১৯৭০ সাল, নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের বিজ্ঞানবিষয়ক সহ-পরিচালক ছিলেন ড. আর্নস্ট স্টুলিঙ্গার। সেই সময় নাসা থেকে মহাকাশ গবেষণা ও অভিযান নিয়ে নানান পরিকল্পনা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এর ব্যয় অনেক। নাসার এই কাজের পরিপ্রেক্ষিতে জাম্বিয়া-ভিত্তিক এক সন্যাসী ‘সিস্টার মেরি জুকুন্ডা’ ড. আর্নস্ট স্টুলিঙ্গারকে উদ্দেশ্য একটি চিঠি লেখেন। তিনি ড. আর্নস্ট কে জিজ্ঞেস করেন, মঙ্গল গ্রহে পাইলট মিশনের গবেষণার মতো প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করার মতো পরামর্শ তিনি কিভাবে দিতে পারেন, যেখানে পৃথিবীতে অনেক শিশু এখনো না খেয়ে আছে!
ড. আর্নস্ট সেই চিঠির জবাব দেন, উল্লেখ করেন কেন মহাকাশ গবেষণা প্রয়োজন। চিঠির সাথে পৃথিবীর একটি ছবিও পাঠান যেটা ছিলো ১৯৬৮ সালে চাঁদের অরবিট থেকে তোলা। মহাকাশচারী উইলিয়াম অ্যান্ডারসন এই ছবিটি তোলেন।
ডা. আর্নস্ট এর চিঠিটি পরবর্তীতে নাসা প্রকাশ করে ‘Why Exploring Space?’ শিরোনামে।
চিঠিটি ছিলো নিম্নরূপ:
৬ মে, ১৯৭০
সুপ্রিয় সিস্টার মেরি জুকুন্ডা,
প্রতিদিনই আমার কাছে অনেক চিঠি আসে। তাদের মধ্যে আপনার লেখা চিঠিটি আমাকে বেশ গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমি বুঝতে পারছি এই চিঠিটি একটি অনুসন্ধানী মন তথা হৃদয়ের গভীর থেকে লেখা হয়েছে।
আমি যতটা সম্ভব আপনার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।
শুরুতেই আমি আপনার এবং আপনার সাথে থাকা সকল সিস্টারদের প্রশংসা করছি। কারণ আপনি এবং আপনার সহকর্মীরা অভাবী মানুষের সাহায্যের জন্যে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
আপনি আপনার চিঠিতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যখন পৃথিবীতে অনেক শিশু অনাহারে মারা যাচ্ছে, তখন মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণের মতো প্রকল্পে বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পরামর্শ আমি কীভাবে দিতে পারি। এর উত্তরে আপনি নিশ্চয়ই এমনাটা আশা করছেন না যে আমি লিখবো, ‘ওহ! আমার জানা ছিলো না শিশুরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে। তাই এখন থেকে মানুষ এই সমস্যা সমাধান করতে না পারা পর্যন্ত আমি সকল মহাকাশ গবেষণা থেকে বিরত থাকব।’
আসলে মঙ্গল গ্রহে যাত্রা করা যে প্রযুক্তির সাহায্যে সম্ভব, তার অনেক আগে থেকেই আমি দুর্ভিক্ষের শিকার শিশুদের সম্পর্কে জেনেছিলাম। তবে আমি বিশ্বাস করি চাঁদে ভ্রমণ, মঙ্গল গ্রহে ভ্রমণ এবং অন্যান্য গ্রহে ভ্রমণ এমন একটি উদ্যোগ যা আমাদের এখনি নেয়া উচিত। আর এটাও বিশ্বাস করি দীর্ঘমেয়াদে এর অবদান হবে ব্যাপক। যদিও এই ধরনের প্রকল্পের বাস্তব ফলাফল অনেক ধীরগতির। তবে আমাদের পৃথিবীর অনেক গুরুতর সমস্যা সমাধানের জন্যে এসব মহাকাশ গবেষণার গুরুত্ব রয়েছে।
মহাকাশ নিয়ে গবেষণা আমাদের পৃথিবীতে থাকা সমস্যা সমাধানে কীভাবে অবদান রাখছে তা বিশদভাবে বর্ণনার চেষ্টা করার আগে আমি একটা ঘটনা সংক্ষেপে আপনাকে জানাতে চাই। ঘটনাটি আনুমানিক ভাবে সত্য। কেননা ঘটনাটি আমার দেওয়া যুক্তির পক্ষে একটি উদাহরণ। প্রায় ৪০০ বছর আগে জার্মানির এক ছোটো গ্রামে এক কাউন্ট (রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাত বংশগত শাসক শ্রেণির বিশেষ একটি পদ হলো কাউন্ট) ছিলেন। তিনি তাঁর আয়ের একটি বড়ো অংশ দরিদ্রদের দিয়েছিলেন। এ কাজের কারণে তিনি অনেক প্রশংসা পান। কারণ মধ্যযুগীয় সময়ে প্রচুর দারিদ্রতা ছিল আর একই সাথে ছিল মহামারী প্লেগ। একদিন সেই কাউন্টের সাথে গ্রামের এক ব্যক্তির দেখা হয়। সেই ব্যক্তি দিনে কঠোর পরিশ্রম করতেন যাতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি নিজের তৈরি করা গবেষণাগারে কাজ করতে পারেন। তার বাড়ির সেই ছোট্ট গবেষণাগারে ছোট্ট কাচের টুকরা এবং টিউবয়েলের নল ব্যবহার করে তিনি ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র বস্তু দেখার একটি যন্ত্র বানান। তার কাজগুলো দেখে কাউন্ট খুবই খুশি হন। কাউন্ট তাকে তার দুর্গে আমন্ত্রণ জানান এবং সেখানেই গবেষণা কাজ করার নির্দেশ দেন।
কাউন্টের এই সিদ্ধান্তে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়। তারা বুঝতে পারে যে কাউন্ট তার অর্থ নষ্ট করছে। এলাকাবাসী মনে করতে থাকে তারা একদিকে প্লেগের মতো মহামারীতে আক্রান্ত আর অন্যদিকে যেসব কাজের কোন উদ্দেশ্য নেই সেসব কাজে কাউন্ট অর্থের অপচয় করছেন।
কিন্তু কাউন্ট তার সিদ্ধান্তের প্রতি অটল থাকেন। তিনি লোকটিকে এও বলেন, তুমি তোমার মতো কাজ করে যাও। আমি তোমাকে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী দেব।
পরবর্তীতে তার এই কাজের ফলাফলকে ব্যবহার করে আমরা পেয়েছি মাইক্রোস্কোপ এবং আমরা সবাই জানি ঔষধ বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মাইক্রোস্কোপের অবদান ব্যাপক। ফলে বিশ্বব্যাপী প্লেগ এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।
কাউন্ট গবেষণা এবং আবিষ্কারের জন্য যে অর্থ ব্যয় করেছেন তা প্লেগ দূরীকরণে প্লেগ আক্রান্ত মানুষদেরকে অর্থ দেয়ার চেয়ে অনেক বেশি অবদান রেখেছে।
বর্তমানে আমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি তা অনেকটাই এরকম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি তার বার্ষিক বাজেটে প্রায় দুইশত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন। এই অর্থ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কল্যাণ, পরিবহন নগর উন্নয়ন, বিজ্ঞান, বৈদেশিক সাহায্য, কৃষি সহ নানা খাতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে খরচ হবে। এই বছর বাজেটের প্রায় ১.৬ শতাংশ মহাকাশ গবেষণার কাজে বরাদ্দ করা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে প্রজেক্ট অ্যাপেলো, স্পেস ফিজিক্স, স্পেস অ্যাস্ট্রোনমি, স্পেস বায়োলজি, প্ল্যানেটারি প্রজেক্ট, আর্থ রিসোর্স প্রজেক্ট এবং স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং সহ আরো অনেক প্রকল্প। একজন আমেরিকান করদাতা যিনি বছরে দশ হাজার ডলার আয় করেন তিনি প্রায় ৩০ ডলার ট্যাক্স প্রদান করেন মহাকাশ গবেষণার কাজের জন্য। তার বাকি ৯,৯৭০ ডলার তার জীবিকা, সঞ্চয়, বিনোদন, অন্যান্য ট্যাক্স এবং আনুষঙ্গিক সকল ব্যয়ের জন্য অবশিষ্ট থাকে।
আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন- “প্রত্যেক করদাতার সেই ৩০ ডলার থেকে কেনো ৫ ডলার অথবা ৩ ডলার অথবা ১ ডলার নিয়ে ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে না?” যদি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই তাহলে আমাকে এদেশের অর্থনীতি কীভাবে চলে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে হবে। যা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও একই। সরকার বেশ কয়েকটি বিভাগ (স্বরাষ্ট্র, বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিবহন, প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য) এবং ব্যুরো (ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স এন্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন এবং অন্যান্য) নিয়ে গঠিত। তাদের সকলেই তাদের নির্ধারিত কাজ অনুসারে বাজেট প্রস্তুত করে। রাষ্ট্রপতি এবং কংগ্রেশনাল কমিটিগুলোর কঠোর তদারকির মধ্য দিয়ে তাদের বাজেট রক্ষা করতে হয়।
ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স এন্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশনের বাজেটে কেবলমাত্র অ্যারোনোটিক এবং মহাকাশের সাথে সম্পর্কিত জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছু থাকবে না। আবার যদি এই বাজেট কংগ্রেস দ্বারা অনুমোদন না পায়, তবে এর ফান্ড মহাকাশ ব্যতিত অন্য কিছুর জন্য ব্যবহার করা হবে না। যদি অন্য সব বাজেটের একটি নির্দিষ্ট বৃদ্ধির অনুমোদনও না পায় বা এই বাজেটটি স্পেস ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহার না হয়, তবে এর সাধারণ ট্যাক্স-পেয়ারদের কাছ থেকে ট্যাক্স ধার্য করা হবে না।
আপনি এখন জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে, আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারের এমন পদক্ষেপের পক্ষে থাকবো কিনা; এবং জোরালোভাবে আমার উত্তর হলো ‘হ্যাঁ‘। এমন কি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসবাসরত ক্ষুধার্ত শিশুদের খাবারের জন্য যদি আমার বার্ষিক ট্যাক্স কয়েক ডলার বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাতে আমি মোটেও আপত্তি করব না।
আমি জানি যে, আমার সব বন্ধুরা এমনটাই মনে করে। মঙ্গল গ্রহে অভিযানের পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে বিশেষ কোনো প্রকল্প হয়তো আমি দাঁড় করাতে পারবো না। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি যে, মহাকাশ প্রোগ্রামের জন্য কাজ করার মাধ্যমে পৃথিবীর দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার মত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে অবদান রাখা সম্ভব। ক্ষুধা সমস্যার সমাধানের মূলত দুটি কাজ: খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য বিতরণ। খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান রয়েছে যেখানে কৃষিকাজ, গবাধি পশুপালন, সমুদ্রে মাছ ধরা, ইত্যাদি কাজের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু অন্যান্য অনেক অঞ্চলে এর ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রন সার ব্যবহার, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, মাটির উর্বরতা মূল্যায়ন, ফসলি জমি নির্বাচন, শস্য রোপনের অভ্যাস, চাষের সময় নির্ধারণ, শস্য জরিপ এবং ফসল কাটার পরিকল্পনার প্রয়োগ করা সহ নানা প্রকল্প সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে বিশাল এলাকা আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এসব কাজের জন্য কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ এর ব্যবহার খুবই ফলপ্রসূত। এটি পৃথিবী হতে নির্দিষ্ট উচ্চতায় অবস্থান করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভূমির বিস্তৃত অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করতে পারে। বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, মাটির অবস্থা, খরা সহ নানা তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে প্রদান করে। তাই এটি বিশ্বব্যাপী কৃষির উন্নতির জন্য একটি অনবদ্য উপায়। যা বার্ষিক ফসল বহু বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
অন্যদিকে অভাবীদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সমস্যা। সমস্যাটি শুধু বিতরণ ব্যবস্থার উপরেই নয় বরং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উপরও নির্ভর করছে। কেননা খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে তুলনামূলক ক্ষুদ্র একটি জাতির শাসক অন্য একটি বৃহৎ জাতির শাসকের রপ্তানি করা খাদ্য নেয়ার ক্ষেত্রে অস্বস্তি বোধ করতেই পারেন। কেননা খাদ্য পণ্য আমদানির পাশাপাশি বিদেশি শক্তির আমদানিও হয়ে যেতে পারে।
আমার ভয় হয় ক্ষুধার সমস্যা দূরীকরণে জাতিগত বৈষম্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যাই হোক এসব বিষয়ে কাজ করার জন্য যেসব প্রগতিশীল এবং শক্তিশালী এজেন্ট রয়েছে তাদের মধ্যে মহাকাশ বিষয়ক প্রকল্পগুলো অন্যতম।
উদাহরণস্বরূপ আমি আপনাকে এপোলো ১৩ মিশনের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। যখন মহাশকারীরা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে পুনরায় ফিরে আসে তখন এপোলো মিশনের ব্যবহৃত ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের সকল রাশিয়ান রেডিয়ো ট্রান্সমিশন গুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন বন্ধ করে দেয় যাতে কোনো প্রকারের জটিলটা দেখা না দেয়। যদি মহাকাশচারীদের ক্যাপসুলটি যেটি সমুদ্র অবতরণ করেছে সেগুলো রাশিয়ান জাহাজ গুলোর কাছে অবতরণ করত, তাহলে নিঃসন্দেহে রাশিয়ার জাহাজ গুলো মহাকাশচারীদের উদ্ধার করতে ততটাই আন্তরিক এবং সচেষ্ট হতেন যতটা রাশিয়ান মহাকাশচারীরা মহাকাশ থেকে ফিরে আসলে করতেন। একইভাবে যদি রাশিয়ান মহাকাশচারীরা কখনো একই রকম জরুরি পরিস্থিতিতে পারেন কোনো সন্দেহ নেই আমেরিকানরা একই কাজ করবে।
মহাকাশ কর্মচারী পৃথিবীর জীবনকে যে কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করবে তার দুটি মাত্র উদাহরণ হল কক্ষপথ থেকে জরিপ ও মূল্যায়ন কাজ পরিচালনার মাধ্যমে অধিক খাদ্য উৎপাদন এবং উন্নত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাধ্যমে উন্নত খাদ্য বিতরণ। আমি একটি গত উন্নয়নের যে উদ্দীপনা আছে সেটি এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পন্ন প্রজন্ম সম্পর্কে আরো দুটো উদাহরণ উদ্ধৃত করতে চাই।
চাঁদে ভ্রমণ করার মতো একটি যানের প্রতিটি উপাদান তৈরিতে প্রয়োজন পরিপূর্ণ নির্ভুলতা, যাতে চরমভাবে নির্ভর করা যায়। এ ধরনের উপাদান তৈরি প্রকৌশল বিজ্ঞানের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। চাঁদে ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার স্বার্থে বিকশিত হয়েছে আধুনিক সিস্টেম এবং নতুন উপাদান। সুযোগ হয়েছে নতুন পদ্ধতি সন্ধান করার। একই সাথে আমরা পেয়েছি যন্ত্র ব্যবহারকে দীর্ঘায়িত করার মত পদ্ধতি আবিষ্কারের একটি অনন্য সুযোগ।
এসব নতুন নতুন আবিষ্কার পৃথিবীতে ব্যবহৃত প্রযুক্তিতেও কাজে লাগছে। প্রতিবছর মহাকাশ প্রোগ্রামের কারণে উদ্ভাবিত হাজারো নতুন প্রযুক্তি আমাদের পৃথিবীর জীবনকে করেছে আরো সহজ রান্নাঘরের আসবাবপত্র থেকে খামারের সরঞ্জাম, ভালো সেলাই মেশিন থেকে রেডিও, উন্নত মানের জাহাজ, বিমান, আবহাওয়ার পূর্বাভাস সকল ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছি উন্নতি। যোগাযোগ ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসার যন্ত্র, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি সবক্ষেত্রেই আমরা পেয়েছি নতুনত্ব।
আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, কেন আমাদেরকে হৃদরোগীদের জন্য রিমোট রিডিং সেন্সর সিস্টেম তৈরি করার আগে চাঁদে ভ্রমণকারী মহাকাশচারীদের জন্য একটি লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করতে হবে। উত্তরটা অনেক সহজ। প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি প্রায়শই সরাসরি পদ্ধতির মাধ্যমে হয় না। এর জন্য তুলনামূলক চ্যালেঞ্জিং একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করলে এটা উদ্বোধনী কাজের জন্য মানুষকে উৎসাহ প্রদান করে। ফলে মানুষ তার কল্পনা শক্তির পূর্ণ ব্যবহার করতে পারে।
কোনো প্রকার সন্দেহ ছাড়াই মহাকাশযান ঠিক এই ভূমিকাটাই পালন করছে। এটা সত্য যে মঙ্গল যাত্রা অবশ্যই ক্ষুধার্তদের জন্য সরাসরি খাবারের উৎস হবে না। যাই হোক এই প্রকল্প আমাদেরকে নতুন প্রযুক্তি ও ক্ষমতার দিকে এতটাই পরিচালিত করবে যে এ প্রকল্পগুলোর ফলাফল হবে বহু গুণে মূল্যবান।
যদি আমরা মানব জাতির উন্নতি চাই তাহলে নতুন এই প্রযুক্তির পাশাপাশি বিজ্ঞানের নতুন মৌলিক জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাও ব্যাপক।
মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে এমন সমস্যা যেমন ক্ষুধা, রোগ, খাদ্য ও পানি দূষণ, পরিবেশ দূষণ মোকাবেলা করার জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যা এবং রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং শারীরবিদ্যায়; বিশেষ করে ওষুধ শাস্ত্রে আরও জ্ঞানের প্রয়োজন।
আমাদের আরো তরুণ-তরুণী প্রয়োজন যারা বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চায়, পাশাপাশি সেসব বিজ্ঞানী যাদের প্রতিভা রয়েছে এবং রয়েছে ফলপ্রসূত গবেষণা কাজে নিয়োজিত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প, তাদেরকে আরো ভালো সমর্থন দেয়া প্রয়োজন। চ্যালেঞ্জিং বিভিন্ন গবেষণার উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে হবে, পাশাপাশি সেই সব গবেষণাকে পূর্ণ সমর্থন করতে হবে। জীববিজ্ঞান এবং ওষুধের দুর্দান্ত গবেষণা জড়িত থাকার বিস্ময়কর সুযোগ থাকার পাশাপাশি মহাকাশ বিষয়ে প্রকল্পও হবে বৈজ্ঞানিক কাজে প্রেরণা, পর্যবেক্ষণের সুযোগ এবং সে অনুযায়ী ফলাফল সৃষ্টি করবে।
আমেরিকান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত সকল কার্যক্রমের মধ্যে মহাকাশ বিষয়ে প্রকল্প নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মতো এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত। অথচ মহাকাশ গবেষণা-র বাজেট জাতীয় বাজেটের মাত্র ১.৬ শতাংশ। নতুন প্রযুক্তির বিকাশে এবং মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি অনন্য প্রকল্প। নতুন প্রযুক্তি অনুসন্ধান শুধু মাত্র মৌলিক বিজ্ঞানকেই প্রভাবিত করে না বরং মহাকাশ বিষয়ে গবেষণা তিন বা চার হাজার বছরের যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি বিশেষত্ব বহন করে।
সকল জাতি যদি বোমারু বিমান বা বোমারু রকেট নিয়ে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা না করে চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর প্রতিযোগিতা করে তবে আমাদের জন্য অনেক দুর্ভোগ এড়ানো যাবে। এই প্রতিযোগিতাই মানব জাতির উজ্জ্বল বিজয়ের প্রতিশ্রুতি। যেখানে পরাজিতদের জন্য প্রতিশোধ কিংবা নতুন যুদ্ধ জন্মানোর কোন সুযোগই থাকে না।
যদিও আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় মহাকাশ কর্মসূচি গুলো আমাদের পৃথিবী থেকে দূরে থাকা চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। তবে আমি বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর চেয়ে বেশি মনোযোগ বিজ্ঞানীরা মহাকাশের আর কোন কিছুতেই দেন না। শুধুমাত্র নতুন প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়েই জীবন ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে না, বরং পুরো পৃথিবী, জীবনব্যবস্থা এবং মানুষের চিন্তাধারাও উন্নত হচ্ছে সময়ের সাথে।
আমি যেই ছবিটি এই চিঠির সাথে যুক্ত করেছি যেটা ১৯৬৮ সালের ক্রিসামাসে এপোলো ৮ মিশনে তোলা হয়েছিলো। হতে পারে এখন পর্যন্ত যত মহাকাশ গবেষণা অভিযান হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ছবিটি। এই ছবি যেনো আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে সীমাহীন এই শূন্যতার মধ্যে আমাদের এই পৃথিবী সুন্দর একটি দ্বীপ। আমাদের এই গ্রহের পৃষ্ঠে থাকা পাতলা স্তর ছাড়া এই অন্ধকার মহাশূন্যে আমাদের থাকার আর কোনোই স্থান নেই। আমাদের এই পৃথিবী যে আসলে কতটা সীমিত আর এর পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করা কতটা বিপদজ্জনক তা হয়তো আগে কখনোই এতো মানুষ বুঝতে পারেনি। এই ছবিটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এই সময়ে মুখোমুখি হওয়া সকল সমস্যা যেমন দূষণ, ক্ষুধা দারিদ্র্য, খাদ্য উৎপাদন, বিশুদ্ধ পানি নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এসবের বিষয়ে মানুষের আওয়াজ যেনো আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। বর্তমানে আমরা আমাদের সময়ের সবচেয়ে দূর্দান্ত কাজ গুলো দেখতে পাচ্ছি যখন সমসাময়িক যুগ নিজের গ্রহের সবচেয়ে ভালো ছবিটি দেখার সুযোগ পাচ্ছে, নিঃসন্দেহে এটা হঠাৎ করেই হয়ে যায়নি।
সৌভাগ্যবশত মহাকাশ নিয়ে কাজ করার সময়টা শুধুমাত্র একটি আয়নার মতোই নয় যাতে আমরা নিজেদেরকে দেখতে পারি, পাশাপাশি এটা আমাদেরকে দেয় নতুন প্রযুক্তি, নতুন চ্যালেঞ্জ, আর অনুপ্রেরণা। এমনকি এই কাজগুলোকে আত্মবিশ্বাসের সাথে করার আশাবাদও যোগায়। আমাদের স্পেস প্রোগ্রামে আমরা যা শিখি, আমি বিশ্বাস করি তা আলবার্ট সোয়েটজারের বলা কথাটাকেই সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করছে। তিনি বলেছিলেন, “আমি উদ্বেগের সাথে ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছি কিন্তু ভালো আশা নিয়ে”।
আমার শুভকামনা সব সময় আপনার এবং আপনার সন্তানের সাথে থাকবে।
ইতি
আপনার আন্তরিকতায়,
আর্নস্ট স্টুলিঙ্গার
এসোসিয়েট ডাইরেক্টর অব সাইন্স।
জুম্মান আল সিয়াম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Letters Of Note, Wikipedia, Wikipedia, Wikipedia, Britanica