সম্প্রতি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় একটি মাইক্রোবাসের ১১ জন আরোহী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। এর মধ্যেই নেটিজেনদেন মনে দানা বাধতে শুরু করেছে একটি প্রশ্ন৷ প্রশ্নটি হচ্ছে কেন হঠাৎ রেল লাইনের ওপর মাঝেমধ্যেই গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়?
আর এই বিষয়টি নিয়েই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশাল বড় একটি গুজব। আজকের এই পোস্টে গুজব খন্ডনের পাশাপাশি কেন গাড়ির ইঞ্জিন আসলেই বন্ধ হয়ে যায় সে বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পাবেন বলেই আশা করি। প্রথমে আসা যাক গুজব প্রসঙ্গে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের এক শিক্ষকের ফেসবুক পোস্ট অনুযায়ীঃ
“যখন ট্রেন লেভেল ক্রসিং এর প্রায় কাছাকাছি চলে আসে অর্থাৎ সীমার মধ্যে এসে যায়, তখন লাইনের মধ্যে চাকার ঘর্ষণের ফলে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তি-র কারণে পুরো রেল লাইন আবিষ্ট হয়।যার ফলে সে সময়ে লাইনে অন্য কোন গাড়ি উঠলে দূর্বল ইন্জিন বিশিষ্ট গাড়ি সাথে সাথে তার ইন্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে কম সময়ে গাড়িটি রেল লাইন থেকে সরে যেতে পারে না।অথচ যখন রেল গাড়ি নির্দিষ্ট রেঞ্জের বাহিরে থাকে তখন লেভেল ক্রসিং পার হওয়াতে কোন সমস্যাই নেই।”
এবার খন্ডনের ব্যাপারে আসি- প্রথমত ট্রেনের চাকা এবং রেল লাইনের ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন হবে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিক বা স্থির তড়িৎ। স্থির তড়িৎ এর ফলে কেবল ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি হয়। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার যুক্ত ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হওয়ার জন্য দরকার চল তড়িৎ। অবশ্য ইলেকট্রিক ফিল্ডের কারণে অল্প হলেও ম্যাগনেটিক বা চুম্বক শক্তির সৃষ্টি হবে৷ তবে এই ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফোর্স বা বল এতটাই দুর্বল যে এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যজনিত কিংবা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত কোনো ঘটনা ঘটবে না।
আসলেই গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করতে হলে অত্যন্ত শক্তিশালী ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পালসের প্রয়োজন পরবে। ২০১৩ সালের দিকে ব্রিটিশ একটি কোম্পানি এমন একটি যন্ত্র তৈরি করে যা ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পালসের মাধ্যমে গাড়ির ইঞ্জিন থামিয়ে দিতে পারে৷১ তবে এর জন্য যন্ত্রটিকে গাড়ির ৫০ মিটার রেঞ্জের মধ্যে থাকতে হবে। তাছাড়া যন্ত্রটি শুধুমাত্র মিলিটারি কিংবা পুলিশদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বানানো। এছাড়া ন্যাটোও একই ধরণের একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে৷ ট্রেনের ঘর্ষণ বলের কারণেই গাড়ি থেমে যেতে পারে আর এমন সহজ প্রযুক্তি কেবল মিলিটারিদের কাছেই আছে, এমনটা ভাবাটা আসলেই বোকামি।
পাশাপাশি একদম অন্তিম মহুর্তে রেল লাইন পার হয়ে গেছে এমন অসংখ্য ভিডিও আপনি ইউটিউবে খুজে পাবেন৷ দুর্বল হোক কিংবা সবল কোনোভাবেই ট্রেনের কারণে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হবে না৷
এর পাশাপাশি একই পোস্টের মাধ্যমে আরেকটি গুজব ছড়ানো হয়েছে যেটা অনেকটা এমন, “একবার ভাবুন তো দুটো রেল লাইনের মধ্যে বিস্তারটা কতো! আড়াই বা তিন হাতের বেশি নয়। এ তিন হাত অনেক পুরুষ লাফিয়ে পার হতে পারে।কিন্তু ট্রেন খুবই কাছাকাছি চলে এলে, তখন লাফিয়ে পার হবার চেষ্টা করা মানেই মৃত্যু অবশ্যই। তখন ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে মানুষ লাফানোর শক্তি হারিয়ে ফেলবে বলেই মৃত্যু নিশ্চিত।
এ চুম্বকীয় শক্তির কারণে মানুষকে টেনে রাখবে বলে সমস্ত শরীর অধিক ভার(ওজন) হয়ে যাবে।” এই ব্যাখ্যাটিও যে ভুল সেটা বুঝতে হয়তো আপনাদের আর বাকি নেই. প্রথমতো চুম্বক ক্ষেত্র দ্বারা কোনো বস্তুকে আকর্ষণ করতে হলে সেই বস্তুকে অবশ্যই ফেরোম্যাগনেটিক কিংবা প্যারাম্যাগনেটিক হতে হবে৷
অপরদিকে মানুষ হচ্ছে দুর্বল ডায়াম্যাগনেটিক।২ আমাদের শরীরে আয়রন যা কিনা ফেরোম্যাগনেটিক এমন উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। তবে সাধারণত এটি হিমোগ্লোবিন হিসেবে আমাদের রক্তে অবস্থা করে। এই হিমোগ্লোবিন আবার ডায়াম্যাগনেটিক। এছাড়া আয়রনের পরিমাণও নগন্য৷ আর আমাদের শরীরের ৮০% ই পানি দ্বারা তৈরি৷
ফলে ডায়াম্যাগনেটিল হওয়ার কারণ আকর্ষণ করার বদলে মানুষ উল্টো চুম্বক ক্ষেত্র দ্বারা বিকর্ষিত হবে৷ তাই যদি ট্রেনের কারণে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফোর্স থেকেও থাকে তাহলে মানুষের ভর বা ওজন বাড়ার কোনো সুযোগ নেই৷ তাই লাফ দিয়ে পাড় হতেও কোনো সমস্যা নেই। এই তো গেল গুজব খন্ডন।
এবার আসি কেন মাঝেমধ্যে রেল লাইনে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় এই ব্যাপারে। ১. সাধারণত রেল লাইন রাস্তার তুলনায় সামান্য উঁচু করে বানানো হয়, ফলে রেল লাইন পাড় হওয়ার সময় গাড়ির চালকেরা গাড়ির গতি কমিয়ে আনেন। ফলে যখন দুর্বল ইঞ্জিনের কোনো গাড়ি রেল লাইন পাড় হওয়ার চেষ্টা করে তখন গাড়ির ইঞ্জিনের ওপর চাপ বেশি পড়ার ইঞ্জিন স্টল করে ২. আবার মাঝেমধ্যে রেল লাইন পাড় হওয়ার সময় কিছু ড্রাইভার লোয়ার গিয়ারে শিফট করতে ভুলে যান। ফলে ট্রেন কাছে চলে আসায় পেনিক অবস্থায় মাথা কাজ না করায় ঘটে যায় দুর্ঘটনা।
মূলত লোয়ার গিয়ারে গাড়ির স্টল সবচেয়ে কম হয়৷ ফলে দুর্ঘটনা ঘটারও সম্ভবনা থাকে কম৷ এগুলো মূলত ম্যানুয়াল গাড়ির ক্ষেত্রে ঘটা ঘটনা৷ অটোমেটিক গাড়িতে ইঞ্জিন খুব কমই স্টল করে৷ এছাড়া বর্তমানে নতুন যে গাড়িগুলো বের হচ্ছে সেগুলাতেও ইঞ্জিনের স্টল অনেকাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে৷ বিপদ সম্পর্কে অবশ্যই মানুষকে সচেতন করা উচিত৷ কিন্তু সেটা গুজব ছড়িয়ে না করাটাই উত্তম৷ এমনিতেও রেল ক্রসিং এর ব্যাপারের আমাদের সাবধান হওয়া উচিত৷ অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে ৫-১০ মিনিট সময়ের চেয়ে আমাদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি৷
অন্বয় দেবনাথ/নিজস্ব প্রতিবেদক
সোর্সঃ
১। https://www.bbc.com/news/technology-25197786
২। https://www.newscientist.com/lastword/mg25333681-400-do-magnets-have-any-effects-on-human-cells-part-2/