মানব সৃষ্ট অন্যতম বৃহৎ সুরক্ষা বেষ্টনী দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না এর মতোই প্রকৃতি সৃষ্ট আয়নোস্ফিয়ার বা থার্মোস্ফিরয়াকে দ্য গ্রেট ওয়াল অফ আর্থ বললে মোটেও ভুল হবে না। আয়নোস্ফিয়ার আমাদের পৃথিবীকে সকল প্রকার সৌর ঝড় (Solar Storm) ও উচ্চ শক্তি সম্পন্ন কসমিক রে (Cosmic Ray) এর মতো মহাজাগতিক ঘটনা থেকে রক্ষা করে আসছে।
তবে কি হবে যদি এই সুরক্ষা কবজ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে তা আমাদের এই নীল গ্রহকে এসব থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা হারায়? ঠিক এমনি এক মহাজাগতিক ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৪১,০০০ বছর আগে। আর এই এস্ট্রোনোমিক্যাল ইভেন্ট (Astronomical Event) নিয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে নতুন গবেষণায়।
কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি মূলত বিভিন্ন কোয়াসার (Quasar), সক্রিয় গ্যালাকটিক নিউক্লিয়াস, গামা রশ্মি বিচ্ছুরণ অথবা সুপারনোভা (Supernova) থেকে উৎপন্ন হওয়া উচ্চ শক্তিসম্পন্ন আহিত কণা (Charged Particles) যার মধ্যে প্রায় ৮৯% হলো আহিত প্রোটন কণা। এছাড়াও রয়েছে কিছু পরিমাণ কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও লোহার ভারী নিউক্লিয়াস। এরা প্রায় আলোর কাছাকাছি বেগে মহাবিশ্বে বিচরণ করে এবং যাত্রাপথে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে আঁচড়ে পড়ে!
তবে এসব মহাজাগতিক কণার বৃষ্টির আঘাত কখনোই আমাদের বিশেষ ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে নি। কারণ বায়ুমণ্ডলে থাকা আয়নোস্ফিয়ার সিংহভাগ রশ্মি বায়ুমন্ডলের ভিতরে আসতে বাঁধা দেয় এবং তারপরও যে অল্প পরিমাণ ভিতরে প্রবেশ করে তা জীবজগতে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না।
কিন্তু পৃথিবীর সুরক্ষা বলয় আয়নোস্ফিয়ার সবসময়ই স্থির নয়। বিশেষ করে নর্থ পোলের চৌম্বক ক্ষেত্র নিজের প্রকৃত অবস্থা থেকে কিছু সরে অবস্থান করে এবং সার্বক্ষণিক আন্দোলিত অবস্থায় থাকে। এছাড়াও সময়ের সাথে সাথে সাউথ পোল ও নর্থ পোলের চৌম্বকক্ষেত্র নিজেদের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে। আর ঠিক এই বিশেষ মুহূর্তে আয়নোস্ফিয়ার কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পৃথিবী অনেকাংশে অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
এছাড়াও মাঝেমধ্যে Magnetic Field Excursions সংগঠিত হয়। সোজা বাংলায় বললে কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ারের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের ঘনত্ব হ্রাস ঘটে যা সর্বোচ্চ ২০% পর্যন্ত হতে পারে। আর এই পুরো ঘটনাটি কয়েক হাজার বছর থেকে আরো দীর্ঘ সময় ধরেও চলতে পারে। তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার এটি পুরো পৃথিবী জুড়ে কখনো হয় না বরং বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চল জুড়ে হয়ে থাকে। এসময় পৃথিবীর ঐ অঞ্চল সুরক্ষা কবজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এমন ঘটনা ঘটার ফলে খুব বড় মাত্রায় ঝুঁকি এ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি কারণ মানব ইতিহাসে হোমো স্যাপিয়ান্সরা কমপক্ষে একবার এমন মহাজাগতিক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে এবং তার প্রভাব তেমন কিছুই ছিল না! তবে যেহেতু কসমিক রে খুব সহজে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে তাই রেডিয়েশনে কারণে বেরিলিয়াম (১০) ও কার্বন (১৪) এর মাত্রা কিছু বৃদ্ধি পায়।
আজ থেকে প্রায় ৪১ হাজার বছর আগে ঠিক এমনি ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল পৃথিবী। যা Kargapolova Loschamp Geomagnetic Excurtion নামে পরিচিত। এটিই এপর্যন্ত ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
তবে যদি বায়ুমণ্ডলে অথবা ভূ-প্রকৃতিতে খুব একটা ক্ষতিকর প্রভাব না-ই ফেলতে পারে তাহলে এমন ঘটনা নিয়ে গবেষণা এত গুরুত্বপূর্ণ কেনো?
এমন প্রশ্নের জবাবে Sanja Panovska, একজন জার্মান বিজ্ঞানী ও মহাকাশ গবেষণাকারী বলেন,
“ভবিষ্যতে এমনটা আবারো হলে তার প্রভাব কেমন হতে পারে অথবা মহাকাশ জলবায়ু সম্পর্কে আগাম ধারণা রাখতে আমাদের অতীতে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার উপাত্ত যাচাই করতে হবে। এছাড়াও পরিবেশে আদৌ প্রভাব ফেলছে কিনা তা সম্পূর্ণ ধারণ পেতে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।”
কসমিক রে কখন পৃথিবীতে চরম মাত্রায় আঘাত ফেলছে সেই সময় সীমা যাচাই করতে বিজ্ঞানীরা আইসোটোপ পর্যবেক্ষণ করে। (দুটি পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা একই কিন্তু ভর সংখ্যা ভিন্ন হলে তাদের পরস্পরের আইসোটোপ বলে)
যখনই অতিরিক্ত মাত্রায় মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পতিত হয় তখন এক প্রকার আইসোটোপ মেঘের সৃষ্টি করে যাকে Cosmic Radionuclide বলে। এসব পরবর্তীতে বৃষ্টির মতো পৃথিবী পৃষ্ঠে ঝরে পড়ে।
আর বিজ্ঞানীরা সমুদ্র পৃষ্ঠ অথবা এন্টার্কটিকার ও গ্রীনল্যান্ডের বরফ খোদাই করে এসব নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা চালান। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে সাধারণ সময়ের তুলনায় বর্তমানে মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে বায়ুতে বেরিলিয়াম (১০) উৎপাদ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
Sanja Panovska ও তার দল মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয়তা ও আয়নোস্ফিয়ার এর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও প্রাপ্ত সকল ফলাফলের ভিত্তিকে তারা আয়নোস্ফিয়ারের একটি মডেল পুনঃনির্মান করেন এবং দেখাতে সক্ষম হন যে ৪১ হাজার বছর আগের সেই ঘটনায় পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ার কিছুটা সংকুচিত হয়েছিলো। এ ব্যাপারে গত ইউরোপীয় জিওসায়েন্স ইউনিয়নে তারা তারা গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন।
ভবিষ্যতে এমন মহাজাগতিক রশ্মির তীব্র আক্রমণ থেকে জীবজগৎ ও নিত্য দিনের প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিকস পণ্য রক্ষণাবেক্ষণে এমন গবেষণা কার্যকরী অবদান রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এস এম ইফতেখার আলম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: স্পেস.কম, ফিজিক্স.অর্গ