পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নে উনিশ-বিশ হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তা যদি হয় সতেরো একুশ তাহলে অবশ্যই সেটা চিন্তার বিষয়। আর ঠিক এমনি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে নাসা (NASA)! সম্প্রতি মঙ্গল গ্রহ থেকে ভূতাত্ত্বিক নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসার মিশনে প্রাথমিক খরচ অনধিক সাত বিলিয়ন ডলার অনুমান করলেও নতুন জরিপে তার ন্যূনতম খরচ হিসাব করা হয়েছে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা আবার ক্ষেত্র বিশেষে বাড়তেও পারে। আর এ সমস্যা সমাধানে নতুন সাশ্রয়ী রাস্তা খুঁজতে সাহায্য চেয়ে প্রাইভেট সেক্টর ও আর্কিটেকচার ইন্ডাস্ট্রির দ্বারস্থ হচ্ছে আমেরিকা ভিত্তিক এই মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি।
এ ব্যাপারে নাসার প্রশাসন প্যানেলের সদস্য বিল নেলসন (Bill Nelson) বলেন,
”মঙ্গলের এই নমুনা আমাদের শুধুমাত্র মঙ্গলের আদি পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কেই ধারণা দিবে না, বরং সৌরজগতের প্রাগৈতিহাসিক সময়েরও দ্বার খুলে দিতে পারে। এতে পূর্বে বাস করা জীবনের নমুনাও থাকতে পারে। মঙ্গল যেহেতু প্রতিবেশী গ্রহ তাই এসব গবেষণার ফল আমাদের নিজস্ব গ্রহ সম্পর্কেও ধারণা বদলে দিতে পারে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য আমাদের এই মিশনের নতুন ও সাশ্রয়ী পথ খুঁজতে হবে আর এজন্য এখন সকলকে বক্সের বাইরে চিন্তা করতে হবে।”
পৃথিবীর নিকটবর্তী লাল গ্রহ নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা কম হয় না। আকাশে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা এই গ্রহের কাল্পনিক অধিবাসী নিয়ে সায়েন্স ফিকশন অথবা মুভিও কম তৈরি হয়নি। আর একই সাথে মঙ্গল নিয়ে সত্যিকারের গবেষণাও চলমান রয়েছে।
গত ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই গ্রহ নিয়ে সূক্ষ্ম গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন মহাকাশ গবেষকেরা। আর তার অংশ হিসেবেই মঙ্গলের মাটির নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছেন তারা। সে উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে মঙ্গলের পৃষ্ঠে অবতরণ করানো হয় NASA Perseverance Rover যান এবং তা গত তিন বছর ধরে মঙ্গলের আগ্নেয়গিরি, জলবায়ু, ভূপৃষ্ঠ, আবাসন যোগ্যতাসহ বিভিন্ন জটিল বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করে তথ্য প্রেরণ করছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় অনুসন্ধানের এক পর্যায় রোভার যানটি প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন বছরের প্রাচীন একটি লেক অঞ্চলের অনুসন্ধান করেছে। এই অঞ্চলের নমুনা গবেষণার জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
এই বিষয়ে গবেষণা দলের সিনিয়র গবেষক প্রফেসর ব্রায়োনি হরগেন (Pr. Briony Horgan) বলেন,
”লেক মধ্যবর্তী ভূতাত্ত্বিক নমুনাগুলো চমকপ্রদ হতে পারে। ঠিক এই ধরনের উপযোগী নমুনা সংগ্রহ করতেই আমরা সেখানে গিয়েছি আর এমন জিনিসই আপনি গবেষণাগারে অণুবীক্ষণযন্ত্রের লেন্সে দেখতে চাইবেন!”
প্রাগৈতিহাসিক এই লেক অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরীণ বেলেপাথর ড্রিলিং করে সেখান থেকে প্রায় ৩০০ গ্রাম নমুনা সংগ্রহ করে মহাকাশযান যোগে পৃথিবীতে নিয়ে আসার প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। আর এই মিশনের আনুমানিক ব্যয় ধারণা করা হয় ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পুরো যাতায়াত সময় ২০৩০ সালের মধ্যে।
কিন্তু গতবছর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে Independent Mars Sample Review Board নামে একটি জরিপ বোর্ড এই যাত্রা নিয়ে তাদের রিপোর্ট প্রকাশিত করেন। তাদের মতে, ”বর্তমানে আমাদের কাছে যে যন্ত্রপাতি ও সক্ষমতা রয়েছে সে হিসেবে এই জটিল যাত্রার ব্যয় হতে পারে কমপক্ষে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।”
তারা আরো বলেন, “মঙ্গলের এসব নমুনা ২০৪০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে আসবে। কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও এই সম্পূর্ণ মিশনটি মঙ্গল গ্রহসহ সৌরজগত সম্পর্কে আমাদের বর্তমান তথ্য ভান্ডারকে বিরাট প্রভাবিত করতে পারে।”
নাসার সহযোগী প্রশাসন নিকি ফক্স (Nicky Fox), মিশনের পরিচালক, এই জরিপ নিয়ে বলেন,
”২০৪০ সাল আমাদের জন্য অনেক লম্বা একটি সময়। টাকার পরিমাণের পাশাপাশি আমাদের সময় সংকোচন করারও উপায় ভাবতে হবে যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে পুরো মিশনটি সফলভাবে শেষ করা যায়।”
তবে এসব খুব দ্রুতই হবে বলে মনে করেন না বিশ্লেষকরা। এজন্য আর্কিটেকচার ও স্পেস মিশনের বর্তমান সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। ব্যয়বহুল এই মিশনের মূল সমস্যা হলো একটি রকেট পৃথিবী থেকে উত্তোলন করে সেটি ৩৩ মিলিয়ন মাইল দূরের একটি গ্রহে সফলভাবে অবতরণ করানো, স্বয়ংক্রিয় ভাবে নমুনা সংগ্রহ করে সেখান থেকে আবার উত্তোলন করিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে আসা, পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ! কারণ গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে মঙ্গলে বা এমন দূরবর্তী স্থানের মিশনগুলো ছিল শুধুমাত্র একমূখী।
এই পুরো প্রক্রিয়াটির সাথে নাসাকে সাহায্য করছে ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA)। তারা উভয় মিলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বেসরকারি সংস্থা সহ অন্যান্য মহাকাশ গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার আশায় সংবাদ সম্মেলনে ও বৈঠকে বসার পরিকল্পনা করছে। তাই বলাই যায় আগামী কয়েক মাস নাসার মূল যন্ত্রণার কারণ হবে কিভাবে এই মিশনের খরচ কমিয়ে অন্য গবেষণায় তা ব্যয় করা যায় এবং ২০৪০ সাল পর্যন্ত তাদের বিশাল লোকবল শুধুমাত্র একটি মিশনে যেন আটকে না থাকে এমন উপায় খোঁজা।
এস এম ইফতেখার আলম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ নাসা.গভ, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি নিউজ, ওয়াশিংটন পোস্ট, স্পেস.কম, স্পেস নিউজ