প্রাণীজগতের কোনো পুরুষ প্রাণী বাচ্চা প্রসব করতে পারে? – প্রশ্নটি অবাক হওয়ার মত হলেও উত্তর হলো ‘হ্যা’! “সী হর্স (Seahorse)” হলো প্রানীজগতের গর্ভধারণ এবং বাচ্চা প্রসব করতে পারা একমাত্র পুরুষ প্রাণী।
অজানাকে জানা আর অচেনাকে চেনার আকাঙ্ক্ষা মানুষের সৃষ্টির সূচনা থেকেই। সুন্দর এই পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্যও কম নয়। নানান গঠন, বর্ণ ও আচরণের প্রাণী সম্পর্কে জানতে গিয়ে মানুষকে হতে হয় বিমোহিত। প্রাণীজগতের অপার রহস্যকে জানার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রাণীবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে চলেছেন অবিরত। তেমনি একটি গবেষণার ফল সী হর্সের জীবন রহস্য।
সী হর্সের বৈজ্ঞানিক নামের গণ হল “হিপ্পোক্যাম্পাস (Genus: Hippocampus) যেটি একটি গ্রিক শব্দ। গ্রিক পুরাণ অনুসারে “হিপ্পোস (hippos)” মানে হলো ঘোড়া (horse), আর “ক্যাম্পোস (kampos)” মানে হলো সমুদ্রের রাজা। কারণ গ্রিকদের কাছে “পসেইডন (Poseidon)” হলো জলের দেবতা, যার সামনের অংশ ঘোড়ার মতো ও পেছনের অংশ মাছের মতো। সেই জলের দেবতার গঠনের সাথে মিল আছে বলেই এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নামের গণ হলো “হিপ্পোক্যাম্পাস (Genus: Hippocampus)” আর ঘোড়ার মতো গঠন বলে এর ইংরেজি নাম “সী হর্স (Seahorse)”। সী হর্স সমুদ্রের সবচেয়ে ঝলমলে অস্থিময় মাছ। এরা পৃথিবীর একমাত্র প্রাণীর দল যেখানে মহিলা নয়, পুরুষরা গর্ভাবস্থার মধ্য দিয়ে যায় এবং সন্তান জন্ম দেয়। নতুন এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পুরুষের ব্রুড থলি একসঙ্গে ১০০০ বাচ্চা ধারণ করতে পারে। সবচেয়ে অবাক তথ্য হলো, এর ব্রুডথলি মানব প্লাসেন্টার মতো কাজ করে। টোকিওর সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মেরি কাওয়াগুচি বলেন, “এই গবেষণায় প্রথমেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে যে পুরুষরা কীভাবে তাদের ছোট বাচ্চাকে লালন-পালন করে”। তিনি প্রায় ২ দশক ধরে সী হর্স নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করেছিলেন যে গর্ভবতী সামুদ্রিক ঘোড়াগুলো প্লাসেন্টার মতো কিছু তৈরি করে, যা এখন প্রমাণিত।
পুরুষ সী হর্সগুলো নৃত্যের মাধ্যমে পিতৃত্বের দিকে যাত্রা শুরু করে। তারা তাদের পছন্দের মহিলা সী হর্সের সাথে পানির নিচে ঘোরাফেরা করে, রঙ পরিবর্তন করে এবং লেজগুলোকে সংযুক্ত করে। পরবর্তীতে, তারা পুরুষের থলি খোলার সাথে নারীর ডিম্বাশয়কে সারিবদ্ধ করে যাতে মহিলা তার ডিম জমা করতে পারে। একবার কাজটি সম্পন্ন হলে পুরুষটি ডিম নিষ্পত্তি করার জন্য আলতো করে দোলায়। প্রজাতির উপর নির্ভর করে দশ দিন থেকে ৬ সপ্তাহ পরে পুরুষ শত শত ক্ষুদ্র শিশুকে জলের মধ্যে বের করে দিতে কয়েক ঘন্টা শ্রম এবং পাম্পিং করে থাকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় পুরুষদের একটি লক্ষ্য থাকে- ভ্রূণকে অক্সিজেন থেকে শুরু করে পুষ্টি, অ্যান্টিবডি পর্যন্ত যা কিছু প্রয়োজন তা প্রদান করা। বিজ্ঞানী হুইটিংটন বলেন সকল গর্ভবতী সী হর্সের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো তাদের ভ্রূণে অক্সিজেন পাওয়া এবং ভ্রূণ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড দূরে রাখা।
এই গবেষণায় আরও উঠে এসেছে গর্ভাবস্থায় সী হর্সগুলো কিভাবে শ্বাস নেয়, প্রয়োজনীয় রক্ত এবং অক্সিজেন পায়। গবেষণায় ৩৪ দিনের গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন পয়েন্টে বড় প্রজাতির সী হর্সের ব্রুড পাউচগুলো পরীক্ষা করা হয়েছিল। ভ্রূণের বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের ব্রুড থলি পাতলা হয়ে যায় এবং ভ্রূণের বিকাশের সময় স্তন্যপায়ী প্রানীর প্লাসেন্টার মতো অসংখ্য রক্তনালী অঙ্কুরিত হয়ে থাকে। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে, পুরুষের ব্রুড থলি তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। বিজ্ঞানী হুইটিংটন বলেন এই প্লাসেন্টা গর্ভবতী মানুষদের মতোই। মানুষের ক্ষেত্রে, প্লাসেন্টার পিতামাতার অংশটি জরায়ু, যেখানে সামুদ্রিক ঘোড়ায় পিতামাতার অংশ মূলত পেটের ত্বককে সংশোধন করে থাকে। কানাডা এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী সারাহ ফস্টার তার গবেষনায় বলেন সী হর্সগুলো গর্ভাবস্থায় বাচ্চার অক্সিজেন এবং পুষ্টি পুরুষের রক্ত থেকে গ্রহন করে যেমনটি মানব ভ্রূণের ক্ষেত্রে ঘটে। সী হর্স লম্বায় প্রায় ১.৫ সে. মি. থেকে ৩৫ সে. মি. পর্যন্ত হতে পারে। এখন পর্যন্ত ৫০টি প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে এরা প্রায় ১-৫ বছর বেঁচে থাকে।
তথ্যসূত্র : Science.org
মেহেদী হাসান মামুন/ নিজস্ব প্রতিবেদক