ভারত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাস এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশ। এর উপকূলবর্তী অঞ্চলের স্বচ্ছ পানির নিচে বসবাস অসংখ্য প্রবালপ্রাচীর আর নানা ধরনের সামুদ্রিক জীবের, যার আকর্ষণে মরিশাসে প্রতিবছর আগমন ঘটে প্রচুরসংখ্যক পর্যটকের। এখন অবশ্য করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে বন্ধ হয়ে আছে পর্যটন ব্যবসা। কিন্তু সম্প্রতি এমন এক বিপদের কবলে পড়েছে দেশটি যা তার বিস্তৃত সমুদ্র উপকূলকে ঠেলে দিয়েছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। এর কারণে হুমকির মুখে পরেছে প্রবালপ্রাচীর আর অসংখ্য সামুদ্রিক জীব।
ঘটনার সূত্রপাত গত ২৫ শে জুলাই, যখন জাপানি নাগাসাকি শিপিং কোম্পানি-র মালিকানাধীন এবং মিৎসুই ওএসকে লাইন দ্বারা পরিচালিত মালবাহী জাহাজ এমভি ওয়াকাশিও, প্রায় ৪০০০ টন জ্বালানী তেল সহ ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাস এর উপকূলবর্তী প্রবালপ্রাচীর ঘেরা অঞ্চলের অগভীর জলে আটকে যায়।
এর প্রায় ১০ দিন পর, চলতি মাসের ৬ তারিখ প্রথম জাহাজ থেকে জ্বালানি তেল চুইয়ে সমুদ্রে পড়ার খবর পাওয়া যায়। এরপর গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জাহাজের রিজার্ভ থেকে ৩ হাজার টনের বেশি পরিমাণ জ্বালানি সরিয়ে নেওয়া হলেও প্রায় ১ হাজার টনের বেশি জ্বালানি সমুদ্রে মিশে যায়। এর ফলে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য ঘেরা বিশাল এই উপকূল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
জীববৈচিত্র্য বিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশন অনুসারে, মরিশাসের সামুদ্রিক পরিবেশে প্রায় ৮০০ প্রকারের মাছ, ১৭ প্রকারের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী এবং দুটি প্রজাতির কচ্ছপ সহ ১৭০০ প্রজাতির প্রাণীর বসবাস যা পৃথিবীর মধ্যে অনন্য। এছাড়াও প্রবাল প্রাচীর, সি-গ্রাস এবং ম্যানগ্রোভ বনও মরিশাসের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, দূষিত পানি সরাসরি এই প্রবালপ্রাচীর আর সামুদ্রিক প্রাণির জীবনকে প্রভাবিত করবে।
জাহাজ থেকে চুইয়ে পড়া তেল, দুর্লভ সামুদ্রিক জীবনের জন্য একটি বিখ্যাত অভয়ারণ্য “পয়েন্ট ডি’এসনি”- তে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলের জলাভূমিগুলি রামসার কনভেনশন দ্বারা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে চিহ্নিত। গ্রিনপিস আফ্রিকা-র হ্যাপি খামুলি বলেছেন যে “হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণির জীবন এবং পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে যা মরিশাসের অর্থনীতি, খাদ্য সুরক্ষা এবং জনস্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।” মরিশাসের একজন সমুদ্রবিদ এবং পরিবেশ প্রকৌশলী, ভাসেন কপ্পায়মুথু বিবিসিকে বলেছেন, “স্থানীয় বাসিন্দারা এখন নিঃশ্বাস এর সাথে ভারী তেল-বাষ্প গ্রহণ করছেন।”
মার্কিন বিশ্লেষণ সংস্থা সংস্থা “উরসা স্পেস সিস্টেম”, ফিনিশ “আইসিয়ে” স্যাটেলাইটের রাডার তথ্য ব্যবহার করে পরিস্থিতিটির দিকে নজর রাখছে। উরসার পল ফ্রে বিবিসি নিউজকে বলেন, “৬ ই আগস্ট, আমরা ওয়াকাশিওর চারপাশে প্রায় ৩.৩ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় তেল ছড়িয়ে যেতে দেখেছি যা ১১ ই আগস্ট প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৭ বর্গকিলোমিটারের বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।”
শুক্রবার, মরিশাস এর প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ যুগনাথ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সকলের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। একটি সংবাদ সম্মেলনে, মিৎসুই ওএসকে লাইনের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আকিহিকো ওনো এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, সংস্থাটি “সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের ক্ষমতার মধ্যে সমস্ত কিছু” করবে।
দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে তীরে অবস্থিত নাগাসাকি শিপিংয়ের মালিকানাধীন অন্য একটি জাহাজে জ্বালানি স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। ফ্রান্স তার উপনিবেশ, নিকটবর্তী রিউনিয়ন দ্বীপ থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম সহ একটি সামরিক বিমান পাঠিয়েছে, এবং জাপান ফরাসী প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য ছয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে।
এদিকে, স্থানীয়রা ভাসমান তেল শোষণের জন্য কাপড়ের বস্তার মধ্যে খড় এবং শোষণীয় বস্তু ঢুকিয়ে সমুদ্রের তীরে বাঁধ তৈরি করছে। কেউ কেউ দ্বীপের সৈকত পরিষ্কার করছে। সরকারি চেষ্টার পাশাপাশি স্থানীয় সাধারণ মানুষ এই বিপর্যয় এর ক্ষতি কমাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিষ্কার অভিযানে অংশগ্রহণ করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এই সামুদ্রিক বিপর্যয় মরিশাসের জীববৈচিত্র্য, পর্যটন, অর্থনীতি সহ মানুষের জীবনযাত্রায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
সোহানুর রহমান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ দ্যা গার্ডিয়ান, বিবিসি, Mongabay, আলজাজিরা