মহাবিশ্বের চেয়েও নক্ষত্র বয়সে বড় – মহাকাশের গোলকধাঁধা
পর্ব–১
মহাবিশ্ব যদি ১৩.৮ বিলিয়ন বয়সের অধিকারী হয় তাহলে কি করে একটি নক্ষত্র ১৪ বিলিয়নেরও বেশী বয়স ধারণ করে আছে? মহাবিশ্বের এই রহস্যই ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং পর্দাথ বিজ্ঞানীদের!
১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে অদ্ভুত একটি তারা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের পর্যবেক্ষণ চালিয়ে আসছিলেন যেটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১৯০ আলোকবর্ষ দূরে “লিবরা” নামক নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থান করছে। এটি পুরো আকাশজুড়ে প্রতি ঘন্টায় ৮০০,০০০ মাইল (প্রতিঘন্টায় ১.৩ মিলিয়ন কিলোমিটার) বেগে পরিভ্রমণ করে। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে “মেথুসেলাহ” বা “এইচডি–১৪০২৮৩” নামে পরিচিত এই তারাটি মহাবিশ্বের সবচাইতে পুরনো তারাদের মধ্যে একটি বলে জানা যায়।
বিজ্ঞানীরা ২০০০ সালে এই তারাটির বয়স জানার জন্য ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সীর (ইএসএ) হিপারকস স্যাটেলাইট দিয়ে পর্যবেক্ষণ চালনা করেন, যার থেকে অনুমান করা হয় যে এই তারাটির বয়স ১৬ বিলিয়ন বছর। কিন্তু এইরকম একটি তথ্য যেমনই চমকপ্রদ ঠিক তেমনি আশ্চর্যজনক!
পেনসিলভানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় এর জ্যোতির্বিদ হাওয়ার্ড বন্ড এর মতে, মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণকৃত তথ্যানুসারে এই মহাবিশ্ব ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পুরনো। “এটি একটি মারাত্মক রকমের অমিল” – তিনি বলেন।
শুধুমাত্র এই একটি নক্ষত্রের আনুমানিক বয়স নিয়েই তৈরী হয়েছে বিশাল জটিলতা। একটি নক্ষত্র কিভাবে তার মহাবিশ্বের চেয়ে বয়সে বড় হতে পারে? অথবা উল্টোভাবে চিন্তা করলে, কিভাবে মহাবিশ্ব তার মাঝে থাকা একটি নক্ষত্রের চেয়ে কম বয়সী হতে পারে? এর মধ্যে মজার একটি বিষয় আছে, এই অদ্ভুত তারার নামটি দেওয়া হয়েছে বাইবেলে উল্লেখিত পূর্বপুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বছর যিনি বেঁচে ছিলেন তার নামে।
মেথুসেলাহ নামের বাইবেলের এই ব্যক্তিটি মারা যান ৯৬৯ বছর বয়সে, আর তার নামেই রাখা হয়েছে এই তারার নাম। তারাটির অন্তর্গঠনে দেখা যায় এটি হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং খুব সামান্য পরিমাণ লোহা দিয়ে তৈরী। এর গঠন থেকে এটা বোঝা যায় যে প্রকৃতিতে লোহা সাধারণভাবে আসার আগেই তারাটির অস্তিত্ব ঘটেছিল। কিন্তু তাই বলে তার নিজের পরিবেশ থেকেও ২ বিলিয়ন বছরেরও আগে? অবশ্যই তা সম্ভব নয়!
চলুন মেথুসেলাহ–এর বৈশিষ্ট্যগুলো গভীর ভাবে দেখি:
বন্ড এবং তার সহকর্মীরা মেথুসেলাহর বয়স ১৬ বিলিয়ন বছর কিনা তা সঠিকভাবে উদ্ধার করতে কাজে নেমে পড়লেন। তারা ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত “হাবল স্পেস টেলিস্কোপ” এর ফাইন গাইডেন্স সেন্সর ব্যবহার করে তারাটির উপর ১১ সেট পর্যবেক্ষণ চালালেন, যেগুলো তারার অবস্থান,দূরত্ব এবং কতটুকু শক্তি নিঃসরিত হচ্ছে তা নোট করে। এক্ষেত্রে প্যারালাক্স, বর্ণালী এবং ফটোমেট্রি এর পরিমাপের মাধ্যমে বয়সের তুলনামূলক ভালো ধারণা পাওয়া যায়।
“এইচডি–১৪০২৮৩ এর বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি অনিশ্চয়তা ছিলো তারাটির সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা”, অল এবাউট স্পেস–কে বলেন বন্ড। “এটি সঠিকভাবে নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটার দ্বারা এর উজ্জ্বলতা ভালভাবে বোঝা যাবে এবং সেটি দিয়ে এর বয়স, অন্তর্নিহিত ঔজ্বল্য যত বেশী হবে তারাটিকে ততো তরুণ বিবেচনা করা যাবে।
আমরা প্যারালাক্স ইফেক্ট এর খোঁজ করছিলাম যার মাধ্যমে আমরা ছয় মাস বাদে তারাটিকে দেখতে চাইছিলাম যখন সে পৃথিবীর কক্ষপথের গতির কারণে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসে এবং সেটাই আমাদের দূরত্বটা জানিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, “অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে তারাদের মডেলিং এর ক্ষেত্রে একদম কেন্দ্রে সঠিক নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার হার এবং বাইরের স্তরগুলোতে উপাদানগুলোর নিম্ন অভিমুখে ছড়িয়ে পড়ার মতো কিছু অনিশ্চয়তা আছে।” তারা এমন একটি ধারণা নিয়ে কাজ করছিলেন যেটায় অবশিষ্ট হিলিয়াম নক্ষত্রের কেন্দ্রের গভীরে ছড়িয়ে যায় এবং স্বল্প পরিমাণ হাইড্রোজেন নিউক্লিয়ার ফিউশনে পুড়ে যায়। ফুয়েল যত বেশী দ্রুত খরচ হবে, তারাটির বয়স তত কম হবে।
“সবকিছুর মধ্যে একটি অন্যতম উপাদান হচ্ছে তারাটিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কতটুকু সেটা” জানান বন্ড। এইচডি–১৪০২৮৩ এ অক্সিজেন–আয়রন এর অনুপাত অনুমানকৃত অনুপাতের চেয়ে বেশী ছিল এবং যেহেতু কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে মহাবিশ্বে অক্সিজেন তেমন ব্যাপক পরিমাণ ছিল না তাই এটি আবার তারাটির জন্য অল্প বয়সের ধারণা দেয়।
বন্ড এবং তার সহকর্মীরা এইচডি–১৪০২৮৩ এর বয়স মোটামুটি হিসাব করেছিলেন ১৪.৪৬ বিলিয়ন বছর, যেটা অন্তত ১৬ বিলিয়ন বছর থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। যদিও এটা মহাবিশ্বে বয়সের তুলনায় এখনও বেশী, তবে বিজ্ঞানীরা ৮০০ মিলিয়ন বছরের একটি অনিশ্চয়তা বিবেচনায় রেখেছেন যা প্রাপ্ত বয়স থেকে কমিয়ে হিসাব করলে মেথুসেলাহর বয়স ও মহাবিশ্বের বয়সের মাঝে কিছুটা মিল পাওয়া যায়, যদিও এটি সম্পূর্ণ নিখুঁত ছিল না।
বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্যের এস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ম্যাথিউস এর মতে, “সব হিসাবের মতোই এই হিসাবেও র্যান্ডম ও সিস্টেম্যাটিক ত্রুটি রয়েছে”, উনি এই গবেষণার পর্যবেক্ষণে সংযুক্ত ছিলেন না। ম্যাথিউস বলেন, “ত্রুটির সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গেলে মহাজাগতিক বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটি সাংঘাতিক মতবিরোধ সৃষ্টি করবে।”
অন্য ভাবে বলতে গেলে, “নক্ষত্রটির জন্য সর্বাধিক সমর্থিত বয়সটি মহাবিশ্ব থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এর বয়সের সাথে দ্বন্দ্বযুক্ত (যেমনটি মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড হতে নির্ধারিত হয়েছিল) এবং এই দ্বন্দ্ব কেবলমাত্র ত্রুটি সীমারেখার চূড়ান্ত সীমাতে পৌঁছালেই সমাধান করা যেতে পারে।”
পরবর্তী পরিমার্জনগুলোতে এইচডি–১৪০২৮৩ এর বয়স আরো কিছুটা কমেছে। ২০১৪ এর একটি ফলোআপ সমীক্ষায় এর বয়স ১৪.২৭ বছর হিসেবে আপডেট করা হয়। বন্ডের মতে, “উপসংহার হিসেবে নক্ষত্রটির বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর হিসেব করা হয় এবং যদি কেউ সকল প্রকার অনিশ্চয়তাকে অন্তর্ভুক্ত করে – পর্যবেক্ষণমূলক পরিমাপ এবং তাত্ত্বিক মডেলিং উভয়ক্ষেত্রে তবে ত্রুটি হিসেবে ৭০০ অথবা ৮০০ মিলিয়ন বছর পাওয়া যায় , তাই এটি নিয়ে কোন দ্বিমত নেই যে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর বয়সী তারাটির ত্রুটি সীমারেখার মধ্যে রয়েছে!”