“জয়ী প্রাণ, চিরপ্রাণ, জয়ী রে আনন্দগান
আশার অরুণলোকে হোক অভ্যুদয় রে!”
মানুষের জীবনকে সহজ ও উন্নত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান নিত্যনতুন উদ্ভাবনে উত্তরোত্তর বিকশিত হচ্ছে। বিকাশের এই অগ্রযাত্রায় আমাদের বাংলাদেশের নারীরাও এক পা দুপা করে এগিয়ে চলছে, আনছে জয়। তাদের এ অবদান অত্যন্ত অর্থপূর্ণ একই সঙ্গে গৌরবের কেননা তাদের অবদানগুলো আজ বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে দিয়েছে পরিচিতি ও সম্মাননা। আজ “ইন্টারন্যাশনাল ডে অব উইমেন অ্যান্ড গার্লস ইন সাইন্স” উপলক্ষে বাংলাদেশী সেইসব গৌরবোজ্জ্বল নামগুলোকে সবার সামনে চিত্রায়ন করছি!
ডাঃ ফেরদৌসী কাদরি:
তিনি বাংলাদেশী নারী বিজ্ঞানী ও গবেষক-দের মাঝে তো বটেই, বিশ্বের একজন প্রতিষ্ঠিত জীববিজ্ঞানী। সম্প্রতি ‘কলকিট’ নামে কলেরা জীবানু দ্রুত নির্নয় পদ্ধতি উদ্ভাবন সহ বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন ধরনের সহজলভ্য ও কম খরচের কলেরা টিকা উদ্ভাবনে কাজ করছেন। তিনি ২৫ বছর যাবৎ কলেরা ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করেছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের সংক্রামক রোগ থেকে প্রতিরোধ, প্রাথমিক রোগ নির্নয় এবং টিকা দেওয়ার জন্য তাঁর অসাধারন কাজ দ্বারা তিনি বিভিন্ন পুরষ্কার অর্জন করেছেন।
ডাঃ কাদরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমেস্ট্রি এবং মলিকুলার বায়োলজি থেকে বিএসসি এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমেস্ট্রির উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমান তিনি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ অ্যান্ড রিসার্চ (আইসিডিডিআর) এর সিনিয়র বিজ্ঞানী এবং সংক্রামক রোগ বিভাগের ভ্যাক্সিনোলজি ইউনিটের প্রধান। তিনি বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মাইক্রোবায়োলজিস্টের একজন প্রতিষ্ঠাতা এবং উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য।
তার সাথে তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমেরিকা সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি তে আছেন। ২০২১ সালে এশিয়া সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনের প্রকাশিত এশিয়ার ১০০ বিজ্ঞানীদের তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তিনি একমাত্র বাংলাদেশি বিজ্ঞানী যিনি ইমিউনোলজি এবং সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষনা করেন। তার সাফল্য গুলোর বেশিরভাগ ভ্যাকসিন এবং গবেষনা নিয়ে। তিনি বাংলাদেশের কলেরা রোগের চিত্র পালটিয়ে দিয়েছেন তাঁর এই অবদান কখনোই ভুলার মত নয়।
সালমা সুলতানা:
বাংলাদেশী নারী বিজ্ঞানী এবং গবেষক মাঝে অন্যতম একজন হলেন দেশের প্রথম বেসরকারি প্রাণি চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘মডেল লাইভস্টোক এডভান্সড ফাউন্ডেশন’ এর প্রতিষ্ঠাতা সালমা সুলতানা। তার প্রতিষ্ঠান থেকে খামারী এবং কৃষকরা প্রশিক্ষন নিয়ে সহজেই স্বাবলম্বী হতে পারছেন। তাঁর এই কাজের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বেশকিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছে। কৃষকরা এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও আগ্রহী হয়ে উঠছে। তিনি একজন পশু চিকিৎসক, কৃষিবিদ এবং উদ্যোক্তা।
তিনি ২০১২ সালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (সিভাসু) থেকে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন এর উপর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি তামিল নাড়ু ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেন। আবার সেখান থেকে ফিরে সিভাসু থেকে ২০১৪ সালে ফার্মাকোলজির উপর ডিগ্রী অর্জন করেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য অর্জন গুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে ‘মাদার তেরেসা আ্যওয়ার্ড‘, জয়বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড। তিনি ‘নরম্যান ই বোরলগ‘ পুরস্কার ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও ফজলে হাসান আবেদের পর তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে তিনি অর্জন করেন। ২০২১ সালে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক এশিয়ান সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনের প্রকাশিত এশিয়ার ১০০ বিজ্ঞানীদের তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত হন।
ডা. সায়েবা আক্তার:
বাচ্চা জন্মের পর মায়েদের জরায়ুর রক্ত বন্ধ করতে বিশ্বের গাইনোকোলজিস্টরা এখন একজন বাংলাদেশি ডাক্তারের উদ্ভাবিত কৌশল ব্যবহার করছেন।
বিশ্বকে চমক লাগানো এই উদ্ভাবনী কৌশল আবিষ্কার করেন ডা. সায়েরা আক্তার। তার এই কৌশলটির নাম দেওয়া হয় সায়েবা মেথড।
২০০০ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (DMCH) থাকা অবস্থায়, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে অনেক নারীর মৃত্যু হতে দেখেন। তখন তিনি প্রথম বারের মত জরায়ুতে পানি ও স্যালাইন ভর্তি বেলুন ঢুকিয়ে ক্যাথেটার লাগানোর কথা ভাবেন। তার এই পদ্ধতিটা সফলভাবে কাজ করে এবং ১৫ মিনিটের মধ্যে জরায়ুর রক্ত বন্ধ করে দেয়। তার এই পদ্ধতিতে মাত্র ১০০ টাকারও কম খরচ হয়।
তার এই পদ্ধতিটি বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, এবং আফ্রিকার নানা দেশ সহ বিভিন্ন দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য নির্দেশিকাতে অন্তর্ভুক্ত করা সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অলোচিত এবং প্রশংসিত হয়েছে।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (বারডেম) ভাস্কুলার সার্জন ডা. সাকলাইন রাসেল বলেছেন যে, যারা দেশে এবং বিদেশে এফসিপিএস এবং এমএস ডিগ্রি অর্জন করা অনেক ডাক্তারও সায়েবা মেথড সম্পর্কে থিসিস করে থাকেন। তিনি আরও বলেন সায়েবা মেথড কার্যকর করার জন্য নার্সদের প্রশিক্ষিত করা উচিত।
তনিমা তাসনিম অনন্যা:
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য ব্ল্যাকহোল হচ্ছে একটি বিস্ময়কর বিষয়। তনিমা তাসনিম অনন্যা ও তার দলই প্রথম যারা মহাবিশ্ব জুড়ে থাকা ব্ল্যাকহোলগুলির এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে স্পষ্ট ছবি আঁকেন ও তারা কোথায়, কীভাবে বৃদ্ধি পায় এবং কীভাবে তারা তাদের পরিবেশকে প্রভাবিত করে এই সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। তনিমা তাসনিম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এটি করেছেন।
তনিমা তাসনিম চারটি এক্স-রে টেলিস্কোপ থেকে সমীক্ষা সংগ্রহ করেন এবং অনেক পরিমাণে ডাটাসেট ব্যবহার করে যা পূর্বে কখনও করা হয় নি। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এক্স-রে সমীক্ষা এবং ডাটাসেট ব্যবহার করে ব্ল্যাকহোলের সবচেয়ে স্পষ্ট ছবি আঁকতে সক্ষম হয়েছেন।
তনিমা তাসনিম বলেন, তার লক্ষ্য ছিল মহাজাগতিক ইতিহাস জুড়ে ব্ল্যাকহোল কীভাবে বৃদ্ধি পায় এবং পরিবর্তিত হয় তার একটি মডেল তৈরি করা। তারা একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মহাবিশ্বের ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়।
ফারহানা সুলতানা:
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ফারহানা সুলতানা (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহকারী বিজ্ঞানী) পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি প্যাড তৈরির মেশিন উদ্ভাবন করেছেন। এ উদ্ভাবনের জন্য চতুর্থ ‘অ্যানুয়াল পিচ ইনোভেশন প্রতিযোগিতায়’ গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
সুলতানাকে ৫ হাজার মার্কিন ডলার দিয়েছে এএসটিএমএইচ। একইসঙ্গে তিনি ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম ইনোভেশন পিচ প্রতিযোগিতায় বিচারক হবেন। আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তিনি আরও অধিক সংখ্যক প্যাড উৎপাদনের জন্য পরীক্ষা চালাবেন,
একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করবেন, নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করবেন এবং বর্জ্যব্যবস্থাপনার বিভিন্ন উপায় খুজঁবেন।
সেঁজুতি সাহা:
বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি ঘটাতে যে আরেকটি নাম সংযুক্ত হয়েছে তিনি হলেন ডক্টর সেঁজুতি সাহা। সেঁজুতি সাহা দরিদ্র দেশগুলিতে নবজাতক এবং শিশুদের প্রভাবিত করে এমন রহস্যময় অসুস্থতা নির্ণয়ের সহজ উপায় খুঁজে বের করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ২০১৭ সালে, যখন বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিসের প্রভাব ব্যাপকভাবে দেখা গেল তখন সেঁজুতি সাহা শিশুদের জেনেটিক উপাদান বিশ্লেষণ করে তার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হন। (মেনিনজাইটিসের কারণ উদ্ভাবনে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাবের কারণে, মশার দ্বারা ভাইরাস দ্রুত ছড়ায়)।
আরও পড়ুনঃ ডক্টর সেঁজুতি সাহা: একজন কৃতি বিজ্ঞানী
“কিন্তু এ রহস্যের গভীরে যাওয়ার জন্য এবং বিশ্লেষণের জন্য নমুনাগুলিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়েছিল৷ তিনি তখন থেকে বাংলাদেশে একটি কম খরচে ডায়াগনস্টিক যন্ত্র স্থাপন করেছেন যাতে দেশটিকে দ্রুত মেনিনজাইটিস এবং অন্যান্য মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে”।
তিনি গবেষণা থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করছেন তা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে বাংলাদেশে অসুস্থতা নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক সংস্থানের অভাব রয়েছে সেখানে CHRF সংগৃহীত তথ্যগুলি রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার সবচেয়ে কার্যকর৷ বিল গেটস CHRF-এর কাজের প্রশংসা করেছেন, পাশাপাশি সরকার কর্তৃক শৈশব টিকাদান এবং গণিতের প্রয়োগ স্বাস্থ্যসেবার জন্য জোরালো সমর্থন করেছেন।
এছাড়াও আমাদের দেশে প্রথমবারের মত করোনা-র জিন রহস্য উদ্ভাবনের পিছনের কারিগরও ছিলেন তিনি ও তার টিম।
হাসিবুন নাহের:
হাসিবুন নাহের একজন বাংলাদেশী নারী বিজ্ঞানী যিনি ফলিত গণিত গবেষক এবং শিক্ষাবিদ। ফেব্রুয়ারী ২০১৮-এ, তিনি OWSD-Elsevier ফাউন্ডেশন পুরস্কার লাভকারী উন্নয়নশীল দেশ থেকে পাঁচজন তরুণীর একজন। তার গবেষণা এবং গণিতের প্রয়োগ প্রাকৃতিক দুর্যোগ (সুনামিতে) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা দুর্যোগ মোকাবেলার পূর্বাভাসকে উন্নত করতে সাহায্য করেছে। তিনি বর্তমানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকার গণিতের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
আমরা আশা করছি, এভাবেই বাংলাদেশী নারীরা বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভা দ্বারা বৈশ্বিক ভাবে বাংলাদেশকে সবার সামনে তুলে ধরবে।
লিখেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক: মোঃ গালীব হাসান, রুবাইয়াত চৌধুরী, হৃদিতা ইফরাত, আরাফাত রহমান
তথ্যসূত্র: সায়েবা আক্তার, হাসিবুন নাহের, তনিমা তাসনিম অনন্যা, ফেরদৌসী কাদরী, সালমা সুলতানা, সেঁজুতি সাহা, ফারহানা সুলতানা
+1
+1
2
+1
+1
2
+1
1
+1
+1
1