জ্যোতির্বিজ্ঞানের তুলনামূলক নতুন অধ্যায়ের একটি হলেও ব্ল্যাক হোল নিয়ে মানুষের আগ্রহের সীমা সবসময়ই ছিল তুঙ্গে। ১৯৭১ সালে আবিষ্কার হওয়া প্রথম ব্ল্যাক হোল Cygnus X-1 থেকে শুরু করে বিশ বছরের দীর্ঘ গবেষণার ফসল ২০১৭ সালে প্রকাশ পাওয়া প্রথম ব্ল্যাক হোলের স্থির চিত্র সবই ছিল আলোচনার শীর্ষে। আর সেই পালে হাওয়া লাগাতে নতুন সংযোজন, এক লুকায়িত দানবের খোঁজ পেয়েছে ইউরোপের একদল মহাকাশ গবেষক।
১৬ তারিখ মঙ্গলবার ইউরোপ স্পেস এজেন্সি (Europe Space Agency) জানায়, আমাদের অতি নিকটে মাত্র ২০০০ আলোকবর্ষ (Light Year) দূরে সূর্যের ভরের প্রায় ৩৩ গুণ একটি স্টেলার (Stellar) ব্ল্যাক হোলের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা শুধু আমাদের গ্যালাক্সিই না, বরং সকল গ্যালাক্সিতে পাওয়া এযাবৎ কালের সর্ববৃহৎ স্টেলার (Stellar) ব্ল্যাক হোল।
Gaia Space Observatory এর আবিষ্কৃত তৃতীয় স্টেলার ব্ল্যাক হোল হওয়ায় এর নাম রাখা হয়েছে “Gaia BH3”। আর এটি নিয়ে তারা এতোটাই উচ্ছাসিত যে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই এই সংবাদ প্রচার করা হয়েছে যাতে অন্যান্য মহাকাশ গবেষণাকারীরা এটি নিয়ে আরো যুগান্তকারী গবেষণা করতে পারে।
এ সম্পর্কে গবেষণা দলের একজন Dr. Pasquate Panuzzo বলেন,
“এটি ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাই নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই এর সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে যাতে সবাই এ নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা চালাতে পারে।”
কিন্তু এখন প্রশ্ন আসতে পারে, মাত্র দু হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থানরত এত বৃহৎ ব্ল্যাক হোল এতদিন নজরে আসেনি কেন? আর সে উত্তর লুকিয়ে আছে উক্ত ব্ল্যাক হোলটির গঠন প্রকৃতিতে।
কল্পনা করি বাতাসে ভাসমান একটি চাদর যাতে কোন প্রকার ভাঁজ নেই। এখন এর মাঝে যদি একটি আপেল রাখা হয় তাহলে কি লক্ষ্য করা যায়? আপেলের ভারে চাদর তল কিছুটা নিচের দিকে বক্র হয়ে গেছে এবং আপেলের চারপাশেও গোল বক্রতল তৈরি হয়েছে। এখন একটি মার্বেল যদি এই বক্রতল বরাবর ছুঁড়ে দেয়া হয় তাহলে এটি মনে হবে আপেলকে আবর্তন করে ঘুরছে। মূলত এভাবেই মহাকর্ষ বল কাজ করে। কাল্পনিক সে চাদর আমাদের “স্পেস টাইম” (Space-Time) ফেব্রিক আর আপেল কিংবা মার্বেল আমাদের গ্রহ-নক্ষত্র। স্পেস-টাইম ফেব্রিক হলো আইন্সটাইন প্রদত্ত একটি কাল্পনিক চাদর সদৃশ তল যেটি ছড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব জুড়ে আর আমাদের গ্রহ নক্ষত্র সহ সকল বস্তু এই তলের উপর অবস্থিত। গ্রহ নক্ষত্রের বিচরণ এবং মহাকর্ষ বল সকল কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে এই স্পেস-টাইম ফেব্রিক।
এখন, আবার সেই কাল্পনিক চাদরে ফিরে যাই। যদি আপেলের জায়গায় আরো ভারী কিছু রাখা হয় তাহলে বক্রতা আরো বৃদ্ধি পাবে। আর এভাবে যদি অসীম ভরে নিয়ে যাই তাহলে কাল্পনিক সেই চাদর দুমড়েমুচড়ে যাবে। ঠিক এভাবেই তৈরি হয় কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল। ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে মহাকর্ষ টান এতটাই শক্তিশালী হয় যে আলোক তরঙ্গও একে ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারে না। তৈরি হয় অন্ধকার বিভীষিকা।
উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে ব্ল্যাকহোল চার প্রকার- Stellar, Intermediate, Supermassive & Miniature।
এর মধ্যে বৃহৎ তারার শেষ লগ্নে সংগঠিত সুপারনোভা (supernova) বা তারকার বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হয় স্টেলার ব্ল্যাক হোল। আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যমণি ব্ল্যাকহোল Sagittarius A সূর্যের চেয়ে লক্ষাধিক গুণ বড় হলেও এটি তারকার মৃত্যু থেকে তৈরি হয়নি, বরং ধূলাবালি ও গ্যাস থেকে কোটি বছরের সংকোচনে সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগেও একাধিক স্টেলার ব্ল্যাক হোল মিল্কিওয়েতে পাওয়া গেলেও তাদের ভর ১০ সৌর ভর (সৌর ভর এস্ট্রোনমিক্যাল ভর মাপার একক, যার মান ২×১০^৩০ কেজি) পরিমাণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই স্বভাবতই Gaia BH3 আমাদের গ্যালাক্সির সবচেয়ে বড় স্টেলার ব্ল্যাক হোল যা ৩৩ টি সূর্যের ভরের সমান। এমন ব্ল্যাক হোল অতি দূরবর্তী গ্যালাক্সিতেই লক্ষ্য করা গেছে শুধু।
যেহেতু ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে আলোক রশ্মিও বের হয়ে আসতে পারে না, তাই খালি চোখে অথবা সাধারণ টেলিস্কোপ দিয়ে ব্ল্যাক হোল অনুসন্ধান অসম্ভব। তবে অতিরিক্ত মহাকর্ষীয় বল যেমন, এদের লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে তেমনি এদের আবিষ্কারেও ভূমিকা রাখে। কোনো ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে যদি নক্ষত্র চলে আসে তাহলে ব্ল্যাকহোল সেই নক্ষত্রকে গ্রাস করে ফেলে। তখন নির্গত হয় তাপ ও বেতার তরঙ্গের। আর সেই বেতার তরঙ্গ থেকেই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব ও অবস্থান আবিষ্কার সম্ভব হয়!
তবে সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায় যখন কোন ব্ল্যাক হোলের অতি নিকটে কোন নক্ষত্র বা গ্রাস করার মতো কিছু থাকে না। তখন এরা সম্পূর্ণ চোখের আড়ালে থাকে আর এসকলকে বলা হয় “Dormant বা সুপ্ত” ব্ল্যাক হোল। সুপারনোভা (নক্ষত্রের বিস্ফোরণ) থেকে তৈরি কোন স্টেলার ব্ল্যাক হোল যদি এমন সুপ্ত অবস্থায় চক্ষুকর্ণের আড়ালে থেকে যায় তখন তাকে Dormant Stellar Black Hole বলে। এসকল ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মহাকাশ গবেষকরা বছরের পর বছর লক্ষ কোটি নক্ষত্রের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে থাকে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে। তার মধ্যে কারো গতিবিধি যদি অস্বাভাবিক হয় তাহলে তাদের ডাটা গভীর ভাবে পর্যালোচনা করা হয়। সুপ্ত সেসকল ব্ল্যাক হোল গ্রাস না করতে পারলেও অদূরবর্তী নক্ষত্রের গতিবিধিতে প্রভাব ফেলে স্বাভাবিক বিচরণ ব্যাঘাত ঘটায়। আর সেই অস্বাভাবিক বিচরণ থেকেই আবিষ্কার করা হয় Dormant Black Hole। আমাদের সদ্য আবিষ্কৃত Gaia BH3 ও একটি Dormant Stellar Black Hole। তাই নাকের ডগায় থেকেও এতদিন ছিল লুকায়িত।
গবেষকদের মতে Gaia BH3 আবিষ্কার ছিল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। Europe Space Agency তাদের Gaia Space Mission এ অন্তর্ভুক্ত প্রজেক্টের জন্য ২০১৩ সালে মহাকাশে একটি টেলিস্কোপ লঞ্চ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিকট ও দূরবর্তী বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র সমূহের ত্রিমাত্রিক মডেল (3D Model) তৈরি করা। এক পর্যায়ে তারা উত্তর গোলার্ধের (Northern Hemisphere) আকাশে একটি তারার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেন। অতঃপর চিলির আতাকামা মরুভূমি (Atacama Desert)-তে অবস্থিত বৃহৎ টেলিস্কোপের মাধ্যমে নতুন এই সুপ্ত ব্ল্যাক হোল এর সন্ধান পান যা মাত্র ২০০০ আলেক বর্ষ দূরে। এটি এপর্যন্ত পাওয়া দ্বিতীয় নিকটবর্তী ব্ল্যাক হোল।
এর আগে আবিষ্কৃত স্টেলার নক্ষত্র Gaia BH1 আমাদের সর্ব নিকটবর্তী ব্ল্যাকহোল যা মাত্র ১৫৬০ আলোকবর্ষ দূরে এবং সূর্যের ভরের ৯.৬ গুণ সমপরিমাণ। গবেষণায় আরো পাওয়া যায় ব্ল্যাক হোল Gaia BH3 এর চারপাশে ঘূর্ণায়মান তারকাটি ১১.৬ বছরে ব্ল্যাক হোলটিকে একবার প্রদক্ষিণ করে।
অনাকাঙ্ক্ষিত এই আবিষ্কারটি অনেকের মতে Once in a Lifetime Achievement, আবার অনেকের মতে এটি মহাকাশ প্রেমীদের জ্ঞান পিপাসায় নতুন দ্বার উন্মোচিত করবে।
এস এম ইফতেখার আলম / নিজস্ব প্রতিবেদক
সোর্স: দ্য গার্ডিয়ান, লাইভ সায়েন্স, স্পেস.কম