বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এখন প্রায় অনেক বাড়িতেই সোলার প্যানেল ব্যবহার করতে দেখা যায়। এতে একদিকে যেমন বিদ্যুতের চাহিদা মিটে অপরদিকে নিরবিচ্ছিন্ন আলো পাওয়া যায়। তবুও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্যুতের যোগান মেটানো বেশ কঠিন, এরূপ বিদ্যুৎ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে আসছে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ। ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ সম্পর্কে জানতে হলে আগে সোলার প্যানেল সম্পর্কে বুঝতে হবে।
সোলার প্যানেল বা সৌর কোষ হচ্ছে একটি ফ্রেমে মাউন্ট করা ফটোভোলটাইক সৌর কোষগুলোর সমাবেশ। এটি পিভি (PV) প্যানেল নামেও পরিচিত। সৌর প্যানেলগুলো দীপ্তমান শক্তির উৎস হিসেবে সূর্যালোককে ধারণ/শোষণ করে, যা সরাসরি বর্তমান বিদ্যুতের আকারে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
Nature Sustainability নামে একটি জার্নাল তাদের সর্বশেষ গবেষণায় এক চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করে। জার্নালের তথ্যমতে, স্থানীয়ভাবে বড় কৃত্রিম হ্রদ অথবা পানির আধারের ৩০% জায়গায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে ১২৪ টি দেশের ৬২৫৬ টি শহরের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব!
গবেষকগণ পৃথিবী জুড়ে অবস্থিত ১১৪, ৫৫৫ টি কৃত্রিম লেক বিভিন্ন ডেটাবেজের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বাস্তবসম্মত জলবায়ু সম্পর্কিত তথ্য ব্যবহার করে একটি পাওয়ার জেনারেটর এর মডেল তৈরি করেন। ভাসমান সোলারপ্যানেল ফ্লোটোভোলটাইক নামেও পরিচিত।
ফ্লোটোভোলটাইক ব্যবহারের সুবিধা:
- পরিবেশবান্ধব:
Nature Sustainability এর তথ্যমতে, ভাসমান সোলার প্যানেল ব্যবহারে সুবিধা পাবে গোটা একটি শহর। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে এই ভাসমান সোলারপ্যানেল। আমরা জানি যে, তেল এবং গ্যাসের মতো অনবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ হয়ে থাকে।
কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তি পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণ করে না। ফলে জলবায়ুর উপর কোন বিরুপ প্রভাব ফেলে না এই ভাসমান সোলারপ্যানেল। - মেটাবে পানির চাহিদা: ভাসমান সোলারপ্যানেল ব্যবহারের জন্য তৈরি কৃত্রিম হ্রদ পানির উৎস হিসেবে শহরবাসী ব্যবহার করতে পারবেন। এর মাধ্যমে খরার সময়ও শহরবাসী উপকার পাবেন। জার্নালটি অনুযায়ী, কৃত্রিম হ্রদ এর ধারণকৃত পানি বার্ষিক প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে পারবে। তাছাড়াও গ্রীষ্মে যখন বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকবে তখন হাইড্রোইলেক্ট্রিক ড্যাম এর সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে আরো অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।
পানির উপরে সোলার প্যানেলটি স্থাপন করার ফলে সরাসরি সূর্যালোক এসে পানিকে বাষ্পীভূত করতে পারবে না। ফলে পানির সংকটেও পড়তে হবে না শহরবাসীর।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সোলার প্যানেল অতিরিক্ত উত্তপ্ত হওয়ার ফলে এর কর্মদক্ষতা প্রায় ২৫% হ্রাস পায়। কিন্তু ভাসমান সোলারপ্যানেলটি পানির উপরে স্থাপন করার ফলে পানিই এর তাপমাত্রা হ্রাস করবে এবং সবসময় সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতায় কাজ করতে সক্ষম হবে।
এছাড়াও, সম্পূর্ণ প্রকল্পটি পানির মাঝে হওয়ায়, মাটির উপর স্থাপনার সাথে এর কোন সংঘর্ষ হবে না।
-
স্থাপন করতে কোন জমির দরকার নেই:
ফ্লোটোভোলটাইক পানির উপর স্থাপিত হওয়ায় এই প্রকল্পটি যেকোন অব্যবহৃত জলাধারের উপর নির্মাণ করা যায়। ফলে কোন মূল্যবান কৃষিজমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না এবং জনপদের নিকটেই স্থাপনা নির্মাণ করা সম্ভব হয়।
- অধিক কার্যকর:
সিম্বকর্প নামক সিংগাপুরের একটি ফ্লোটোভোলটাইক ইন্ড্রাস্ট্রিজ দাবি করে যে, প্রচলিত সোলারপ্যানেল থেকে ভাসমান সোলারপ্যানেল ৫-১৫% অধিক কার্যকর।
- একই সাথে করা যাবে মাছ চাষ:
নতুন ফ্লোটোভোলটাইক প্রযুক্তিতে সোলার প্যানেলগুলো এমনভাবে স্থাপন করা যায় যেন জলাশয়ে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে। এর ফলে জলাশয়ে অক্সিজেনের কোন ঘাটতি হয় না এবং নির্বিঘ্নে মাছ চাষ করা যায়।
বর্তমানের কিছু ফ্লোটোভোলটাইক প্রজেক্ট:
সম্প্রতি বেশকিছু ভাসমান সোলারপ্যানেল প্রজেক্ট চলমান রয়েছে এবং সফলতার সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছে। চলুন দেখে আসি এমন কিছু উদাহরণ:
- সিংগাপুর ফ্লোটোভোলটাইক প্রজেক্ট:
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ভাসমান সোলার প্যানেল তৈরি করেছে সিংগাপুরের সিম্বকর্প ইন্ড্রাস্টিজ। ১ লাখ ২২ হাজার প্যানেলের এই প্রজেক্টটি প্রায় ৪৫ টি ফুটবল মাঠের সমান। এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে দেশটির ৫ টি পানি শোধনাগার চালানো যাবে।
সিংগাপুর জাতীয় পানি সংস্থা (পিইউবি) ও সিম্বকর্প এর তথ্যমতে, প্রজেক্টটি প্রতিবছর ৩২ কিলোটন কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনবে।
- দক্ষিণ-কোরিয়ার ফ্লোটোভোলটাইক প্রজেক্ট:
দক্ষিণ-কোরিয়ার ভাসমান সোলারপ্যানেল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হানাওয়া সলিউশন এর কর্তৃপক্ষ বলেন, “হ্যাপচিওনের দক্ষিণ কাউন্টিতে ১২ মাইল দীর্ঘ জলাধারে ১৭ টি জায়ান্ট প্ল্যান্ট ৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। এই উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২০ হাজার বাড়িতে শক্তি জোগাবে।“
দক্ষিন-কোরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুন-জে-ইন বলেন, “ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প ২০৫০ সালের ভেতরে ৯.৪ গিগাওয়াট বা নয়টি পারমাণবিক চুল্লির সমতুল্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে দেশটি।”
প্রকল্পটি দেশটিকে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে এগোতে সাহায্য করবে বলেও জানায় দেশটির প্রেসিডেন্ট।
বাংলাদেশে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প:
বাগেরহাটের মোংলা বন্দরে স্থাপিত হতে যাচ্ছে দেশের সর্বপ্রথম ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতীয় ও দেশীয় একটি কোম্পানির সাহায্যে নির্মিত হচ্ছে এই স্থাপনাটি।
উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, “ভাসমানভাবে ও পুকুরপাড়ে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন প্রকল্প পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করবে। ভারতের সহযোগিতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে আমাদের মধ্যে মৈত্রী ভাব আরও সুদৃঢ় হবে। এ ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশে এই প্রথম। এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে ভাসমান সোলার প্ল্যান্ট সারা বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাবে আশা করি।”
মোংলা বন্দরের ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কুমারখালীর পানি শোধনাগার কেন্দ্রের দুটি পুকুর ও পুকুরপাড়ে ১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প স্থাপনে প্রিমিয়ার সোলার পাওয়ারটেক প্রাইভেট লিমিটেড ভারতের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন, নির্বাহী কর্মকর্তা সুধীর মুলা ও বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন, সোলার ইপিসি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এর চেয়ারম্যান ইজাজ আল কুদরত এ মজিদ ও মোংলা পোর্ট পৌরসভার পক্ষে স্বাক্ষর করেন, মেয়র মো. জুলফিকার আলী।
দেশে নিত্যনতুন বিদ্যুৎ-বিভ্রাট এবং সংকট এড়াতে ও উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য নতুন এই প্রযুক্তির বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
সোর্সঃ দ্য ভার্জ, উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো
নিজস্ব প্রতিবেদক/ নাফিস কামাল