ঘুমের মধ্যে কি আপনার কখনো এমন মনে হয় যে কোন কিছু বুকের উপর চাপ দিয়ে ধরেছে? আপনি পুরোপুরি সেই অশরীরির হাতে নিস্তেজ হয়ে গেছেন। কোন ক্রমেই হাত পা নাড়াতে পারছেনা বা শব্দ করে চিৎকার করতে পারছেন না? রাতে ঘুমাতে ভয় পাচ্ছেন?
গ্রামাঞ্চলে এটিকে বোবাই ভূত ধরা হিসেবেই সবাই জানে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর নাম হচ্ছে Sleep Paralysis. ঘুমের মধ্যে এটি এক ধরনের সাময়িক প্যারালাইসিস বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ঐচ্ছিক পেশির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
কেন ধরে বোবাই ভূত?
একটা সময় ছিলো যখন বিশ্বাস করা হতো শয়তানের কুমন্ত্রণায় এমনটা হয়ে থাকে। কিন্তু একজন মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু বকর রাবি ইবনে আহমেদ আখওয়ানি বুখারী (মৃত্যু ৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁঁর অনন্য মেডিকেল সায়েন্সের বই হিদায়া আল মুতা’আল্লেমিন ফিল তিব্ব (Learner’s guide to medicine) [1] – তে দাবী করেন এই স্লিপ প্যারালাইসিসে জ্বিন ভূতের কোন হাত নেই, পুরো ব্যাপারটিকে বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা দ্বারা সঙ্গায়িত করা যায়। তিনি বলেন, অনিদ্রা ও অনিয়মিত ঘুমের জন্য এই সমস্যাটি হয়ে থাকে।
বর্তমানে আমরা যেভাবে এর ব্যখ্যাটি জানি তা হলো, ঘুমের সময় দুটো মৌলিক ঘটনা ঘটে-
১. আমাদের অবচেতন মন সামনে চলে আসে আর সচেতন মন সাময়িক গভীরে চলে যায়।
২. অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অসাড় হয়ে যায়, ঐচ্ছিক পেশিগুলো শিথিল হয়ে যায়। কেননা স্বপ্নে আমরা অনেক সময় দৌড়াদৌড়ি করি, লাফালাফি করি। ঘুমের সময় যদি ঐচ্ছিক পেশিগুলো অ্যাক্টিভ থাকে তাহলে স্বপ্নে মারামারি করতে গিয়ে পাশে থাকা মানুষটির ক্ষতি আমরা করে ফেলতে পারি। এমনকি নিজেদের ক্ষতিও করে ফেলতে পারি। এই নিরাপত্তার জন্যই মস্তিস্ক আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পেশিগুলোকে শিথিল করে ফেলে।
এখন ঘুমোতে যাওয়ার সময় বা হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে মস্তিক সজাগ হয়ে যায় কিন্তু হাত পা বা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এতো দ্রুত সজাগ হতে পারেনা। ফলে আমরা হাত পা নাড়াতে চাই কিন্তু হাত পা নড়েনা! আমরা ভাবি এই বুঝি শেষ! চিৎকার করতে চাই কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়না। অনেকে ভয় পেয়ে ঘামতে থাকেন, মনে হয় বুকের উপর কিছু একটা উঠে বসেছে।
এমনকি অতিপ্রাকৃতিক কোন অশরীরি অবয়বও দেখে থাকেন, অনেকে কন্ঠও শোনেন। স্বপ্নের মত অনুভূতিটা এখানে অত্যন্ত জীবন্ত মনে হয়। অনেক ভয় পেয়ে ঘুমানোই ছেড়ে দেন। অথচ কিছু কাজের মাধ্যমে আমরা একে প্রতিরোধ করতে পারি।
স্লিপ প্যারালাইসের পূর্বের মুহুর্তটা খুবই সেনসিটিভ। আমরা অনেকেই ঘুমের ঘোরেই আশেপাশের শব্দ পাই, এটাও এক ধরনের স্লিপিং ডিসঅর্ডার। এই সময়টা সঠিকভাবে হ্যান্ডেল না করলে বিপদ হতেও পারে।
কিভাবে বোবা ভূত থেকে রক্ষা পাবো?
স্লিপ প্যারালাইসিস থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাওয়ার কোন পদ্ধতি এখন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। জীবনে একবার হলেও এটার শিকার আপনাকে হতে হবে। যদি যারা খুব বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের জন্য কিছু টিপস রয়েছে। নিন্মের টিপসগুলো মেনে চললে ইনশাআল্লাহ এধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।
১। একদম পিঠে বা বুকে ভর দিয়ে ঘুমালে এই সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। চেষ্টা করুন পাশ ফিরে ঘুমোতে। তবে বাম পাশে না ঘুমানোটাই ভালো, বাম দিকে ঘুমালে হৃদযন্ত্রে চাপ পড়ে।
২। ঘুমের প্যাটার্ন পরিবর্তন করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। দুপুরে না ঘুমানোটাই ভালো। এর পরিবর্তে টানা ঘুম শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
৩। একদম নরম বিছানা পরিহার করুন। একটু শক্ত (যেমন অর্থোপেডিক ম্যাট্রেস) বিছানায় ঘুমানোর চেষ্টা করুন। একদম নরম বিছানা ঘুমের সময় রক্ত সঞ্চালনে অনেক বাধার সৃষ্টি করে। শরীরের কোথায় নার্ভ আঘাতপ্রাপ্ত হলে মস্তিস্কে অক্সিজেন পরিবহনে সমস্যা হয় ফলে মস্তিস্ক জেগে ওঠে।
৪। ঘুমানোর আগে অবশ্যই ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা এ জাতীয় ইলেক্টেনিক্স ডিভাইস বন্ধ করুন বা একদম সাইলেন্ট করুন। ঘুমের মাঝে ছোট একটি বিপ শব্দও মস্তিস্ককে অহেতুক জাগিয়ে তোলে। ফলে এই সমস্যাটা হতে পারে।
৫। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সব ধরনের হিসেব নিকেশ, মামলা মোকদ্দমা, সম্পর্কে জটিলতা, জটিল গানিতিক হিসাব, প্রোগ্রামিং সমস্যা, দুশ্চিন্তা, আগামীকালের পরিকল্পনা, টিভি সিরিজ বা প্রিয় লেখকের বইটির বাঁকি অংশ, কারও প্রতি ক্ষোভ বা প্রতিশোধপরায়ন মনোভাব সবকিছু ঝেড়ে ফেলুন। একদম ঠান্ডা ও স্থির মস্তিস্ক নিয়ে ঘুমাতে যান। ঘুমানোর আগে নিজেকে বোঝান, আপনি সবচেয়ে সুখী মানুষ।
৬। গভীর ঘুমের প্রয়োজন। তাই প্রাকৃতিকভাবে Sound Sleep এর চেষ্টা করুন। কলার মধ্যে প্রচুর সিডাটিভ রয়েছে, কলা বা আম খেলে দ্রুত ঘুম আসে। ফ্যানের ক্যাচক্যাচ আওয়াজ থেকে মুক্ত কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হউন।
কিন্তু যদি শত ব্যবস্থার পরেও বোবাই ভূত ধরে ফেলে তাহলে কী করবেন?
এরও সমাধান রয়েছে।
১। স্লিপ প্যারালাইসের সময় প্যানিক হবেন না। শান্ত থাকার চেষ্টা করুন। লম্বা নিশ্বাস নিন।
২। আপনি এখন স্লিপ প্যারালাইসের কারন জানেন, ফলে অহেতুক ভয় পাবেন না। এটা খুবই সাময়িক ব্যাপার। স্লিপ প্যারালাইসিস সকলেরই হয়। স্লিপ প্যারালাইসে শরীরের তেমন ক্ষতি হয়না, ভয়ের কারনে বা আতঙ্কেই ক্ষতি হয়। এসময় শান্ত না থাকলে প্যানিকের কারনে স্থায়ী প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩। প্রথমে আপনার ছোট ছোট একক পেশিগুলোকে নাড়ানোর চেষ্টা করুন। যেমন পায়ের আঙ্গুল বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি। ছোট একটি অঙ্গ নাড়াতে পারলেই সাথে সাথে স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন।
৪। মানবদেহের সবচেয়ে শক্তিশালী পেশি হচ্ছে জিহবা। তাই জিহবাকে নাড়াতে পারাটাই সবচেয়ে সহজ ও যুক্তিসঙ্গত। জিহবা নাড়াতে পারলে বাকি অঙ্গগুলো এমনিতেই জেগে উঠবে। আমি নিজে এমনটার শিকার হলে সৃষ্টিকর্তার নাম উচ্চারণের চেষ্টা করে বারবার ভালো ফলাফল পেয়েছি। জিহবা তো নাড়াতেই হবে, তো আজে বাজে শব্দ উচ্চারণ না করে সৃষ্টিকর্তার নাম উচ্চারণ করতে তো বাধা নেই।
৫। স্লিপ প্যারালাইস থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সাথে সাথে ঘুমাবেন না, একটু সময় নিন। পানি খান, হালকা ব্যায়াম করুন। জটিল ও দুর্বোধ্য বই পড়তে পারেন। এরপর ঘুমান।
সায়েন্স বি গ্রুপে যারা স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তাদের জন্যই এই লেখা। আশা করি উপরোক্ত নিয়ম মেনে চললে এ ধরনের সমস্যা আর হবেনা। লেখনীতে কোন ভুল ত্রুটি দেখা গেলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে আমাকে জানাবেন। যদি কারও এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করুন, চেষ্টা করবো আমরা সবাই মিলে সমাধানের। দিন শেষে সবাই সুস্থ্য থাকুন, নিরাপদে থাকুন। ফেসবুকে কারও পরামর্শে ঔষধ সেবন হতে বিরত থাকুন। স্লিপ প্যারালাইসিস জটিল আকার ধারন করলে অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জাফরান হাসান / নিজস্ব প্রতিবেদক
SOURCE: