সম্প্রতি মহাকাশ গবেষণার বিষয়টি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মহাকাশ গবেষণা ও গবেষকদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ মানুষের কম নয়। মহাকাশভ্রমণ মস্তিষ্কে কী প্রভাব ফেলে তার রহস্য ভেদ করতে দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে গবেষণা। সম্প্রতি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডার গবেষকরা তা নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। আর তা হলো ব্রেইন ক্যাভিটির/মস্তিষ্কের গহ্বরের মধ্যে পরিবর্তন।
দীর্ঘদিন মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফেরার পর নভোচারীদের বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়। নভোচারীরা যখন মহাকাশে অবতরণ করেন সেই সময়টা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণার। শুরুর দিকে মাইক্রোগ্র্যাভিটি কারণে আকাশে ওড়ার মতো আনন্দ হলেও পরে সেটাকে আর আনন্দ বলা যায় না। চলুন এই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
মানবমস্তিষ্কের চারটি ভেন্ট্রিকল(সেরিব্রোস্পাইনাল তরল/CSF দ্বারা ভরা গহ্বর যা মস্তিষ্ককে ঘিরে থাকে, টিস্যুকে পুষ্ট করে এবং বর্জ্য অপসারণ করে)। ভেন্ট্রিকল ৪টি : দুটি পার্শ্বীয় ভেন্ট্রিকল-মস্তিষ্কের দুটি গোলার্ধে একটি করে থাকে, মস্তিষ্কের কেন্দ্রের কাছে ব্রেনস্টেমে তৃতীয় ভেন্ট্রিকল এবং চতুর্থ ভেন্ট্রিকল থাকে। মহাকাশচারী যখন মহাকাশে যায় তখন তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকলগুলো ফুলে বড় হয়ে যায়।
মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকল চারটিই মেরুদন্ডের সাথে যুক্ত এবং ভেন্ট্রিকল থেকে মেরুদণ্ডে সেরিব্রাস্পাইনাল ফুইড/CSF নিয়মিত চলাচল করে। মহাকাশে অভিকর্ষজ ত্বরণ শূণ্য থাকে। তাই কোনো মহাকাশচারী মহাকাশে যায় তখন ভেন্ট্রিকল থেকে মেরুদণ্ডের CSF এর প্রবাহ উল্টোদিকে চলতে থাকে অর্থাৎ মেরুদন্ড থেকে ভেন্ট্রিকলের দিকে যেতে থাকে। ফলে ভেন্ট্রিকলগুলো তরলে পরিপূর্ণ হয়ে ফুলে আকার বৃদ্ধি পায়।
মহাকাশচারী যখন পৃথিবীতে ফিরে আসে তখন ভেন্ট্রিকল থেকে মেরুদণ্ডে CSF এর স্বাভাবিক প্রবাহ শুরু হয় কিন্তু ভেন্ট্রিকলের আকার স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগে। অর্থাৎ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে থাকাকালীন সময় মহাকাশচারীদের মস্তিষ্কের তরলভর্তি গহ্বর প্রসারিত হয়ে শূণ্য অভিকর্ষজ ত্বরণ এর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
কিন্তু একটি মহাকাশ অভিযানের পর এই কাঠামোগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে তিন বছর সময় লাগতে পারে। গবেষণার এক অনুসন্ধানে জানা গেছে যে মহাকাশচারীদের আবার মহাকাশে যাওয়ার জন্য কমপক্ষে ততটুকু সময় প্রয়োজন যতটুকু সময়ের মধ্যে মহাকাশচারীর মস্তিষ্কের আকার স্বাভাবিক হবে।
গেইন্সভিলের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ বিজ্ঞানী রাচেল সিডলার বলেছেন,
“মহাকাশে সামান্য মাধ্যাকর্ষণ থাকার কারণে একজন নভোচারীর মস্তিষ্কের তরলগুলো একত্রিত হয়ে জমা হয়। তাই ভেন্ট্রিকলগুলো আরও তরল গ্রহণ করে এবং প্রসারিত হওয়ার মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেয়।”
মহাকাশভ্রমণ মানুষের শরীরের জন্য একটা খারাপ অভিজ্ঞতা হতে পারে। মহাকাশে দীর্ঘ সময় কাটানোর ফলে হাড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে, পেশির অ্যাট্রোফি হতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে পারে, চোখ কিছুটা চ্যাপ্টা হয়ে যেতে পারে এবং অপটিক নার্ভ ফুলে যেতে পারে। মহাকাশে থাকাকালীন সময় কসমিক রেডিয়েশন/মহাজাগতিক বিকিরণ এর প্রভাব মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
ভেন্ট্রিকলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পিটুইটারি গ্রন্থির বিকৃতি ঘটাতে পারে। বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণাপত্র অনুসারে খুব বেশি সময় মহাকাশে থাকার ফলে মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকেল অতিরিক্ত ফুলে যেতে পারে। মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে ফিরে আসার পরে, এই অস্বাভাবিক অবস্থাটি ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ফিজিওলজি এবং কাইনেসিওলজির অধ্যাপক এবং গবেষণার অন্যতম লেখক এক বিবৃতিতে বলেছেন,
“আমরা দেখতে পেয়েছি যে মানুষ যত বেশি সময় মহাকাশে কাটাবে তাদের ভেন্ট্রিকেলগুলো তত বড় হয়ে ওঠে।”
অনেক মহাকাশচারী একাধিকবার মহাকাশে ভ্রমণ করেন এবং গবেষকরা স্পেস বা মহাকাশভ্রমণ এর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবক কমানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবনের কাজ করছে।