প্রতিবছর বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুমে একবার হলেও দেখা দেয় বন্যা। তবুও প্রতিবছরের তুলনায় এবার অর্থাৎ, ২০২৪ সালে দেখা দিয়েছে স্মরণকালের সর্বোচ্চ ভয়াবহ বন্যার৷ ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ভয়াবহ বন্যায় বিভিন্ন জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের উজান অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় ফেনী, গোমতী এবং মহুরি নদীর স্বাভাবিক পানি ধারণক্ষমতা ব্যাহত হয় এবং আশেপাশের সকল অঞ্চলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ প্লাবনের। এই বন্যায় ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষের ফসলাদি, ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। সরকার, সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা মিলে বন্যা দুর্গত এলাকায় উদ্ধার অভিযান এবং ত্রান সামগ্রী দান কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবুও এই বন্যায় আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে ভাইরাস ও পানিবাহিত রোগ।
প্রতিবছর বাংলাদেশে বন্যার ফলে সৃষ্ট পানিবাহিত রোগের প্রকোপে প্রায় ৪০০০ এরও বেশি মানুষ ডায়রিয়া, চর্ম রোগ, এবং ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হয়। এই সময় বাড়তে থাকে মৃত্যুহার। এবারের ভয়াবহ বন্যায় যে এই পরিস্থিতি আরো খারাপভাবে দেখা দিতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বায়োকেমিস্ট্রি বা প্রাণরসায়নের ব্যাখা থেকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কীভাবে সৃষ্টি হয় তা জেনে সচেতনতা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে এই ভয়াবহতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
বন্যার কারণে স্বাস্থ্য পরিসেবার অভাব, আশ্রয়কেন্দ্রে অসংখ্য নিরুপায় মানুষের একত্রে অবস্থান, বর্জ্য নিষ্কাশন ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ায় তখন জীবাণুগুলো খুব সহজেই মানুষদের আক্রমণ করতে পারে এবং এইসব জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট রোগ বেশিরভাগই গ্র্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এবং শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ।
বন্যার সময় ভাইরাল রোগ যেমন, হেপাটাইটিস এ এবং ই, ইয়েলো ফিভার, ডেঙ্গু জ্বর অন্যতম।
বন্যায় শ্বসনতন্ত্র কীভাবে সহজেই প্যাথোজেন দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়?
আশ্রয়কেন্দ্রে ভিড়ের কারণে Respiratory tract infection (RTI) হলো সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট হওয়া সংক্রমিত রোগগুলোর একটি। দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়, এসময় তাদের সাথে অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সহজেই চলে আসে। পরবর্তীতে যখন একস্থানে অসংখ্য মানুষ কাছাকাছি অবস্থান নেয়, তখন হাঁচি, কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে আরো সহজে একজন থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ে।
উদ্বেগ, নিম্নমানের পুষ্টিব্যবস্থা, ঠান্ডা আবহাওয়ায় থাকার দরুণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম কোষ টি-সেল এবং ম্যাক্রোফেজ এর কার্যকারিতা কমে আসে, যা দেহকে সংক্রমণের দিকে আরো ঠেলে দেয়।
আশ্রয়কেন্দ্রের দুর্বল বায়ুচলাচল অবস্থা বা ভেন্টিলেশন নিম্নমানের হওয়ায় এবং জনাকীর্ণ অবস্থায়, ফুসফুসের টিস্যুতে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের সৃষ্টি হয়। ফুসফুসে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস মূলত সৃষ্টি হয় যখন দেহে ক্ষতিকারক পদার্থ যেমন ফ্রি রেডিকেলের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট গুলো আর এই ক্ষতিকারক পদার্থগুলোকে প্রশমিত করতে পারে না। ফ্রি রেডিকেল দেহের কোষ থেকে শুরু করে ডিএনএ, প্রোটিন, লিপিড, এনজাইমকেও ধ্বংস করতে সক্ষম।
ফ্রি রেডিকেল যাতে অক্সিজেন পরমাণু বিদ্যমান অর্থাৎ, সৃষ্ট Reactive oxygen species (ROS) এর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ইমিউনিটি সিস্টেম) সক্রিয় হয়ে উঠে, শেষমেশ যা ফুসফুসের এপিথেলিয়াল কোষকে নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু ফলস্বরূপ, প্যাথোজেন বা জীবাণুকে প্রতিহত করার প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর ধ্বংস হয়।
অ্যালার্জেন পদার্থ, ধূলাবালি, প্যাথোজেনের সংস্পর্শে Pro inflammatory cytokines (যা মূলত দেহের ইমিউন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর সৃষ্টির ফলে ব্যথা অনুভব হয়) এর উৎপাদন বাড়ায়, যার ফলে শ্বসনতন্ত্রের প্রদাহের সৃষ্টি হয়।
এই প্রদাহের ফলে মিউকোসিলিয়ারির স্তর সরে যায়, যা মূলত স্বাভাবিক অবস্থায় শ্বসননালিতে প্রবেশকৃত প্যাথোজেনকে অপসারণের কাজ করে। কিন্তু এই স্তর সরে যাওয়ায় প্যাথোজেন সহজেই শ্বসননালি দিয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে।
এছাড়াও দুর্যোগ পরিস্থিতিতে বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের মাঝে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ, সি এবং ডি এর সরবারহ করা সম্ভব হয় না। এই ভিটামিনগুলো দেহের ইমিউন সিস্টেমকে মজবুত করতে সহায়তা করে থাকে, কিন্তু এর অভাব থাকায় সহজেই এসব অঞ্চলের মানুষের মাঝে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পরে, রিপোর্ট করা রোগের মাঝে ১৭.৪% ছিল RTI (Respiratory tract infection) এবং ১৩% মৃত্যুর জন্যেও এই একই কারণ দায়ী ছিল। ২০২২ সালের জুনে, বাংলাদেশের ১৭ জেলায় ৪৫ লাখ মানুষ RTI দ্বারা আক্রান্ত হয়।
অথচ এই কারণগুলো জেনে সঠিক পদক্ষেপের ব্যবস্থা করা গেলে এই সংখ্যা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। ত্রাণের জন্য নেয়া খাদ্যে যদি ভিটামিন এ, সি, ডি সমৃদ্ধ খাদ্যের (গাজর, পেঁপে, মিষ্টি আলু, কলা, ডিম) কিছু পরিমাণ যোগান দেয়াও সম্ভব হয়, তাহলে বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষদের দেহে এই রোগ থেকে বাঁচার জন্য ইমিউন সিস্টেম যথেষ্ট ভালো থাকবে।
তবুও নানা কারণে এই সবজি জাতীয় খাদ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই শুকনো খাবার যোগান দেয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। আর তাই যদি ভিটামিন যুক্ত খাদ্যের যথেষ্ট যোগান দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট এর সাপ্লিমেন্ট এই ঘাটতি পূরণের আরেকটি উপায় হতে পারে।
মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট একইসাথে সকল ভিটামিন এবং মিনারেলস এর ঘাটতি পূরণ করে ইমিউন সিস্টেমকে ভালো রাখতে সহায়তা করে। তবে অবশ্যই এই সাপ্লিমেন্ট প্রদানের আগে চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে যে কোন সাপ্লিমেন্ট বেশি ভালো এবং ডোজ সম্পর্কে জেনে নেয়া জরুরি৷ নিজে নিজে গ্রহণ করলে হীতে বিপরীত হতে পারে৷
বন্যায় Gastrointestinal রোগের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় কেন?
বন্যার পানি মানুষ, পশুপাখির মলমূত্রের সাথে মিশে যায়, সাথে বর্জ্য এবং ড্রেনের পানি মিশে একাকার হয়ে যায়। এইসময় Escherichia coli, Salmonella, Vibrio cholera এর মতো কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া যে পানিতে মিশে থাকে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শ্বসনতন্ত্রের মতো একইভাবে পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্রের নালিতে দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। পাকস্থলী সংলগ্ন লিম্ফয়েড টিস্যু (প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কাজ করে) সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং দূষিত খাবারের ফলে দেহে ডিসবায়োসিস এর সৃষ্টি হয়। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে দেহে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে অপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, ফলাফল ইনফেকশন।
খাদ্যের সাথে গ্রহণ করা প্যাথোজেন বা জীবাণু পাকস্থলীতে Reactive oxygen species (ROS) এর সৃষ্টি করে, যা একইভাবে পাকস্থলী এবং অন্ত্রের কোষের ক্ষতিসাধন ও প্রদাহের সৃষ্টি করে থাকে। যার ফলে জীবাণু আরো সহজেই দেহের অন্যান্য অঙ্গগুলোতে সহজেই প্রবেশ ও ক্ষতিসাধন করতে পারে।
পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের নালীর ক্ষতিসাধন, দেহে ইলেক্ট্রোলাইটের অভাব এবং ডিহাইড্রেশনের কারণে মারাত্মক ডায়রিয়া দেখা দেয়। বাংলাদেশে বন্যা কবলিত অঞ্চলগুলোতে ডায়রিয়া মহামারির প্রধান কারণ হলো রোটাভাইরাসের।
উপরোল্লিখিত কারণে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ায় রোটাভাইরাস সহজেই দেহে প্রবেশ করে। ভাইরাস প্রবেশের দুইদিনের মাঝেই জ্বর, বমি, তিন থেকে সাতদিন টানা পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়ার দেখা দেয়। এই সংক্রমণের কারণে পেটে প্রচন্ড ব্যথাও হয়।
হেপাটাইটিস এ এবং ই এর ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মলের মাধ্যমে এই ভাইরাস দেহ থেকে বের হয়ে আসে এবং বন্যার কারণে মলমূত্রের পানি, খাদ্যের পানির সাথে মিশ্রিত হয়। এই দূষিত পানি অন্য ব্যক্তি পান করার মাধ্যমে হেপাটাইটিস এ এবং ই তে আক্রান্ত হয়। একইভাবে, Vibrio Cholera এর কারণে ডায়রিয়া এবং ডিহাইড্রেশন, Salmonella typhi এর কারণে টাইফয়েড, পরজীবী দ্বারা সংক্রমণের কারণে ক্রনিক ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিতে পারে।
এই সময় রোগের সংক্রমণ সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন, Oral Rehydration Saline (ORS) এর মজুদ রাখা, এটি ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ এবং পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে৷ Water purifying tablet দূষিত পানি কে বিশুদ্ধ করে টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়ের মতো রোগ থেকে রক্ষা করে। এই ট্যাবলেট দ্রুত কাজ করে এবং বহন করাও সহজ।
Water purifying tablet মূলত ক্লোরিন বা আয়োডিনের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা তৈরি যা পানিতে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং কিছুক্ষেত্রে পরজীবী জীবাণুগুলোকেও ধ্বংস করতে সক্ষম। ট্যাবলেটের ধরণ ও পানির অবস্থা ভেদে এটি ৩০ মিনিট থেকে ৪ ঘন্টার মাঝে সম্পূর্ণ পানিকে বিশুদ্ধ করতে সক্ষম।
একইসাথে ডায়রিয়া এবং জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সরবারহের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও দূষিত পানিতে থাকা জীবাণুর কারণে হাতে, পায়ে বা শরীরের অন্যান্য যেকোন স্থানে অতিরিক্ত চুলকানির সৃষ্টি হতে পারে, এই অবস্থার জন্য এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ দেয়া যেতে পারে।
যেমন, Cetirizine, loratadine, diphenhydramine জাতীয় ওরাল ওষুধ (খাওয়ার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়) শরীরে অ্যালার্জিক রিয়েকশনকে প্রশমিত করে। এছাড়া diphenhydramine জাতীয় ক্রিম বা লোশন সরাসরি চুলকানির স্থানে প্রয়োগে আরাম পাওয়া যায়।
মশাবাহিত রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা
বন্যার পর, পানি জমে থাকা বিভিন্ন জায়গা মশার প্রজননস্থল হিসেবে কাজ করতে পারে৷ বিশেষ করে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়তে পারে৷ বন্যা পরিস্থিতিতে লার্ভানাশক পদক্ষেপ নেয়া অনেকাংশেই অসম্ভব। কারণ মোটামুটি সব জায়গাতেই পানির পরিমাণ বেশি থাকে।
এমতাবস্থায় শরীরের খালি জায়গাতে পোকামাকড় বা মশা প্রতিরোধক DEET, picaridin জাতীয় লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে মশাবাহিত রোগ দ্বারা সংক্রমণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব।
উপরোল্লিখিত পন্থাগুলো অবলম্বনের মাধ্যমে বন্যা পরবর্তী রোগের যে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় তা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে এটিকে বাস্তবায়ন করতে জনসাধারণের সাহায্য, সচেতনতা এবং ত্রাণ সামগ্রীর সাথে এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যাতে বন্যার কবলে পড়া প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে এবং এর যথাযথ ব্যবহার হয় সেদিকে অবশ্যই সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
দিদারুল ইসলাম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন, হার্ভাড হেলথ পাবলিশিং, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন