বাংলাদেশে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবছর কিউলেক্স মশার সংখ্যা চারগুণ হয়ে গেছে। তার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মশা-বাহিত রোগবালাইয়ের পরিমাণ ও মানুষের ভোগান্তি।আমরা দেখেছি, গত বছরগুলিতে বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি মহামারী আকার ধারণ করেছিল। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেশে মশা নিধন-এর জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়; যা পরিবেশ ও মানুষের শরীর উভয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
কেমন হতো যদি মশা থেকে বাঁচতে আমাদের পরিবেশেরই কোন উপাদান ব্যবহার করা যেতো? যেমন ধরেন, মাছ দিয়ে মশা নিধন করতে চাই। এমনটা কি আসলেই সম্ভব হবে?
-হ্যাঁ, সম্ভব। সাম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ জৈবিক পদ্ধতিতে মশার উৎপত্তিস্থলে মাছ চাষের মাধ্যমে মশা নিধনে সাফল্য পেয়েছেন। এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার গবেষণার কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, শুধু দেশি প্রজাতির মাছ দিয়েই এটি সম্ভব।
অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ জানান, মশা সাধারণত বদ্ধ পানিতে ডিম ছাড়ে। এই ডিম পর্যায়ক্রমে লার্ভা থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়। শুধু ওষুধ ছিটিয়ে এককভাবে এই মশা দমন করা কখনই সম্ভব নয়। তাই মশার বিস্তার রোধে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনাগুলো মূলত ‘জৈবিক বালাইদমন পদ্ধতি’ যা দীর্ঘমেয়াদি কিন্তু টেকসই ও কার্যকর। মশা নিয়ন্ত্রণে পার্শ্ববর্তী সফল দেশগুলোর (ভারত, ভিয়েতনাম) দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, সারা বছর ধরে বেশ কিছু জৈবিক (মশাভুক মাছ) ও রাসায়নিক দমন পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছেন তারা। আমরা তাদের অনুসরণ করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সমন্বিত কাজ ছিল না। আর এই কারণেই জৈবিক উপায়ে মশা নিধনের জন্য চট্টগ্রামে একটি গবেষণা শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল মশার লার্ভা ভক্ষণের জন্য দেশি জাতের কিছু মাছের সঙ্গে বিদেশি জাতের মাছের দক্ষতা তুলনা করা।
এটি করতে গিয়ে আমরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন ড্রেন ও নর্দমার নোংরা পানিতে প্রচুর পরিমাণ ‘মসকুইটো ফিশ’ পেয়েছি এবং এরা এই নোংরা পানিতে খুব ভালো মতোই বেঁচে থাকতে পারে। তাদের পেট কেটে দেখেছি প্রচুর পরিমাণে মশার লার্ভা। এই মাছটি কিছুটা আমাদের দেশি দাড়কিনা মাছের মতো দেখতে এবং শহরের অ্যাকুরিয়াম দোকানগুলোতে বিক্রি হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামে বেশ কয়েক বছর আগে এই মাছ ও গাপ্পি ছাড়া হয়েছিল শুনেছি।”
“আমি চট্টগ্রামের ড্রেনে গাপ্পি তেমন দেখিনি, কিন্তু এই ‘মসকুইটো ফিশ’ প্রচুর পরিমাণে দেখেছি। এ মাছগুলো ড্রেনের নোংরা পানিতে শুধু বছরের পর বছর টিকে আছে তাই নয়, বংশ বিস্তারও করছে। সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ মশার লার্ভা খেয়ে আমাদের সাহায্য করছে।”
“পরবর্তীতে ‘মসকুইটো ফিশ’ ছাড়াও আরো কিছু দেশি-বিদেশি মাছ ল্যাবরেটরিতে আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, বিদেশি ‘মসকুইটো ফিশ’ বা গাপ্পির তুলনায় মশক লার্ভা ভক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশি জাতের খলিসা মাছের দক্ষতা প্রায় দ্বিগুণ। বিদেশি মাছের তুলনায় দাড়কিনা মাছের দক্ষতাও ভালো কিন্তু ড্রেন বা নর্দমার পানিতে এই মাছ বেশিদিন টিকে না। অন্যদিকে খলিসা শুধু মশার লার্ভা ভক্ষণের জন্যই ভালো নয়, বরং এটির ড্রেনের পানিতে অভিযোজন ও টিকে থাকার ক্ষমতার হারও ভালো। এসব মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনও খুবই সহজ।”
গবেষক অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ মনে করেন, মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য মাছগুলো যাতে হারিয়ে না যায় এজন্য দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো এসব মাছ শহরের বদ্ধ জলাগুলোতে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর ছেড়ে দিতে পারে। এতে করে এসব জলাশয়ে মশা ডিম ছাড়লে উৎপন্ন লার্ভা খেয়ে দেশি মাছগুলো মশা দমনে অনেক অবদান রাখবে।
দেশের স্বার্থে এক্ষেত্রে এ পোনা প্রযুক্তি সরবরাহ, পোনা উৎপাদনের প্রশিক্ষণ সহায়তা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ বাকৃবি মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের বিশেষজ্ঞ দল বিনা পারিশ্রমিকে সহায়তা প্রদান করবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ কালের কণ্ঠ, জাগোনিউজ, বাংলাদেশ প্রতিদিন