আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে প্রথমবারের মতো রেকর্ড করা হলো অদ্ভুত বুমেরাং ভূমিকম্প। ২০১৬ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে একটি বিশাল ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। তবে এটি ছিলো কিছুটা অস্বাভাবিক প্রকৃতির, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এর তরঙ্গ প্রথমে পূর্বদিকে অগ্রসর হলেও পরবর্তীতে দিক পরিবর্তন করে পশ্চিম দিকে চলে যায়। ভূ-তাত্ত্বিক পরিভাষায় একে বলা হয় বুমেরাং ভূমিকম্প।
ভূমিকম্প সাধারণত এক দিকে অগ্রসর হয়। তবে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বুমেরাং ভূমিকম্পের কথা আলোচনা করছেন। কম্পিউটার মডেলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই ধরনের ভূমিকম্প সম্ভব ছিল। কিন্তু আগে কখনো সরাসরি বৈজ্ঞানিকভাবে রেকর্ড করা হয়নি।
এই আশ্চর্যজনক জটিল ভূমিকম্প সাধারণত ভূত্বকের এক প্রকার বিচ্যুতি অঞ্চলে সংগঠিত হয় যাকে বলা হয় “ট্রান্সফর্ম ফল্ট”। এই ধরনের ফাটলগুলো সাধারণত সরলরৈখিক হয় এবং পাশাপাশি অবস্থিত ভূত্বকের দুটি খণ্ডকে (টেকটোনিক প্লেট) আলাদা করে থাকে। সমুদ্রের মাঝ বরাবর এই ধরনের বিচ্যুতিগুলোর আধিক্য থাকলেও মহাদেশীয় প্লেটগুলোর মাঝেও এদের দেখা যায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলবর্তী সান অ্যান্দ্রেস ফাটল সহ এর মতো অন্যান্য সরলরৈখিক ফাটলগুলিতেও এরকম অদ্ভুত বুমেরাং ভূমিকম্প হতে পারে।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ভূমিকম্পবিদ ও এই গবেষণার সহ-লেখক স্টিফেন হিকস বলেছেন “এরকম জটিল ভূমিকম্পগুলি অস্বাভাবিক নয়, এটি আশ্চর্যজনক নয় কারণ বেশিরভাগ ফাটলই জটিল প্রকৃতির”। সাধারণত, সমুদ্রের ট্রান্সফর্ম ফল্ট মানুষের জন্য খুব কম বিপদ ডেকে আনে। এগুলি উপকূল থেকে অনেক দূরে এবং তাদের গতি অনুভূমিক, সুতরাং যখন এই ফাটলগুলো সৃষ্টি হয় তখন তা থেকে সুনামি হয় না।
তবে এই বিচ্যুতিগুলি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সান অ্যান্দ্রেস এর মতো ট্রান্সফর্ম ফল্ট ভুমিতে রয়েছে যা লোকালয়ের খুব কাছেই অবস্থিত। হিকস বলেন, “সমুদ্রের এই ট্রান্সফর্ম ফল্টগুলি কীভাবে কাজ করে তা বোঝার ফলে সান আন্দ্রেস ফাটল মতো আরও জটিল ফাটল কীভাবে কাজ করতে পারে সে সম্পর্কে আমরা কিছু তথ্য পেতে পারি”।
পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে ৩ ধরণের গতি বিদ্যমান। পরস্পর-মুখী, পরস্পর-বিমুখী এবং পাশাপাশি গতি। ট্রান্সফর্ম ফল্টগুলি সাধারণত পাশাপাশি গতিসম্পন্ন প্লেটগুলির মধ্যে দেখা যায়। তবে মহাসাগরের মাঝে যেখানে টেকটোনিক প্লেটগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যায় অর্থাৎ পরস্পর-বিমুখী প্লেটগুলোর মধ্যেও ট্রান্সফর্ম ফল্ট দেখা যায়। দুটি পরস্পর-বিমুখী প্লেটের সকল প্রান্তবিন্দুতে দূরে সরে যাওয়ার গতি সমান হয় না। এর ফলে ছড়িয়ে পড়া অঞ্চলগুলিতে সোজা লাইনের মত ফাটল দেখা দেয়।
হিকস বলেছেন, “সম্ভবত প্রতি ২০ থেকে ৫০ বছর পর পর এই ফাটলগুলিতে তুলনামূলকভাবে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়।” তিনি এবং তাঁর দল আটলান্টিক মহাসাগরে বিষুবরেখার কাছাকাছি একটি অঞ্চল, রোমানচ স্প্রেডিং জোনে ভূমিকম্প রেকর্ড করার জন্য সমুদ্রের তলদেশে সিসমোগ্রাফ স্থাপন করেন। এর কিছুদিন পরই, ২০১৬ এর আগস্ট মাসে ওই অঞ্চলের কাছাকাছি অঞ্চলে তারা ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করেন। এই অঞ্চলে ১৯৭০ সালের পর থেকে ৬.৫ বা তারও বেশি মাত্রার ১৩ টি ভূমিকম্প দেখা গেছে।
আমরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারি না কারণ ভূমিকম্পের সময় বিচ্যুতির পাশাপাশি কী ঘটেছিল আমরা ঠিক জানি না। বুমেরাং ভূমিকম্পগুলি এখনও বিরল হতে পারে, তবে গবেষকরা মনে করেন যে, ভুমিকম্প আরো ভালমতো বোঝার জন্য দরজা এখন উন্মুক্ত।
সোহানুর রহমান/ নিজস্ব প্রতিবেদক