নীল আলো বা ব্লু লাইট হলো একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো যা সূর্যের আলো সহ প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত সকল আলোতে উপস্থিত থাকে। অন্যান্য রঙের আলোর তুলনায় নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ছোট হয়। চিকিৎসকদের মতে স্বল্প দৈর্ঘ্যের আলো চোখের ক্ষতির সাথে জড়িত। আর ব্লু লাইট ব্লকিং গ্লাস/ নীল আলোর চশমা হলো এমন চশমা যা বিশেষভাবে নীল আলোকে ব্লক বা ফিল্টার করার জন্য তৈরি করা হয়। তাহলে কোনটা সঠিক? চলুন এই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪৫০ থেকে ৪৯৫ ন্যানোমিটার যা খুব সহজে মানুষের চোখ ভেদ করতে পারে। এর মানে হলো যে প্রায় সমস্ত দৃশ্যমান নীল আলোর রশ্মি কর্নিয়া এবং লেন্সের মধ্য দিয়ে রেটিনা পর্যন্ত (চোখের পিছনের আস্তরণ) চলে যেতে সক্ষম। কিছু বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন যে নীল আলোর অত্যধিক এক্সপোজার রেটিনার আলো-সংবেদনশীল কোষগুলোর ক্ষতি করার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও অনেক ইলেকট্রনিক্স (লাইট বাল্ব সহ) নীল আলো নির্গত করে। কম্পিউটার স্ক্রীন এবং টেলিভিশন সাধারণত অন্যান্য ইলেকট্রনিক্সের তুলনায় বেশি নীল আলো নির্গত করে। কারণ কম্পিউটার এবং টেলিভিশন সাধারণত লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লে বা এলসিডি (LCD) ব্যবহার করে।
ব্লু লাইট ব্লকিং গ্লাস/নীল আলোর চশমা কি?
নীল আলোর চশমা (কখনো কখনো ব্লু লাইট ব্লকিং গ্লাস বলা হয়) হলো এমনভাবে ডিজাইন করা চশমা যাতে লেন্সগুলোর মাধ্যমে চোখে পৌঁছানো নীল আলোর পরিমাণ কমানো যায়। অর্থাৎ, এই লেন্সগুলো নীল আলোক রশ্মিগুলোকে চোখে প্রবেশ করতে এবং সম্ভাব্য ক্ষতি হতে বাধা দিতে সাহায্য করে। সাধারণত নীল আলোর লেন্সগুলোতে একটি হালকা হলুদ আভা থাকে (নীল আলোর ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য), তবে আপনি সাধারণত এটি লক্ষ্য করতে পারবেন না।
নীল-আলো-ফিল্টারিং চশমা মানুষের চোখকে ইলেকট্রনিক স্ক্রিনের ক্ষতিকর আভা থেকে রক্ষা করার জন্য একটি জনপ্রিয় সমাধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি রিভিউ পেপার দেখায় যে এই ধরনের লেন্সগুলো মানুষ যতটা কার্যকর মনে করে, ততটা কার্যকর নাও হতে পারে।
Cochrane ডেটাবেস-এর এক পর্যালোচনায় গত ১৮আগস্ট,২০২৩ ইং এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি পূর্ববর্তী ট্রায়ালগুলোর ডেটা বিশ্লেষণ করেছে যে কীভাবে নীল-আলো-ফিল্টারিং লেন্সগুলো চোখের ক্লান্তি, ঘুমের গুণমান এবং চোখের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন যে চোখে নীল-আলো ফিল্টার পড়ে কম্পিউটার ব্যবহার করার পরেও মানুষের চোখের চাপ কমে না। ঘুমানোর আগে এই বিশেষ লেন্সগুলো পড়লে ঘুমের গুণমান উন্নত করে কিনা তা নিয়ে ফলাফলগুলো অনিশ্চিত ছিল।
বেশ কয়েকটি গবেষণায় ঠিক একই জিনিস পাওয়া গেছে। অর্থাৎ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে নীল আলো ব্লকিং লেন্স চোখের স্ট্রেনের/চোখের ক্লান্তির উপর কোন প্রভাব ফেলে কিনা।
ভারত, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশে নীল-আলো-ফিল্টারিং চশমার জন্য উচ্চ প্রেসক্রিপশন হার দেখা গেছে। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অস্ট্রেলিয়ার অপ্টোমেট্রিস্টদের জরিপ করেছেন এবং দেখেছেন যে তাদের প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্লিনিক্যাল প্রেসক্রিপশনে ডাক্তাররা ব্লু লাইট ব্লকিং গ্লাস নির্ধারণ করেছেন।
নতুনভাবে পর্যালোচনার জন্য ডাউনি এবং তার সহকর্মীরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণায় ১৫৬ জন অংশগ্রহণকারী ছিল এবং এটি পাঁচ সপ্তাহেরও কম সময় ধরে চলে। ট্রায়ালগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ার লেন্সের তুলনায় দৃষ্টি ক্লান্তি কমানোর জন্য নীল-আলো-ফিল্টারিং চশমা ব্যবহার করার কোনো আলাদা সুবিধা নেই। গবেষকরা রেটিনাল ক্ষতির মতো চোখের স্বাস্থ্যের অন্যান্য অবস্থার উপর লেন্সের প্রভাব সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
যদিওবা মানুষ মনে করে যে নীল আলো চোখের চাপ সৃষ্টি করে বা খারাপ করে, কিন্তু রোজেনফিল্ড মনে করেন এটি ভুল ধারণা। নীল আলোর সবচেয়ে বড় উৎস হল সূর্য; মানুষ সৌর রশ্মি থেকে যে পরিমাণ নীল আলো পায় তার ১ শতাংশেরও কম ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন নির্গত করে। তিনি আরো বলেন, “এমন কোনো শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নেই যে নীল আলো চোখের ক্লান্তি সৃষ্টি করে।”
ডাউনি বলেছেন, “মানুষ ফোন বা কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সময় চোখে যে চাপ অনুভব করে তা সম্ভবত একাধিক কারণের কারণে হয়। যেমন খারাপ অভ্যাস বা অন্তর্নিহিত অবস্থা”।
তিনি এবং রোজেনফিল্ড উভয়েই যুক্তি দেন যে মানুষ কীভাবে ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ব্যবহার করে চোখের চাপ সৃষ্টিতে অবদান বেশি রাখে। স্ক্রিন ব্যবহারের ফ্রিকুয়েন্সি এবং সময়কাল পরিবর্তন করা এবং স্ক্রীন থেকে চোখকে দূরে রাখা অস্বস্তি কমাতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি আরো বলেছেন যে, যারা চোখের স্ট্রেন/ক্লান্তি অনুভব করেন তাদের কোনো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন দূরদৃষ্টি বা শুষ্ক চোখের রোগ আছে কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্য ডাক্তার দেখানো উচিত।
ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টিতে নীল আলোর প্রভাব
খারাপ ঘুম এর সাথে স্ক্রিন থেকে নীল আলোর এক্সপোজারের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পূর্ববর্তী গবেষণায় রোজেনফিল্ড বলেছেন যে গভীর রাতে ডিভাইস ব্যবহার ঘুম ব্যাহত করে। নীল আলো মেলাটোনিন নিঃসরণে বাধা দেয় আর মেলাটোনিন হলো এমন হরমোন যা মস্তিষ্কে ঘুমের সংকেত পাঠায় অর্থাৎ এটি ঘুম চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ গবেষকরা নীল আলোর সাথে ঘুম চক্রের ব্যাঘাতের সংযোগ করতে পেরেছেন।
ডাউনি এবং তার দলের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে ঘুমানোর আগে নীল আলোর ফিল্টার ব্যবহার করা সত্যিই কোনো প্রভাব ফেলে না। যদিও ছয়টি পরীক্ষায় বলা হয়েছিলো যে ঘুমানোর আগে নীল-আলো-ফিল্টারিং লেন্স পড়া ঘুমের গুণমানকে প্রভাবিত করে কিন্তু ওই সকল গবেষণার ফলাফলগুলো অসংগত ছিল। গবেষণায় নীল আলোর ফিল্টার-পরিধান করা গ্রুপ এবং নিয়ন্ত্রণ গ্রুপের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। তবে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগের মধ্যেই স্লিপ ডিসঅর্ডার/ ঘুমের ব্যাধি রয়েছে।
রোজেনফিল্ড বলেছেন, ঘুমের উন্নতির জন্য আরেকটি বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে স্মার্টফোনে “নাইট শিফট” বা “ডার্ক মোড” সক্রিয় করা। এই মুডগুলো ডিভাইসের স্ক্রিনকে উষ্ণ রং নির্গত করতে, একদৃষ্টি কমাতে এবং নীল-আলো নিঃসরণ কমাতে ভূমিকা রাখে।
রোজেনফিল্ড বলেছেন যে চোখের যত্নের উপর নীল আলোর ফিলটার ব্যবহারের প্রভাব বোঝার জন্য আরও বিস্তৃতভাবে গবেষণা প্রয়োজন।
নিজস্ব প্রতিবেদক / মাইশা নিজাম
তথ্যসূত্র: সিবিএস, সিএনএন, সাইন্টিফিক আমেরিকান, সিএনইটি