মনেরা রাজ্যের এককোষী জীব হলো ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া নামটা শুনলে আমাদের কেমন জানি মনে হয় এটি আমাদের জন্য অপকারী এবং ক্ষতিকর একটা জিনিস। আমাদের এই ধারণাটি মিথ্যা না হলেও কিন্তু এই ধারণাতে কিছুটা পরিবর্তন আনাটা জরুরি। জ্বি, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষকদের এক গবেষণা আমাদের ধারণা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।
কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক হিসেবে, চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাক্টেরিয়ার ব্যবহার করা হয়। এমনকি অনেকের প্রিয় খাদ্য দই সহ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাক্টেরিয়ার ব্যবহার হয়তো শুনেছেন। এবার এই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহৃত হবে টেক্সটাইলে এবং ফ্যাশন ডিজাইনিং এর ক্ষেত্রে। এটি দ্রুত, সস্তা এবং টেকসই হবে বলে টেক্সটাইল শিল্পের জন্য এ এক সুসংবাদ।
টেক্সটাইল এবং লেদার শিল্পের প্রক্রিয়াজাতকৃত সিস্টেমের কারণে গ্রিন হাউজ গ্যাস ইফেক্ট, চর্মঃসংস্কার এবং এদের রঞ্জিতকরণ প্রক্রিয়ার কারণে জলদূষণ হয়। এছাড়াও কৃত্রিম ফাইবার শেডিং থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই পরিবেশের দূষণের কথা চিন্তা করে পাতলা প্লাস্টিক অথবা লেদারের পরিবর্তে ব্যবহৃত হবে এই জিনিসটি।
ব্যাকটেরিয়ার সেলুলোজ হলো এমন একটি কার্যকরী প্রাকৃতিক জৈব উপাদান যা পরিবেশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না বলে গবেষকদের ধারণা। প্রথমদিকে গবেষকরা কম্বুচা ব্যাক্টেরিয়া থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত সেলুলোজ পৃথকীকরণ করার মাধ্যমে তৈরি করেন আকর্ষণীয় এই জিনিসটি।
প্রাকৃতিক উপাদান চুল, ত্বকের রঙে একটি প্রাকৃতিক পিগমেন্ট থাকে যার জন্য চুল কালো, বাদামি বর্ণ এবং ত্বক সাদা কালো হয়ে থাকে। ত্বক সাদা কালো হতে মেলানিন পিগমেন্ট দায়ী থাকে। যার জন্য টেক্সটাইল পণ্যসামগ্রী আকর্ষণীয় করতে রঞ্জিতকরণের জন্য কৃত্রিম পিগমেন্ট ব্যবহার করা হয় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তো বটেই, সেই সাথে স্থায়ীও নয়। রং নষ্ট হয়ে যায়।
কালো রঞ্জক এই রঞ্জিতকরণের মধ্যে বহুল ব্যবহৃত। কম্বুচা ব্যাক্টেরিয়া থেকে প্রাপ্ত কালো রং গবেষকদের আশানুরূপ না হওয়ায় তারা ব্যাক্টেরিয়ার আরেকটি সহোদরকে খোঁজে নেয়। কোমাগাটাইব্যাক্টর র্যাটিকার নামক মডিফাইড সেই ব্যাক্টেরিয়া প্রজাতির সেলুলোজকে একই মাত্রার পিএইচ সম্পন্ন স্পন্দনরত পানিতে দ্রবীভূত করলে প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি কালো রং দেখতে পান।
দুটি মাধ্যম ব্যবহার করে প্রস্তুত করা হয় সেলুলোজ। প্রথমটি HS- গ্লুকোজ (২% গ্লুকোজ, ১০ গ্রাম/লি ইস্ট, ১০ গ্রাম/লি পেপটোন, ২.৭ গ্রাম/লি সোডিয়াম বাই ফসফেট এবং ১.৩ গ্রাম/লি সাইট্রিক অ্যাসিড pH:5.6-5.8) এবং নারিকেল জল মাধ্যম। এই মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া পলিমার গঠন করে এবং গ্লুকোজে বৃহৎ সরল চেইন হিসেবে নিঃসরিত হয়। এই চেইনগুলো একে অপরের সাথে তখন ঘনভাবে আন্তঃসংযুক্ত হয়ে সেলুলোজ ফাইবারের একটি জাল সৃষ্টি করে। সৃষ্ট এই জালকে পেলিকল বলা হয়ে থাকে।
এই পেলিকলগুলো বাতাস এবং পানিতে ভাসতে পারে এবং বেড়ে উঠা কোষগুলোকে সুরক্ষাও প্রদান করতে পারে। ব্যাক্টেরিয়া পেলিকলগুলো (৭-১৪) দিনের মধ্যে তৈরি করা যেতে পারে। যার জন্য এটি একটি কম সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পচা ফলের রস, গুড়ের মতো খাদ্য উপাদান থেকে তৈরি করা যাবে এই পেলিকল। এই জিনিসগুলো সহজলভ্য বলে এই পেলিকল তৈরি করাও সহজ।
গবেষণাটি সম্পর্কে এক গবেষক জানান,
“আমরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া থেকে পিগমেন্ট উৎপাদন করি। আমরা প্রমাণ করেছি যে, রাইটিকাস ব্যাক্টেরিয়া থেকে উৎকৃষ্ট পিগমেন্ট পাওয়া সম্ভব।
এই অধ্যয়নটি যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভূমিকা রাখবে তেমনি শিল্প ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের ধারণা”।
গবেষকরা তাদের এই পরীক্ষা থেকে সন্তুষ্ট হলেও আরো পরিশোধন এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন। এটি পরিবেশের জন্য এখনো নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছেন এই বিষয় নিয়ে কাজ করা গবেষকরাই। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি প্রচুর পানি শোষণ করার ক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়াও এটি পরিবেশে রাসায়নিক পদার্থ মুক্ত করতে সক্ষম। যার জন্য এ বিষয়টি এখনো ততটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। তবে একবার সফলতা অর্জিত হলে এক বিরল নজির স্থাপিত হবে টেক্সটাইল শিল্পে।
গবেষণায় সম্পৃক্ত সহকারী গ্রন্থকার টম এলিস বলেন,
“আসলে এই পৃথিবীতে ভালো কিছু হবে এমন কিছু অর্জন করা কষ্টকর। ১০ বছরেও এটি ভাঙবে না, এটি আপনি কম্পোস্টে ফেলে দিতে পারবেন এবং বছরের অর্ধেকের আগেই এটা মাটিতে মিশে যাবে।”
মানে এটি লেদার এবং পাতলা প্লাস্টিকের চমৎকার বিকল্প হতে চলেছে। বাজারে আসলে বিপুল সাড়া পাবেই বলে ধারণা। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিষয়টি সম্পর্কে সাধুবাদ এবং এর সুবিধা নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান।
মো. বোরহান উদ্দিন / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ন্যাচার.কম, সায়েন্স.অর্গ, সায়েন্স ডেইলি