প্রথম পর্বের পরঃ পরবর্তী পরিমার্জনগুলোতে এইচডি–১৪০২৮৩ নক্ষত্র-টির বয়স আরো কিছুটা কমেছে। ২০১৪ এর একটি ফলোআপ সমীক্ষায় এর বয়স ১৪.২৭ বছর হিসেবে আপডেট করা হয়। বন্ডের মতে, “উপসংহার হিসেবে নক্ষত্রটির বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর হিসেব করা হয় এবং যদি কেউ সকল প্রকার অনিশ্চয়তাকে অন্তর্ভুক্ত করে – পর্যবেক্ষণমূলক পরিমাপ এবং তাত্ত্বিক মডেলিং উভয়ক্ষেত্রে তবে ত্রুটি হিসেবে ৭০০ অথবা ৮০০ মিলিয়ন বছর পাওয়া যায়, তাই এটি নিয়ে কোন দ্বিমত নেই যে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর বয়সী তারাটির ত্রুটি সীমারেখার মধ্যে রয়েছে!”
বন্ডের জন্য মহাবিশ্বের বয়স এবং মেথুসেলাহ নামক ঐ পুরোনো নক্ষত্রটির বয়সের মিল- দুটোই যেখানে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেটি বিজ্ঞানের একটি কৃতিত্বপূর্ণ অর্জন যা মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং ঘটনার পক্ষে খুব শক্ত প্রমাণ দেখায়। তিনি বলেন, সবচেয়ে পুরনো তারাটির বয়স নির্ণয়ের সমস্যাটি ১৯৯০ সালের মতো এতটা মারাত্মক ছিলনা, ঐ সময়টিতে নক্ষত্রমন্ডলীর বয়স ১৮ বিলিয়ন বা একটি ক্ষেত্রে ২০ বিলিয়ন বছরের কাছাকাছি চলে এসেছিল।“ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাসহ বয়সগুলো এখন একই রকম হয়ে আসছে” বলেছেন বন্ড।
আরও পড়ুনঃ মহাবিশ্বের চেয়েও নক্ষত্র বয়সে বড় – মহাকাশের গোলকধাঁধা পর্ব-১
তবুও ম্যাথিউ বিশ্বাস করেন, সমস্যাটির সমাধান এখনো হয়নি। জ্যোতির্বিদগণ জুলাই ২০১৯ ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারায় অবস্থিত কাভিল ইন্সটিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স এ অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মহাবিশ্বের বয়সের জন্য বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ভিন্ন ভিন্ন মান দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা নিকটবর্তী অবস্থিত ছায়াপথগুলোর পরিমাপগুলো পর্যবেক্ষণ করেন যা এটা ইঙ্গিত দেয় যে মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের যে বয়স নির্ধারিত হয়েছিল তার থেকে মহাবিশ্ব শত মিলিয়ন বছর বেশী তরুণ।
বাস্তবে, ২০১৩ সালে ইউরোপীয়ান প্ল্যাংক স্পেস টেলিস্কোপের মহাজাগতিক বিকিরণের বিশদ পরিমাপ থেকে যেই ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পাওয়া গিয়েছিল তা না হয়ে মহাবিশ্বটি হয়তোবা ১১.৪ বিলিয়ন বয়সের যুবা। এইসকল গবেষণার পেছনে অন্যতম হলেন মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরের স্পেস টেলিস্কোপ বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের নোবেলজয়ী এডাম রিজস।
মহাবিশ্ব দিনকে দিন বিস্তৃত হচ্ছে- এই ধারণার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে, যেমনটি ১৯৯৯ সালে এডউইন হাবল দেখিয়েছিলেন। এটি বিগ ব্যাং এর মৌলিক বিষয়- মহাবিশ্ব একটা সময় প্রচন্ড উষ্ণ ঘনত্বের অবস্থায় ছিল এবং সেটির বিস্ফোরণ ঘটে। এটি নির্দেশ করে যে এই বিস্ফোরণের আগে একটি সূচনা বিন্দু ছিল যা মাপা সম্ভব, কিন্তু নতুন অনুসন্ধানগুলি পরামর্শ দেয় যে বিস্ফোরণের কারণে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার প্ল্যাংকের প্রস্তাবিত হারের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশী।
প্রকৃতপক্ষে, প্ল্যাংকের দল নির্ধারণ করেছিল যে সম্প্রসারণের হার প্রতি মেগা পারসেক প্রতি সেকেন্ডে ৬৭.৪ কিলোমিটার, কিন্তু সাম্প্রতিক পরিমাপগুলো নির্দেশ করে যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার ৭৩ বা ৭৪ কিলোমিটার। এটার অর্থ দাঁড়ায় যে, মহাবিশ্ব এখন কত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে তার সাথে পূর্ববর্তী পদার্থবিজ্ঞানের অনুমিত কত দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়া উচিত এর পরিমাপের মধ্যকার একটা পার্থক্য রয়েছে। এটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বগুলির পুনরনিরীক্ষণের দিকে ধাবিত করে এবং দেখায় যে ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির ব্যাপারে এখনো অনেক কিছু জানা বাকি রয়ে গেছে,যা এই প্রহেলিকার পেছনের কারণ বলে মনে করা হয়।
হাবল ধ্রুবকের উচ্চতর মান মহাবিশ্বের নিম্নতর বয়সের দিকে নির্দেশ করে। ৬৭.৭৪ কিমি প্রতি সেকেন্ড প্রতি মেগাপারসেক সাধারণত ১৩.৮ বিলিয়ন বছর বয়স হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে যেখানে ৭৩ বা এরচেয়ে একটু বেশী ৭৭ এর জন্য ১২.৭ বিলিয়ন বছর বয়সের বেশী পাওয়া যায়না। এটি একটি অমিল যেটা আবারও আমাদের বলে দেয় যে এইচডি ১৪০২৮৩ নামক নক্ষত্র টি মহাবিশ্বের চেয়ে বেশী বয়স্ক। অবশ্য ২০১৯ এ “সায়েন্স” জার্নালের একটি পর্যবেক্ষণে এই পুরনো ধ্রুবক মানের পরিবর্তে হাবল ধ্রুবকের মান ৮২.৪ হিসেবে প্রস্তাবিত হয়, সে হিসেবে এই মহাবিশ্বের বয়স পাওয়া যায় মাত্র ১১.৪ বিলিয়ন বছর।
ম্যাথিউস বিশ্বাস করেন যে এই গোলকধাঁধার উত্তরগুলো এই মহাজাগতিক বিষয়ক তত্ত্বগুলোর বৃহত্তর সংশোধন করবে। “আমার ধারণা, তারকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সহ যে সকল মহাজাগতিগণ এই ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন তারা কোন কিছু একটা ভুলে বাদ দিয়ে ফেলেছেন যা এই প্যারাডক্সের জন্ম দিয়েছে। তিনি তারাগুলির পরিমাপগুলো সম্ভবত আরো সঠিক হতে পারতো এমন ইঙ্গিত দিয়ে আরো বলেন, “এটা এজন্য নয় যে জ্যোতির্বিদরা তাদের কাজের ক্ষেত্রে অবহেলা করেছেন বরং এটি এজন্য যে মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় এর ব্যাপারটি কৌশলগতভাবে অনেক বেশি জটিল এবং নক্ষত্র-এর চাইতে তাত্ত্বিক অনিশ্চয়তার বিষয়।“
তবে বিজ্ঞানীরা এটির সমাধানে কি করে আসবেন?
কোন বিষয়টি এই একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্র-এর বয়সের চাইতে মহাবিশ্বের বয়সকে কম হিসেবে উপস্থাপন করছে?
“এক্ষেত্রে দুটি অপশন রয়েছে এবং বিজ্ঞানের ইতিহাস আমাদের এটা বলে যে এইরকম ঘটনার ক্ষেত্রে বাস্তব ব্যাপারটি দুটি অপশনেরই সংমিশ্রণ হতে পারে”,জানান ম্যাথিউস। “এক্ষেত্রে এটি পর্যবেক্ষণমূলক ত্রুটির উৎস হবে যা পুরোপুরি বোঝা যায়নি,পাশাপাশি মহাবিশ্বের গতিবিদ্যার তত্ত্বের মধ্যে রয়ে যাওয়া কিছু ফাঁক যেমন ডার্ক এনার্জির শক্তির ধারণা,যা বহু বিলিয়ন বছর ধরে মহাজাগতিক বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রধান চালক হিসেবে কাজ করে আসছে।“
তিনি পরামর্শ দেন যে বর্তমান এই “বয়সের প্যারাডক্স” ডার্ক এনার্জির মধ্যকার সময়ের পরিবর্তনের, এবং এর ত্বরণের হারের পরিবর্তনও প্রতিফলন করার সম্ভাবনা আছে – একটি সম্ভাবনা তাত্ত্বিকেরা মহাকর্ষের মৌলিক প্রকৃতির ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করছেন, যেমন তথাকথিত কার্যকারিতা সেট তত্ত্ব। ম্যাথিউজ আরো বলেন যে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সম্পর্কে নতুন গবেষণা প্যারাডক্সটিকে সমাধান করতে সহায়তা করতে পারে।
এটি করার জন্য, বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা কাছাকাছি অবস্থিত বস্তু যেমন সিফিড ভেরিয়েবল এবং সুপারনোভাতে মনিটরিং করার পরিবর্তে মৃত নক্ষত্র জোড়ার তৈরী মহাশূন্যের ফেব্রিকগুলোতে রিপলের দিকে লক্ষ্য রাখবেন যেন হাবল ধ্রুবক পরিমাপ করতে পারেন- পূর্ববর্তীটি ৬৭ কিমি প্রতি সেকেন্ড প্রতি মেগাপারসেক এবং পরবর্তীটি ৭৩ ফলাফল হিসেবে এসেছিল।
সমস্যা হচ্ছে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলো পরিমাপ করা কোন সহজ কাজ নয়, তবে ২০১৫ সালে প্রথমবারের জন্য এটি শনাক্ত করা গিয়েছিল। তবে নিউইয়র্ক এর ফ্লাটির্ন ইন্সটিটিউট এর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন ফিনের অনুযায়ী, আগামী দশকে একটি অগ্রগতি হতে পারে। দৃশ্যমান আলো ব্যবহার করে দুটি নিউট্রন তারার মধ্যকার সংঘর্ষের তথ্য সংগ্রহ করলে প্রাপ্ত তথ্য থেকে পৃথিবীর তুলনায় তাদের গতি কিরকম তার ধারণা পাওয়া যাবে। সাথে দূরত্বের একটি ধারণার জন্য মহাকর্ষীক তরঙ্গের বিশ্লেষণ জড়িত- উভয়ই হাবল ধ্রুবককে পরিমাপ করার জন্য ব্যবহার করা হবে যার কারণে সেটি হতে প্রাপ্ত ফলাফল এখনো পাওয়া সবচেয়ে নির্ভুল হাবল ধ্রুবক হওয়া উচিত।
এইচডি ১৪০২৮৩ এর বয়সের রহস্যটি মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে সেটি বোঝার জন্য আরো বড় এবং আরো বেশী বৈজ্ঞানিকভাবে জটিল কোন সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।
“এই প্যারাডক্সটির পক্ষে সম্ভবত কিছুটা অবহেলিত পর্যবেক্ষণমূলক প্রভাব এবং/অথবা মহাজাগতিক বিস্তারের গতিবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের বৃহত্তর কিছু ধারণার অনুপস্থিতি জড়িত,” বলেন ম্যাথিউস। ঠিক সেই “কিছু” যাই হোক না কেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এটি কিছু সময়ের জন্য হলেও চ্যালেঞ্জ করে তা নিশ্চিত।
নাহিদ সুলতানা তুলি/ নিজস্ব প্রতিবেদক