মধ্যবয়স্করা ভালোই জানেন, বৃদ্ধ বয়সে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি শরীরের জন্য অত্যন্ত কঠিন হতে পারে! এই সময়ে আপনার হাড়গুলো থেকে ক্যালসিয়াম কমতে শুরু করে, আপনার পেশীগুলো কুঁচকে যেতে শুরু করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় এবং বাতে আক্রান্ত হতে পারেন আপনি। জীবনের শেষের দিকে যাওয়ার সাথে সাথে হৃদরোগ এবং মতিভ্রমও শরীরে দানা বাঁধে। একই লক্ষণগুলো, অন্য একটি কারণেও ঘটতে পারে এবং তা হলো মহাকাশ ভ্রমণ! তাই বর্তমানে বার্ধক্য প্রতিরোধ করতে বিজ্ঞানীরা ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন মহাকাশ ভ্রমণে!
স্পেসফ্লাইট নাটকীয়ভাবে মানবদেহকে প্রভাবিত করে এবং মহাকাশচারীরা পৃথিবীর মানুষের তুলনায় দ্রুত বার্ধক্যের প্রভাব অনুভব করা শুরু করে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা পূর্বের তুলনায় মহাকাশ ভ্রমণের প্রভাব সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা অর্জন করেছেন।
৫৬ জন নভোচারীর শারীরিক সমস্যাগুলো পরীক্ষা করে সেলস (Cells), সেল রিপোর্টস (Cell Reports), আইসায়েন্স (iScience), সেল সিস্টেমস (Cell Systems) এবং প্যাটার্নস (Patterns) জার্নালগুলিতে ২৯ টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। ৫৬ জন নভোচারীর সংখ্যাটি হলো এখন পর্যন্ত মহাকাশে যাওয়া মহাকাশচারীদের দশ শতাংশের বেশি।
নতুন কিছু গবেষণায় অংশগ্রহনকারী কলোরাডো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের (Colorado State University) রেডিওলজিস্ট সুসান বেইলি বলেছেন, “পুরো শরীর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, কারণ স্পেস একটি পৃথক এবং চরমভাবাপন্ন পরিবেশ”।
স্পেসফ্লাইটের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্য প্রভাবগুলির সাথে ক্যান্সার এবং অস্টিওপরোসিসের মতো বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার বেশ কিছু মিল রয়েছে। স্পেসফ্লাইটের বার্ধক্যের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদী ক্রু মিশনগুলোর জন্য উদ্বেগের বিষয়।
অনুমান করা হচ্ছে হৃৎপিণ্ড, রক্তনালী, হাড় এবং পেশী সাধারণ অবস্থার চেয়ে স্পেসে ১০ গুণ বেশি দ্রুত ক্ষয় হয়। এর অর্থ হলো বার্ধক্য প্রক্রিয়াটি বোঝার জন্য, পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না — বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে (আইএসএস) পরীক্ষা চালিয়ে বার্ধক্যের প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলতে পারেন।
বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলেছেন যে, মহাকাশ ভ্রমণের লক্ষণগুলো বার্ধক্যের মতো ঠিক একই রকম হয় না এবং লোকেরা পৃথিবীতে ফিরে আসার পরে অনেকগুলো পরিবর্তন উল্টে যায়, তারপরও তুলনাগুলো এখনও কার্যকর। স্পেসফ্লাইট এমন একটি অভিজ্ঞতা যা কোনও ভ্রমণকারীকেই রেহাই দেয় না। সুসান বেইলি বলেছেন মহাকাশ জীবন, বার্ধক্য বোঝার জন্য এবং প্রতিরোধ এর জন্য একটি ভাল মডেল।
আমাদের গ্রহের সমস্ত জীবন্ত কিছুই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ এবং বিভিন্ন পরিবেশগত শর্তাবলীর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে, তাই অন্য কোনও পরিবেশ আমাদের বাস করার জন্য অনুকূল না। “স্পেস বিভিন্ন কোষকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে”, বলেছেন আইএসএস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির অন্তবর্তীকালীন প্রধান বিজ্ঞানী মাইকেল রবার্টস। মহাকাশে সর্বোত্তমভাবে কাজ করার জন্য শরীর তার সুস্থিতির স্তরগুলো পুনরায় সেট করে। তিনি যোগ করেন, “এর ফলে কোষ প্রতিক্রিয়া দেখানোর শারীরবৃত্তীয় নিয়মগুলো পুনরায় চালু করে”।
মাইক্রোগ্রাভিটিতে হাড় এবং পেশীগুলোর পৃথিবীতে কাটানো সময়ের মতো কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। তরল বস্তু মহাশূন্যে পৃথকভাবে প্রবাহিত হয় এবং এর কারণে এটি মস্তিষ্কের তরল দ্বারা ভরা টিস্যুগুলির আকার পরিবর্তন করতে পারে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরের বিকিরণগুলো ডিএনএর ক্ষতি করতে পারে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। এমনকি সামান্য বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড স্তরও কোনও নভোচারীর ফিজিওলজি পরিবর্তন করে দিতে পারে।
স্পেসফ্লাইটের স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলি সম্পর্কে নতুন গবেষণায় নাসার যমজ নভোচারী স্কট এবং মার্ক কেলির পূর্বের স্বাস্থ্য প্রোফাইলের সন্ধান পাওয়া যায়। নাসার স্টাডিতে দশটি গবেষণা দল জড়িত ছিল। দলটি স্কট মহাকাশে একবছর অবস্থানের পরে, তার যে আণবিক এবং শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলো হয়েছিল তা পর্যবেক্ষণ করে। গবেষকরা স্কট-এর যমজ ভাই মার্কের সাথে তার পরিবর্তনের তুলনা করেছিলেন, যিনি এই সময়ে পৃথিবীতে ছিলেন।
৩০০ টিরও বেশি জৈবিক নমুনা থেকে, দলগুলো জিনের অভিব্যক্তি, মাইক্রোবায়োমস, বিভিন্ন ফাংশন এবং ভাস্কুলার সিস্টেমে পরিবর্তন সহ যমজ নভোচারীদের একের পর এক শারীরিক পার্থক্যের তালিকা তৈরি করেন।
টুইন স্টাডিতে, সুসান বেইলি একটি আকর্ষণীয় আবিষ্কার করেন এবং তা হলো স্কটের টেলোমেয়ার (টেলোমেয়ার হলো ক্রোমোজোমের শেষপ্রান্তের ক্যাপ) দৈর্ঘ্যে পরিবর্তিত হয়েছিল। এর দৈর্ঘ্য আমাদের ডায়েট থেকে শুরু করে আমাদের জীবনযাত্রা এমনকি আমাদের মানসিক সুস্থতা পর্যন্ত পার্থিব জীবন যাপনের সমস্ত দিক দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমাদের বয়সের বৃদ্ধির সাথে টেলোমেয়ারস দৈর্ঘ্যে ছোট হয়ে যায়, এবং টেলোমেয়ারস কত দ্রুত সংক্ষিপ্ত হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের পর্যবেক্ষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।
বিজ্ঞানীরা স্কটের টেলোমেয়ারসের অপ্রত্যাশিত সামগ্রিক দৈর্ঘ্য পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি যখন পৃথিবীতে ফিরে আসেন, তখন তার টেলোমেয়ারস দ্রুত সঙ্কুচিত হয়। যদিও স্পেসফ্লাইটের পূর্বে স্কটের টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য বেশি ছিল, কিন্তু স্পেসফ্লাইট শেষে তার টেলোমেয়ার তুলনামূলকভাবে খাটো হয়ে গিয়েছিল।
গবেষকরা মহাকাশে কয়েক মাস অতিবাহিত করেছেন এমন আরো কয়েক ডজন নভোচারীকেও পরীক্ষা করে টেলোমেয়ারের এই পরিবর্তন নিশ্চিত করেছেন। টুইন স্টাডির মতোই গবেষকরা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলো রেকর্ড করেছিলেন।
স্পেসফ্লাইটের কয়েকটি লক্ষণ কিছু সময়ের পরে স্থির হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করা হয়। যেমন- রক্তের পরিমাণ কমে যাওয়া, হার্ট এবং ফুসফুসের পরিবর্তন। তবে, এই তথ্য নিশ্চিত করে বলার জন্য যতদিন আইএসএসে (ISS- International Space Station) নভোচারীদের থাকা দরকার ছিল, ততদিন তারা ছিলেন না। তাই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত না, এই পরিবর্তনগুলো শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে যাবে কি না।
বেইলি বলেন, তারা কিছু প্রাথমিক গবেষণা করেছেন। তবে এখন মন্তব্য করাটা ‘খুব তারাতারি’ হয়ে যাবে।
বার্ধক্যজনিত ওষুধের পরীক্ষা করার জন্যও স্পেস বিজ্ঞানীদের কাছে একটি উপযুক্ত পরিবেশ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা এলি লিলির (Eli Lily) একটি গবেষণা দল পরীক্ষা করেছেন যে, কোনও অ্যান্টিবডি ড্রাগ ইন্টারনেশনাল স্পেস স্টেশনে ইঁদুরের মাংসপেশির ক্ষতি রোধ করতে পারে কিনা।
এলি লিলি গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে, স্পেস প্রকৃতপক্ষে ইঁদুরের পেশীকে দুর্বল করে তোলে, যা মহাকাশচারীদের পূর্ববর্তী পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে যায়। ইঁদুরের মধ্যে প্রবেশকৃত অ্যান্টিবডি ড্রাগ ইঁদুরের পেশী সংরক্ষণ করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে মিশনে থাকা মহাকাশচারীদের উপর মাইক্রোগ্র্যাভিটি এর ক্ষতিকারক প্রভাব এই ধরনের ড্রাগগুলো মোকাবেলা করতে পারে। পাশাপাশি পৃথিবীতেও প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এসব শারীরিক বাঁধার পরও, মহাকাশে যেতে ইচ্ছুক সাহসী মহাকাশচারীর অভাব নেই। মহাকাশ এর সাথে মানবজাতির মুগ্ধতা কখনোই শেষ হবে না এবং সম্ভবত মহাকাশচারীরা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি সত্ত্বেও তাদের কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেয়ে যেতেই থাকবে, হয়তোবা কোনো একদিন বার্ধক্য প্রতিরোধ করার ফর্মুলাও পেয়ে যাবে!
কায়েস মোঃ সাইফুল্লাহ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি