পৃথিবীর শুরু থেকেই প্রয়োজন মেটাতে মানুষ ছুটে চলেছে আধুনিকায়নের দিকে। কিন্তু এই অগ্রযাত্রায় আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি প্রকৃতির মূল্যবান জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণে অবদান রাখতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানী দম্পতি সায়মা জাহান ও জহির রায়হান করছেন প্রশংসনীয় কাজ। সম্প্রতি তারা নতুন এক গণ ও প্রজাতির মথ আবিষ্কার ও নামকরণ করে কীটতত্ত্বের জগতে এনেছেন এক অভূতপূর্ব সংযোজন। তাদের এই গবেষণার পথচলা কেমন ছিল? চলুন, মথ নিয়ে এই অসাধারণ দম্পতির রোমাঞ্চকর গবেষণার গল্পটাই আজ জেনে নেওয়া যাক!
প্রথমেই আপনাদের পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাই। আপনাদের নাম, বেড়ে উঠা, পড়াশোনা এবং বর্তমানে কী করছেন।
সায়মা জাহান: আমি সায়মা জাহান। আমার বাড়ি চাঁদপুর, পড়াশোনা আসলে যেসময় যে জায়গায় ছিলাম সেখানেই পড়াশোনা করেছি। ছোট থাকতে চাঁদপুরে পড়েছি, এরপরে সিলেট, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ঢাকা, পরবর্তীতে শেষ স্থান চট্টগ্রাম। সম্প্রতি আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স কমপ্লিট করেছি। এই মূহুর্তে আমি গবেষণার কাজে যুক্ত, মূলত মথ নিয়ে আমাদের একটি জয়েন্ট রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করছি। সামনে মাস্টার্স এর জন্য দেশের বাইরে আবেদন করবো, এই তো!
জহির রায়হান: আমি জহির রায়হান। আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা পিরোজপুর জেলার বরিশাল বিভাগে। আমার এসএসসি মূলত এই স্থান থেকেই, কিন্তু এইচএসসি দিয়েছিলাম রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে। আমিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স কমপ্লিট করেছি এবং বর্তমানে আমি আছি “ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা” তে। এখানে “ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি” নামে একটা জাদুঘর আছে এবং এই জাদুঘরের একটা রিসার্চ সেন্টার রয়েছে যেখানে শুধুমাত্র মথ এবং প্রজাপতি নিয়েই গবেষণা করা হয়। এর নাম হচ্ছে, “The McGuire Center for Lepidoptera and Biodiversity,” এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং ইউনিভার্সিটির সাথে সম্পৃক্ত একমাত্র রিসার্চ সেন্টার।
আমি বর্তমানে এখানে আছি একজন রিসার্চ স্কলার হিসেবে। আমি এখানে মথ ও প্রজাপতির সিল্কের কীভাবে বিবর্তন ঘটছে সে বিষয় নিয়ে কাজ করছি। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন যে Pest species রয়েছে, বিশেষ করে Tuta absoluta, এটি মূলত টমেটো গাছের pest এবং এটি বাংলাদেশেও পাওয়া যায়, এই প্রজাতির মূল অরিজিন হচ্ছে নর্থ আমেরিকাতে, কিন্তু বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রজাতি নর্থ আমেরিকা থেকে উৎপত্তি হয়ে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে অঞ্চলভেদে এই কীটে কী কী জেনেটিক ভ্যারিয়েশন এসেছে তা খুঁজে বের করার এই বায়োজিওগ্রাফিক প্রজেক্টেও কাজ করছি। বর্তমানে মূলত এই দুইটি প্রজেক্ট নিয়েই কাজ চলছে।
প্রজাপতি ও মথ নিয়ে গবেষণার প্রতি আপনাদের আগ্রহ কিভাবে শুরু হয়েছিল? কোনো বিশেষ ঘটনা বা অভিজ্ঞতা কি আপনাদের এই পথে আসতে অনুপ্রাণিত করেছিল?
জহির রায়হান: আসলে আমার বাড়ি সুন্দরবনের কাছে হওয়ায় সুন্দরবনের আবহাওয়া, জীববৈচিত্র্য সবসময়ই আমাকে আকর্ষণ করতো, এখনও মুগ্ধ করে। যেমন ছোটবেলায় আমার কাছে প্রথম এরকম আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সুন্দরী গাছের শ্বাসমূল, সব গাছের শিকড় মাটির নিচে যায় কিন্তু এই গাছের শিকড় মাটির উপরে আসে কেন! তো এই ধরনের কৌতূহল থেকেই আমি ধীরে ধীরে জীববৈচিত্র্যের সাথে সম্পৃক্ত প্রাণীগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে থাকি। আবার আমার কৃষিভিত্তিক পরিবার হওয়ার কারণে, মথের কিছু প্রজাতি আছে যেগুলো ধান গাছের জন্য ক্ষতিকর, সেগুলো সম্পর্কে নানানভাবে জানতে শুরু করি।
এরপরে যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন আমাদের প্রথম বর্ষে ডা. রাজীব আচার্য নামে একজন প্রফেসর পড়াতেন, উনি মূলত পানিতে যে প্ল্যাঙ্কটন পাওয়া যায়, সেই প্ল্যাঙ্কটনের বিভিন্ন প্রজাতি কীভাবে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় সেগুলো সম্পর্কে আমাদের শিখাতেন। তো উনার পড়ানো থেকেই আমার মাঝেও অনুপ্রেরণা জন্মায় যে আমিও তাহলে বিভিন্ন প্রাণীর প্রজাতি সম্পর্কে জেনে, তাদের শনাক্তকরণ বা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারি। তো এই মুগ্ধতাই যে কীভাবে হঠাৎ মথে যেয়ে আটকালো নিজেও জানি না। আসলে ওই যে বলে না যে ভালবাসতে কোনো কারণ লাগে না, আমার মথের প্রতি আকর্ষণের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছে। শুরু হয়েছিল অনেক কিছুর প্রতি আকর্ষণ দিয়ে, কিন্তু শেষে স্থিত হলাম মথে।
সায়মা জাহান: এখানে একটা জিনিস মিসিং আছে, সেটা হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জহির এই মথগুলো ওর হলের ওয়াশরুমে দেখতো। তো সেই ওয়াশরুম থেকে মথের ছবি নিয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে এগুলোর পরিচয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতো। তো একসময় এভাবেই ওর প্রাত্যহিক দিনের কাজ হয়ে যায় যে যখন সবাই বাইরে আড্ডা দেয়, তখন সে হলগুলোর ওয়াশরুমে যেয়ে যেয়ে এই মথগুলোর ছবি তুলে নিয়ে আসে এবং এগুলোর পরিচয় খুঁজে বের করে। তো এভাবেই আসলে মথের প্রতি তার আকর্ষণ আরো বাড়তে থাকে।
ক্যাম্পাসে অজানা মথের লার্ভা খুঁজে পাওয়ার মুহূর্তটি সম্পর্কে জানতে চাই। তখন কি মনে হয়েছিল যে, আপনারা একটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে আছেন?
জহির রায়হান: আসলে এই মথ প্রজাতির নামকরণের আগেও আমরা আরও দুইটি নতুন মথ প্রজাতির আবিষ্কার এবং নামকরণ করেছিলাম আমাদের ক্যাম্পাস থেকেই। তো ওই দুইটি প্রজাতি আবিষ্কারের পরেই সভাপতি আমাদের এরকম ফিল্ডে যাওয়া এবং অবজার্ভেশনের কাজ করার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে থাকলো। তো আমরা সম্প্রতি মথের যে প্রজাতিটা আবিষ্কার করলাম সেটা আমাদের ক্যাম্পাসে খুব বেশি দেখা যায়, কিন্তু এই ধরনের মথ এর আগে আমি সেভাবে দেখিনি। বিশেষ করে, এই মথ পাতার উপরে এক অনন্য ধরনের সিল্কের একটা স্তর তৈরি করে এবং তার ভিতরেই থাকে, এই জিনিসটা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। তো এই আকর্ষণ থেকেই আমি একে বাসায় নিয়ে আসি এবং চিন্তা ছিল যে মথটাকে লালন-পালন করে একটু বড় করে দেখি যে কী হয়! কিন্তু আসলে তখনও জানতাম না বা ভাবিনি যে এইটা নতুন কোনো প্রজাতি হবে, শুধুমাত্র আগ্রহ থেকেই নিয়ে আসা।
সায়মা জাহান: আসলে আমরা ফিল্ডওয়ার্ক করতে করতে একটা সময় বুঝি যে কোন জিনিসটা কমন বা কোনটা নতুন। শুরুর দিকে তো আমরা কমন মথগুলোকেই বাসায় নিয়ে যেতাম এবং সেগুলোকে লালন-পালন করে বড় করে তুলে দেখতাম। একটা সময় থেকে আমরা কমনগুলোকে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করি এবং নতুন মথগুলোকে বাসায় নিয়ে যাওয়া শুরু করি যে দেখি এইটা বড় হয়ে কীরকম হয়। তো বড় হওয়ার পরেই আসলে বুঝা যেত যে এটা কী নতুন নাকি কমনই।
জহির রায়হান: আমার বাসার মূলত একটা রুমই আমি রেখেছিলাম এই মথ পালার জন্য। যেহেতু আমি তখন অনার্স পড়ুয়া ছিলাম এবং এই সময়ে আসলে একজন শিক্ষার্থীর কাছে ল্যাব ফ্যাসিলিটিস খুব সীমিত থাকে, তাই আমি আমার সেই রুম বা পার্সোনাল ল্যাবও বলতে পারেন, যাই ছিল তাই নিয়ে এই মথ গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম আর কি।
লার্ভাটিকে ল্যাবরেটরিতে লালন-পালন ও পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?
সায়মা জাহান: হ্যাঁ, এই মথগুলো বড় করে তোলার জন্য ল্যাবের একটা আদর্শ পরিবেশের দরকার হয়, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি বিষয়ে নজর রাখার প্রয়োজন হয়। যেমন, আমরা যে মথগুলো বাক্সে পালি, সেখানে ছত্রাক জন্মায়। তো সেগুলোকে কিউরেশনের জন্য আবার এসি রুমের দরকার হয়। তো এসব কিউরেশন রুমে এই মথগুলোকে বড় করে তোলার জন্য আদর্শ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা বজায় রাখা হয়।
এখন যে মথগুলো আমরা বাসায় পালার চেষ্টা করি, সেগুলোর জন্য তো এই ফ্যাক্টরগুলো মেইনটেইন করা সম্ভব হয় না। যার কারণে দেখা যেত আমরা যে মথগুলো বাসায় নিয়ে আসতাম সেগুলোতে ছত্রাকের আক্রমণ হতো, লার্ভা মরে যেত। আমরা আবার আনতাম, আবার লালনপালন করে বড় করে তোলার চেষ্টা করতাম। যেমন, আমি একধরনের মথ নিয়ে কাজ করতাম, এদের বলা হয় সাইকেডি, তো এই প্রজাতির মথকে পালন করে বড় করে তোলা খুবই কষ্টের। আমি একবার এই প্রজাতির লার্ভা এনে ১ বছর পালার পরে দেখলাম যে এইটা আর বড় হয়নি, মরে গেছে। তো এই আদর্শ পরিবেশের অভাবে আমরা এই সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতাম।
আসলে এই মথগুলো আমাদের কাছে পোষা প্রাণীর মতো ছিল। যখন এই মথগুলো বড় হয়ে প্রাইমারী অবস্থায় পৌঁছায়, একটা প্রজাপতি যখন প্রথম তার ডানা মেলে তখন সেটা দেখার আনন্দই অন্যরকম। সবাই-ই চায় যে একটা প্রজাপতি এসে বসুক আমাদের হাতে, আমরা যখন এই মথগুলোকে বড় করে তুলি এবং এরা প্রথম ডানা মেলে আমাদের হাতে এসে বসে তখনের অনুভূতিটাই অন্যরকম। তো বিভিন্ন সমস্যার কারণে যখন এগুলো মারা যায়, বা লার্ভা অবস্থা থেকেই আর বড় না হয়, তখন অবশ্যই বেশ খারাপ লাগে।
এই মথগুলোকে লালনপালন করে বড় করে তোলার সময় এদের খাবার হিসেবে কী দেয়া হয়?
জহির রায়হান: এক এক ধরনের প্রজাপতি বা মথের প্রজাতি এক এক ধরনের গাছের পাতা খায়। এইটা একটা অন্যতম দিক যেটা আমাকে মথ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী করে তুলেছিল। শুধুমাত্র যে এরা মথ অবস্থাতেই পাতা খায়, এমনটাও কিন্তু না, ওদের খাবারের ধরণটা খুবই বৈচিত্র্য।
অনার্সে পড়ার সময় ওদের যে Order টা রয়েছে Lepidoptera (মথ, প্রজাপতি জাতীয় পোকার গোত্রের বৈজ্ঞানিক নাম), ওদের যে খাদ্যাভ্যাস সেটার বিবর্তন নিয়ে আমার একটা কাজ ছিল। তো এসময় জেনেছিলাম কেউ কেউ গাছের পাতা খায়, আবার কেউ কেউ গাছে জন্মানো লাইকেন খায়। আবার যারা জলজ পরিবেশে থাকে, তারা সেখানে জন্মানো ক্রিস্টীয়া খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার অনেক প্রজাতি মাংসাশীও হয়ে থাকে, এরা বিভিন্ন পোকামাকড় শিকার করে খায়। যেমন আমাদের দেশে রাতে যে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ পাওয়া যায়, সেই ঝিঁঝিঁ পোকার গায়েও এক ধরনের মথ লেগে থাকে। যতদিন পর্যন্ত এই পোকা বেঁচে থাকে ততদিন পর্যন্ত মথ পোকার দেহ থেকে এর নরম রস শুষে নেয়।
এমনও কিছু প্রজাতি আছে, যারা এগুলো কিছুই খাবে না, এগুলো এমন জিনিস খাবে যেটা একেবারে কল্পনাতীত, যেমন মানুষের মল, বাদুড়ের মল। যেমন একসাথে অনেকগুলো বাদুড় গুহায় মলত্যাগ করলে তখন সেখানে মলের স্তূপ তৈরি হয়, এই স্তূপে বিশেষ কিছু প্রজাতির মথ জন্মায়, যা বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না, শুধু এই মলের স্তূপেই পাওয়া যাবে। তো ওদের এই যে এতো এতো খাদ্য বৈচিত্র্য, আমরা যখন কোনো একটা মথ নিয়ে আসি পালার জন্য, তখন আমাদের এই জিনিসগুলো ট্র্যাকে রাখা লাগে। যেমন, আমি যদি আম গাছের পাতা থেকে কোনো একটা মথ নিয়ে আসি, তখন তাকে আম গাছের পাতা দিয়ে দেখবো যে খায় কিনা।
আবার কিছু মথ এমন আছে যে খায় এক পাতা, কিন্তু বসে থাকে অন্য পাতায়। অর্থাৎ, ওদেরও আমাদের মতো খাওয়ার পরে হাঁটাহাঁটির অভ্যাস আছে (হাসি দিয়ে)। আমার কেরালায় পরিচিত এক লোক ছিল, তিনি যে ক্যাটারপিলারগুলো পালতেন সেগুলোর বৈশিষ্ট্যই ছিল প্রতিদিন ১ থেকে ২ কিলোমিটার হাঁটবে। এজন্য উনি প্রতিদিন সকালে বাক্স হতে ক্যাটারপিলারগুলোকে ঘাসে ছেঁড়ে দিতো, এগুলো যতদূর হাঁটতো, উনিও তাদের সাথে হাঁটতো, পরে আবার সাথে করে বাক্সে নিয়ে আসতো।
তবে যদি এমন হয় যে আমরা একেবারেই কী খায় সেটা বুঝতে না পারি, সেক্ষেত্রে ল্যাবে তৈরি কিছু আর্টিফিশিয়াল ডায়েট আছে, যেগুলো আমরা মথগুলোকে খাওয়াতে পারি।
আপনারা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে এই লার্ভার ক্ষুদ্র বৈশিষ্ট্যগুলো বিশদভাবে দেখেছিলেন। কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলো আপনার কাছে নতুন ও আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে বা একে অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে বিশেষ করে তুলেছে?
জহির রায়হান: আমাদের সম্প্রতি আবিষ্কৃত মথটির পিছনের ডানায় একটি বিশেষ ধরনের গঠন খুঁজে পাওয়া যায়, যা মূলত পুরুষ মথের ডানায় বিদ্যমান থাকে। তো এই বিশেষ ধরনের গঠনে কিছু লোম খুঁজে পাওয়া যায় যা মূলত ফেরোমন নিঃসরণ করে, এটি মূলত সঙ্গীকে প্রজননে আকৃষ্ট করতে সহায়তা করে থাকে, তাই একে সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল ক্যারাক্টারিস্টিকস ও বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য মূলত এই মথের বর্গের একমাত্র গণে পাওয়া যায়, যাকে Acria moth বলে। কিন্তু এই Acria moth এ এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় সামনের ডানায়, কিন্তু আমরা যে মথ নিয়ে এসেছিলাম তার ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া গেছে পিছনের ডানায়। তো এই প্রথম বৈশিষ্ট্য মূলত আমাদের ভাবিয়ে তুলে যে এই মথের প্রজাতি হয়তো এখনও নামকরণ করা হয়নি।
এছাড়াও আমাদের দেহে রক্ত সঞ্চালনের জন্য যেমন বিভিন্ন শিরা, উপশিরা থাকে, তেমনি মথের ডানাতেও এমন বহু শিরা বিদ্যমান থাকে এবং প্রত্যেক মথের প্রজাতির ক্ষেত্রে এই শিরার একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন থাকে। তো আমরা যখন আমাদের মথের ডানা স্কেল করে, বিভিন্ন ক্যামিকেল এবং প্রয়োজনীয় রঞ্জক পদার্থ ব্যবহার করে এর শিরা পর্যবেক্ষণ করি, তখন দেখতে পাই যে এর শিরার প্যাটার্নের সাথে অন্যান্য কোনো গণ বা প্রজাতির শিরার প্যাটার্নের মিল নেই। এটি ছিল আমাদের পর্যবেক্ষণকৃত দ্বিতীয় অনন্য বৈশিষ্ট্য।
তৃতীয় আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর জননাঙ্গ। আমাদের মানুষের যেমন প্রত্যেকের আঙ্গুলের ছাপ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, তেমনি প্রত্যেক মথের জননাঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই মথের প্রজাতি শনাক্তকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে এর জননাঙ্গ বিশ্লেষণ। আমরা যখন আমাদের মথের জননাঙ্গ বিশ্লেষণ করি তখন এমন কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই যা এই পর্যন্ত মথের কোনো বর্গের কোনও প্রজাতিতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেমন এর জননাঙ্গে আঙ্গুলের অভিক্ষেপের মতো একটা গঠন রয়েছে যাকে বলা হচ্ছে ডিজিটিফর্ম প্রসেস, এছাড়াও জাক্সটার কাছে ডায়মন্ড শেইপ এর কিছু কণ্টক খুঁজে পাওয়া যায়। তো এমনই আরও কিছু সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য ছিল যা আমাদের মথ যে অন্যান্য প্রজাতি থেকে ভিন্ন তা আমাদের বুঝতে সহায়তা করে।
Paraxenoacria spinosa নামটি খুবই অনন্য এবং অর্থবহ। এই নামটি কীভাবে নির্বাচন করলেন, এবং এই নামের পেছনে কি অনুপ্রেরণা ছিল?
জহির রায়হান: আমাদের মথের ক্ষেত্রে প্রথম সন্দেহ কাজ করেছিল এর সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল বৈশিষ্ট্য দিয়ে, যে Acria গণে এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় সামনের ডানায়, কিন্তু আমাদের মথে সেটা পিছনের ডানায়। তাই নামকরণের সময়ও আমরা এর নামকরণ করেছি Paraxenoacria এবং যেহেতু এর জননাঙ্গে কণ্টকময় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল তাই এর নামের সাথে spinosa যুক্ত করা হয়। Spinosa দিয়ে মূলত কাঁটাযুক্ত বুঝায়।
বৈজ্ঞানিক নামে নতুন প্রজাতির সংযোজন বিজ্ঞানী সমাজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এতে আপনার অবদান কেমন বলে মনে করেন?
জহির রায়হান: আসলে আমাদের অনেকের মাঝেই এই প্রশ্ন থাকে, এই যে আমরা এতো বৈজ্ঞানিক নাম সংযোজন করছি এর আসলে গুরুত্বটা কোথায়। এর খুবই সহজ একটা উত্তর হচ্ছে, ধরুন আমি বাংলা ভাষায় আমাদের দেশের কোনো একটা নতুন প্রজাতির প্রাণী নিয়ে গবেষণা করলাম, এর নামও বাংলা ভাষাতেই দিলাম এবং আমার এই গবেষণাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে। কিন্তু যখন একজন ব্রিটিশ লোক এই প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে যাবে, তখন হয়তো সে জানবেই না যে ইতিমধ্যে বাংলা ভাষাতে আমরা এই প্রাণীর নামকরণসহ সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করে রেকর্ড করে রেখেছি। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে নামকরণ করার মাধ্যমে এই প্রজাতিটি বিশ্বের সবার কাছে সমানভাবে স্বীকৃতি পায়, সবাই জানতে পারে এবং হয়তো এই প্রাণীর অন্য কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে গবেষণায় আগাতে পারে।
সায়মা জাহান: মানুষ জন্মের পরেই কিন্তু আমরা প্রথমে তার নাম ঠিক করি এবং ব্যক্তির নামের উপরেই কিন্তু তার জীবনবৃত্তান্ত লেখা হয়। ঠিক তেমনি যেকোনো প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রথমে তার শনাক্তকরণ, নামকরণ প্রয়োজন, কেননা তার বৈজ্ঞানিক নামের মাধ্যমেই সে কোন প্রজাতির, কোন গণের, বর্গের সে সম্পর্কে আমরা ধারণা পেয়ে থাকি। এই ধারণা থেকেই আমরা তার জিনোম সিকোয়েন্স বা জিনোম রহস্য উন্মোচন করতে পারি। এছাড়াও জীববৈচিত্র্য মনিটরিং এর জন্যও এই নামকরণ প্রয়োজন। নামের মাধ্যমেই আমরা এর খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান ইত্যাদি তথ্য সম্পর্কে জানতে পারি। যদি এই নামকরণই না করা হয় তাহলে সেই নির্দিষ্ট প্রাণী আমাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে পারে এবং এর কারণে হয়তো পুরো একটা খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এই আবিষ্কারটি অবশ্যই একটি দক্ষ টিম হিসেবে কাজ করার ফল। কিভাবে আপনারা কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন, এবং দু’জনের মধ্যে কোন কোন দক্ষতা এই প্রকল্পে বিশেষ অবদান রেখেছে?
সায়মা জাহান: আসলে এই কাজের জন্য দলগত কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জহিরের মূলত মথের প্রতি অনেক আগ্রহ থাকলেও একটা বিষয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে আগানোর দিকে সে একটু গড়িমসি করে। তো জহির মূলত গবেষণার আইডিয়া জেনারেট করা, প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করা এবং সে অনুযায়ী রিসার্চ করে ফলাফল পর্যন্ত নিয়ে আসতো এবং সেখান থেকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পুরোটা বিষয়কে গুছিয়ে রিসার্চ পেপার পাবলিকেশন করা পর্যন্ত বাকি কাজ আমি করতাম। যেহেতু রিসার্চ টপিক বাছাই থেকে নিয়ে জার্নালে পাবলিশ করা পর্যন্ত এই যাত্রাটা বেশ দীর্ঘ এবং জার্নালে দেয়ার পর থেকে বেশ রিভিউ আসে, অনেকগুলো ধাপ পার করতে হয়, তাই বিষয়গুলোকে আমরা এভাবে ভাগ করে নিয়ে কাজ করতাম।
প্রজাপতি ও মথ নিয়ে কাজ করা অনেকের কাছে খুবই বিশেষ মনে হতে পারে। তাদের বৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত ভূমিকা নিয়ে আপনার সবচেয়ে বেশি আগ্রহী দিকগুলো কী?
সায়মা জাহান: মথ বা প্রজাপতি কিন্তু পরাগায়নে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের প্রকৃতির গাছের একটা বড় অংশ কিন্তু পরাগায়নের উপর নির্ভরশীল। যদি এই মথ প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে এই গাছগুলোর আর পরাগায়ন হবে না, পরাগায়ন না হলে বংশবিস্তার হবে না, পরিশেষে গাছের প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই কারণে অনেকেই কিন্তু মথের পরাগায়নের বিষয় নিয়ে কাজ করে।
আবার মথের যে এতো বৈচিত্র্য, এতো ভিন্ন ধরনের খাদ্যাভ্যাস প্রতিটি বিষয়ই অনেক আকর্ষণীয় এবং বেশ গভীরে কাজ করা যায়। প্রতিটি সেক্টরই বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে কাজ করার মাধ্যমে পরিবেশের বৈচিত্র্য রক্ষা করা যায়। কিন্তু আসলে আমরা আধুনিকায়নের পিছনে ছুটতে যেয়ে অর্থনৈতিকভাবে আগানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের এমন অনেক কাজ আছে যার কারণে আমরা জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে নিজেদের অজান্তেই অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি পিছিয়ে পড়ছি।
জহির রায়হান: পরিবেশগত বৈচিত্র্য রক্ষার সাথে মথের এই বিষয়টা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আসলে বাংলাদেশ বা ভারত উপমহাদেশের অঞ্চলগুলোতে Biodiversity monitoring এর মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ বর্তমানে ইউরোপ মহাদেশে ওরা সবচেয়ে বেশি সচেতন হয়ে উঠছে “Insect decline” নিয়ে।
অর্থাৎ, তাদের মতে প্রতি বছরে বিশ্বের ১০%, একটা বেশ বড় সংখ্যার ইনসেক্ট বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যেটা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়। আমাদের দেশে কিছু ট্যাবু আছে যার কারণে আমাদের দেশ থেকেও মথ বা প্রজাপতির একটা বড় সংখ্যা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, আমাদের দেশে আধুনিকায়নের নেশায় বড় বড় রিসোর্ট নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে অধিকাংশ গাছই কেটে ফেলা হয়। বাংলাদেশে এখন হয়তো সুন্দরবন ছাড়া আর এমন কোনো সবুজে ঘেরা অঞ্চল নেই, তাও সামনের দশকে এর অবস্থা কী পর্যায়ে যায় তাও চিন্তার বিষয়।
আমরা নিজের ইচ্ছায় যে গাছগুলো লাগিয়ে থাকি, তাও দেখা যায় ড্রাগন ফ্রুট, ইউক্যালিপটাসের মতো বিদেশি গাছ। আমরা বনায়নের নামেও যে গাছগুলো লাগাই, সেগুলো বেশিরভাগই দেখা যায় বিদেশি গাছ, যেমন আকাশমণি, মেহগনি, কড়ই গাছ, ইউক্যালিপটাস এগুলো প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ আমার এইটা হয়তো কখনও ভেবে দেখিনি যে এই গাছগুলো যে জীববৈচিত্র্যের মাঝে থাকা দরকার, সেই পরিবেশ কী আমাদের এখানে আছে কিনা।
যেমন আমাদের দেশে যে মথের প্রজাতিগুলো আছে, তাদের মধ্যে যারা গাছের পাতা খেয়ে থাকে বা যে পাতার উপর ডিম পেড়ে থাকে, তারা অবশ্যই আমাদের দেশীয় গাছের পাতা খায় বা তার উপর ডিম পাড়ে, বিদেশি গাছের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। বিদেশি গাছের সাথে সম্পর্কিত মথের প্রজাতিগুলো এই গাছ যে অঞ্চল থেকে আনা হয়েছে, সেখানেই পাওয়া যাবে এমনটাই স্বাভাবিক।
অথচ বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের কারণে বিদেশি গাছের এতো প্রাচুর্য্য আমাদের দেশে হওয়ায়, এই দেশের মথের প্রজাতিগুলো হুমকির মুখে পড়ে গেছে। একইসাথে এই বিদেশি গাছগুলো টিকে থাকার জন্য দেশীয় গাছের সাথে প্রতিযোগিতা করে মাটি থেকে আশেপাশের গাছগুলোর পুষ্টি উপাদান শুষে নেয়, যা দেশীয় গাছ বিলুপ্ত হওয়ার একটা কারণ। এইটা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো উচিত সবার মাঝে এবং এই বিষয়ে আরও কাজ করা উচিত। না হলে আমরা আমাদের জীববৈচিত্র্য যে খুব দ্রুত হারাতে যাচ্ছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রজাপতি ও মথের সাথে আপনার (সায়মা জাহান) কোনো প্রিয় স্মৃতি বা আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা আছে যা আপনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে?
সায়মা জাহান: আসলে জীববৈচিত্র্যের প্রতি প্রথম থেকেই আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না, আমি নিজে কখনও এত গভীরভাবে ভাবতাম না এসব নিয়ে। জানতামই না যে এখানেও এতো সুন্দর একটা জগত আছে, এই জগতকে ভালোবাসা যায়, এগুলোকে আমাদের বাঁচাতে হবে। তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জহিরের সাথে আমাদের একটা টিম ছিল, আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই পাহাড়ি এলাকা থাকায় আমরা প্রায়ই সেখানে ঘুরতে যেতাম। তো সেই সময় জহির আমাদের বিভিন্ন প্রজাপতি দেখাতো, এসব নিয়ে গল্প করতো, এসব শুনতে শুনতেই আসলে মথ, প্রজাপতির প্রতি ভালোবাসা শুরু।
একটা সময় এমন আসে যে আমরা ভেবেই রাখতাম আজকে আমার প্রজাপতির একটা ভালো ছবি তুলতে হবে, যেদিন একটা ভালো ছবি তুলতে পারতাম সেদিনের খুশিটাই ছিল অন্যরকম। এভাবেই আসলে মথ গবেষণার দিকে আমার আগানো।
আপনাদের ভবিষ্যৎ গবেষণার লক্ষ্যগুলো কী? আপনাদের কাজের এমন কোনো বিশেষ প্রকল্প আছে যা আপনাকে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত করে?
সায়মা জাহান: আমরা আসলে মথের লোক, মথ নিয়েই আমাদের ধ্যান, চিন্তাচেতনা, সাধনা। আমরা চেষ্টা করবো আমাদের দেশীয় মথের জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করার, নতুন কিছু আবিষ্কার করার। তবে মথ নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছা আছে আমাদের দেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা নিয়ে কাজ করার, এটা গবেষণার মাধ্যমেই আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো, যেহেতু আমরা গবেষক। তবে যদি কোনো কার্যক্রমের মাধ্যমে এই বিষয়ে সচেতনতা তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে থাকি, তাহলে অবশ্যই তা করার চেষ্টা করবো।
গবেষণায় সাফল্যের জন্য এবং নতুন কিছু আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কোন গুণাবলী বা দক্ষতাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
জহির রায়হান: গবেষণার জন্য প্রথমেই যে দুইটি বিষয় একদম লাগবেই, তা হচ্ছে গবেষণার প্রতি তীব্র ইচ্ছা এবং ধৈর্য্য। গবেষণার জন্য যে ঠিক কতটা সময় লাগবে এইটা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না। আবার গবেষণাতে সাফল্য আসতেও পারে আবার নাও আসতে পারে। যেমন আমি কোনো একটা নির্দিষ্ট প্রশ্ন নিয়ে অনেক প্ল্যান করে রিসার্চে নামলাম, কিন্তু তার ফলাফল হাস্যকর কিছুও চলে আসতে পারে। যার কারণে গবেষণায় নামার আগে এই বিষয় মাথায় রেখেই নামা লাগবে এবং এই বিষয় হজম করার মতো মানসিকতা থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যেকোনো বিষয়ে গবেষণায় নামার আগে সেই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে পড়াশোনা করা উচিত। তখন গবেষণার চিন্তা বা অন্য কোনো বিষয় মাথায় রাখা যাবে না, কোনো একটা বিষয়ে কয়েক বছর সময় নিয়ে বিস্তারিত জানতে হবে। এতে করে যখন আমরা ল্যাবে বা অন্য যেকোনোভাবেই গবেষণায় নামবো, তখন প্রতিটি বিষয়ের ফলাফল আমরা গভীরভাবে বুঝতে পারবো, বিশ্লেষণ করতে পারবো। এক বিষয়ের সাথে অন্য কোনো ফ্যাক্টর জড়িত কিনা তা সহজেই অনুমান করতে পারবো।
পড়াশোনার মাধ্যমেই আসলে গবেষণার নতুন দিক উন্মোচন করা সম্ভব হয়, চিন্তার জগত সম্প্রসারিত করা যায়, সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি করা যায়। অর্থাৎ, আমি মনে করি আমাদের পড়তে হবে অনেক বেশি, চিন্তা করতে হবে তারও কয়েকগুণ বেশি, কিন্তু কাজ করতে হবে তার অল্প কয়েক শতাংশ। আপনার ক্রিয়েটিভ আইডিয়া দিয়ে এমন কিছু বাছাই করতে হবে যা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা করা হয়নি।
আর এই গবেষণা করার জন্যই যে বিশাল পরিমাণে ত্বত্তীয় জ্ঞান প্রয়োজন তা শুধুমাত্র পড়াশোনার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। সবাই কিন্তু চাইলে রিসার্চ জার্নালে পেপার পাবলিশ করে গবেষক হতে পারে, কিন্তু সবাই বিজ্ঞানী হতে পারে না। বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য প্রচুর জানতে হবে, চিন্তা করতে হবে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কিন্তু কোনো ল্যাব ছিল না, কিন্তু তিনি তার চিন্তনদক্ষতা দিয়েই এতো কিছু আবিষ্কার করে গেছেন। আমি মনে করি, একজন বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য আপনার মস্তিষ্ককেই ল্যাবে পরিণত করতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজন পড়াশোনা।
যেসব শিক্ষার্থী বা নবীন বিজ্ঞানীরা নতুন প্রজাতি আবিষ্কার বা কীটতত্ত্ব নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
সায়মা জাহান: যেহেতু আমাদের দেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ এবং এদেশের কৃষির সাথেই পোকামাকড়, জীববৈচিত্র্য সবকিছুই অনেক গভীরভাবে জড়িত। তাই এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার অনেক জায়গা আছে আমাদের দেশে। আমাদের দেশ কিন্তু জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটা দেশ, যদিও আমরা এগুলো নিয়ে সচেতন না, মনিটর করি না এইটা আমাদের ব্যর্থতা। আমাদের দেশে এখনও এমন অনেক প্রজাতির কীটপতঙ্গ আছে যেগুলো আবিষ্কার করা হয়নি বা নামকরণ করা হয়নি, আমরা যারা কীটপতঙ্গ নিয়ে পড়াশোনা করি তাদের দায়িত্ব এই জিনিসগুলোকে খুঁজে বের করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসা, এগুলো মনিটরিং করা। এগুলো এখন আমাদের দেশের জন্য খুবই দরকার, তাই আমি সাজেস্ট করবো যাতে এই বিষয় নিয়ে আরও মানুষ পড়াশোনা করে এবং প্রকৃতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে।
এই আবিষ্কারের অভিজ্ঞতাকে এক বাক্যে প্রকাশ করতে বললে, আপনি কীভাবে এটি বর্ণনা করবেন?
জহির রায়হান: একবাক্যে বলতে হলে আমি বলবো, “আমি অনেক ক্ষুদ্র।”
কারণ এই যে এতো বিশাল জীববৈচিত্র্য, তার মাঝে আমি খুবই নগণ্য একজন মানুষ। এই আবিষ্কার অনেকের কাছে মনে হচ্ছে, অনেক বড় কিছু হয়তোবা। কিন্তু আসলে এই আবিষ্কারের পরেই আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার এখনও অনেকটা পথ যাওয়া বাকি। বিজ্ঞানের এই বিশাল জগতে বিচরণ করতে গেলে এখনো আমার জ্ঞানের পরিধি নগণ্য, আরও বেশি জানতে হবে, পড়তে হবে।
দিদারুল ইসলাম/ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী