ব্যাকটেরিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় এটি ১৯৯১ সালেই প্রথম অনুমান করে ফেলেন বিজ্ঞানীরা। মূলত ব্রিটিশ মাইকোলজিস্ট ক্রিম পোর্টার তখন লক্ষ্য করেন যে ব্রিউয়ার ইস্ট নামক একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। মূলত ঈস্ট টি সেরেভিয়া নামক এককোষী ছত্রাক থেকে তৈরি যা সাধারণত বিয়ার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
ঠিক তারপর থেকেই বিজ্ঞানীরা মাইক্রোবায়াল কোষের জ্বালানি শক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এটি এতটা সহজ ব্যাপার ছিল না সে সময় থেকেই।
তবে এখন যুগ পাল্টেছে। সেই সাথে এটিও বাস্তবে ব্যবহারের জন্য আশার আলো দেখছেন বিজ্ঞানীরা। সুইজারল্যান্ড ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি লুসান এর একদল গবেষক বর্জ্য পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য ব্যাকটেরিয়ার অন্যতম এক প্রজাতি E. Coli (Escherichia Coli) প্রকৌশল করেছেন। যা বর্তমানে জৈব প্রকৌশল স্টেইনগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং বহুমুখী মাইক্রোবায়াল বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। (এই ব্যাকটেরিয়াটি সাধারণত একটি রড-আকৃতির ব্যাকটেরিয়া যার জেনেটিক গঠন সহজে ব্যবহার করা যায়। এজন্য এটি বিশ্বব্যাপী জীবাণু গবেষকদের সব থেকে প্রিয়।)
গবেষণা সম্পর্কে গবেষক দলের একজন ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রধান লেখক আর্ডেমিক বঘোসিয়ান বলে, “আমাদের গবেষণায় যদিও এগুলো ছাড়াও অন্য ব্যাক্টেরিয়া উপস্থিত ছিল যেগুলো কিনা প্রাকৃতিক ভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। তবে আমরা লক্ষ্য করেছি এগুলো শুধু কিছু নির্দিষ্ট বিক্রিয়ার সামনে এসেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে।”
এই ব্যাক্টেরিয়াটি (E. Coli) অনেক বড় উৎস জুড়ে বৃদ্ধি পেতে সক্ষম। যা আমাদের বর্জ্য জল ছাড়াও একটি বিস্তৃত অংশ জুড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম।”
প্রাকৃতিকভাবে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব আছে যারা নিজেরাই নিজেদের কাজে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। সেদিক বিবেচনায় এবং E. Coli ব্যাকটেরিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গবেষকরা এই জিনোম পরিবর্তন করে প্রোটিন কমপ্লেক্সে এমন কিছু নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করেন যা Shewanella oneidensis নামক ব্যাকটেরিয়ায় পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে এটি ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে অন্যতম বিদুৎ জেনারেটর হিসেবে বিবেচিত।
E. Coli তে এই ব্যাকটেরিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন পাথওয়ের সমস্ত কিছু অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে গবেষণার প্রধান লেখক বঘোসিয়ান এবং তার দল পূর্বের প্রকৌশলী স্টেইনগুলোর তুলনায় এর ইলেক্ট্রো অ্যাক্টিভিটি দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন বলে ধারণা করেন।
এখন সন্দেহভাজন ব্যাপার হলো, এই পরীক্ষাগুলো কেবল ল্যাবের একটি রুমে করা। এটি শিল্প রূপে কতটুকু কাজ করতে পারবে সেটাই আসল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কেননা যেকোনো সম্ভাব্য প্রযুক্তির আসল পরীক্ষা হলো এটি শিল্প পরিবেশে গিয়ে কাজ করতে পারে কিনা।
অতীতে যে গবেষণাগুলো করা হয়েছে সেখানে মদ তৈরির বর্জ্য পানির শ্যাওলা ব্যবহার করা হয়েছে। মদগুলোর শস্য এবং তার ট্যাংকগুলো জীবাণু মুক্ত করার আগে যে পানি ব্যবহার করা হয় তা প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। কেননা যেখানে শর্করা, স্টার্চ, অ্যালকোহল এবং ঈস্টগুলোর একটি মিশ্রণ হিসেবে থাকে। যা প্রক্রিয়াজাত না করলে অনাকাঙ্ক্ষিত মাইক্রোবায়াল ফুয়েল ট্রিগার করে ফেলতে পারে।
এজন্য উক্ত দলটি স্থানীয় লুসানের একটি মদ কারখানা থেকে সংগৃহীত বর্জ্য পানির নমুনার উপর পরীক্ষা করেছে। যা পরবর্তীতে তারা লক্ষ্য করেন যে E. Coli ব্যাকটেরিয়াগুলো সহজেই ৫০ ঘণ্টায় এগুলো ভক্ষণ করে ফেলতে সক্ষম।
এ সম্পর্কে বঘোসিয়ান আবারও বলেন যে, “যেখানে পূর্বের ব্যাকটেরিয়া (Shewanella oneidensis) টি মিশ্র বর্জ্য হজম করতে সক্ষম ছিল না সেখানে E. Coli এই বর্জ্যকে খাওয়ার পর খুব সহজে এবং দ্রুত বিকাশ লাভ করতে সক্ষম হয়।”
গবেষকরা মনে করছেন যদি এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা Shewanella oneidensis এর তুলনায় ধীরে হলেও তবুও শিল্প বর্জ্য পানির ট্রিটিং এ E. Coli ব্যাকটেরিয়াটি বেশি উপযোগী করে তুলবে।
গবেষণাটি যে জার্নালে প্রকাশিত হয় (Joule) সেখানকার গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক মোহাম্মদ মুহিব বলেন যে, “আমাদের এ কাজটি সময়োপযোগী বলে মনে করি। কারণ ইঞ্জিনিয়ারড বায়োইলেক্ট্রিক জীবাণুগুলো যেন এখন বাস্তব বিশ্বের অ্যাপ্লিকেশন সীমানাকে ঠেলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা গবেষণার প্রচেষ্টার সাথে আমরা বায়োইলেক্ট্রিক ব্যাকটেরিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উত্তেজিত।”
সব শেষে আবারও এই একটি মূল কথাই আসে যে, গবেষকদের এই পরিবর্তিত E. Coli ব্যাকটেরিয়া শিল্প ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া করতে কতটুকু সক্ষম তা পরীক্ষা করতে হবে। যদি এটি সফল হয় তবে এটি আমাদের জন্য উল্লেখযোগ্য সঞ্চয় শক্তি নিয়ে আসতে পারে।
বঘোসিয়ান যদিও তাদের এই অর্জনকে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করবে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এখন আমরা জৈব বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য সিস্টেমের উপর শক্তি প্রয়োগ করার পরিবর্তে আমরা উলটো এর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। যার ফলে এক ঢিলে দুই পাখিকে আঘাত করছি আমরা।”
মাহফুজুর রহমান রিদোয়ান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সাইন্স ডেইলী, ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইন্স অ্যালার্ট