোচনায় এসেছে, বিশেষকরে Shellfish নিয়ে। ২০১৭ সালে বেলজিয়ান গবেষকরা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে সেই দেশে কোনো সী-ফুড লাভার এক বছরে ১১,০০০ প্লাস্টিক পার্টিকেল গ্রহণ করতে পারে। সেই সময় থেকেই হয়ত গবেষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, প্লাস্টিক ক্রমাগত পরিবেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে মিশে যাচ্ছে, এবং এতটাই ক্ষুদ্র যে মানুষের চুলের থেকেও সূক্ষ্ম ফাইবারে পরিণত হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াতে সক্ষম।
মাইক্রোপ্লাস্টিক বা ৫ মি.মি.র থেকে ছোট পার্টিকেল, লবণ, বিয়ার থেকে শুরু করে সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীর সকল বর্জ্য যেমন শেষ সময়ে সমুদ্রে পতিত হয়, তেমনি এই প্লাস্টিকগুলোও সমুদ্রে মিশছে। গত বছর করা সর্বশেষ পরিসংখ্যানে, কিউশু ইউনিভার্সিটির জাপানি বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন 24.4 ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসমান রয়েছে – যা প্রায় 30 বিলিয়ন আধা লিটার পানির বোতলের সমতুল্য। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই, ৩৬৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক তৈরি হয়েছিলো, যা ২০৫০ সালে তিনগুণ হবে বলা ধারণা করা যায়। তখন যে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে তা নিশ্চয়ই অনুমান করা যাচ্ছে।
পলিমার জার্নালে প্রকাশিত, এই গবেষণায় মায়েদের বুকের দুধে পাওয়া গেছে পলিথিন, পলিপ্রোপিলিন, PVC এর মতো মাইক্রোপ্লাস্টিক, যেগুলো সাধারণত প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। গবেষকরা 2 মাইক্রনের চেয়ে ছোট কণা বিশ্লেষণ করতে পারেননি এবং এর চেয়েও ছোট প্লাস্টিকের কণা উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে মানুষের রক্তেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের নমুনা পাওয়া যায়। সেই গবেষণা দলের নেতা Prof Dick Vethaak এর মতে, মায়ের দুধের মতো জটিল ম্যাট্রিসে ন্যানোপার্টিকেল নিয়ে গবেষণা দুষ্কর। (দ্রষ্টব্যঃ এই গবেষণার প্রত্যেকটি কাজে প্লাস্টিক এর অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে করেছেন গবেষকরা।)
যেহেতু মায়ের দুধের বিকল্প নেই, আর তাছাড়াও প্যাকেটজাত দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠা শিশু এর থেকেও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক একদিনে গ্রহণ করে, যা আরও ক্ষতিকর, তাই শিশুকে স্তন্যপান করাতে কোনো অসুবিধা নেই বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা। Dr Valentina Notarstefano এর মতে, এক্ষেত্রে মায়েদের সতর্ক থাকা জরুরি, এবং গর্ভবতী মহিলাদের প্যাকেটজাত খাবার-পানীয় গ্রহণ, প্লাস্টিকযুক্ত কসমেটিক বা সিন্থেটিক ফেব্রিক থেকে তৈরি পোশাক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।
মিথিলা ফারজানা মেলোডি/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, দ্যা গার্ডিয়ান, এনডিটিভি