বিজ্ঞানের বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা আরো নিখুঁত ভাবে করার জন্য গবেষকরা নিয়মিতই কাজ করে যাচ্ছে। রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, মহাকাশ কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞান সহ প্রতিটি শাখায় গবেষণা ও উদ্ভাবন কে আরো পরিষ্কার ও সহজ ভাবে করার আসছে নতুন সব প্রযুক্তি। পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আলো নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা। আর ফোটন হল আলোর মৌলিক একক বা কণা। এর কোনো ভর বা আধান নেই।
মাইক্রোওয়েভ, ইনফ্রারেড লাইট এবং এক্স-রে ফোটন দিয়েই তৈরি। মহাবিশ্বের সবচেয়ে বেশি গতিশীল কণাই হলো ফোটন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বতেও ফোটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝার জন্য ফোটন কণার পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ফোটন কণার ছবি তোলার প্রযুক্তি হল সুপার কন্ডাক্টটিং ন্যানোওয়্যার সিংগেল-ফোটন ডিটেক্টর।
সুপার কন্ডাক্টটিং ন্যানোওয়্যার সিংগেল-ফোটন ডিটেক্টর এমন এক প্রযুক্তি যার সাহায্যে একক ফটন কণা চিহ্নিত করা সম্ভব যাতে অতিপরিবাহী বা সুপার কন্ডাকটর ন্যানোওয়্যার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত অতি পরিবাহী বা সুপারকন্ডাক্টর পদার্থের তাপমাত্রা অনেক কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট মানে নিয়ে গেলে তা সম্পূর্ণ রোধহীন একটি পরিবাহীর মত আচরণ করে। এ ধরনের পদার্থ কে বলা হয় সুপার কন্ডাক্টর।
Superconducting Nanowire এর তাপমাত্রা যখন অত্যাধিক কমিয়ে ফেলা হয় তখন রোদহীনভাবে ইলেকট্রন চলাচল করতে পারে। করিয়ে ফেলা অবস্থায় যখন এই ন্যানোওয়্যার এ ফোটন আঘাত করে তখন অতি সামান্য সময়ের জন্য ন্যানোওয়্যার এর রোধ বেড়ে যায়। সামান্য সময়ের জন্য এ রোদের বৃদ্ধি একটি বৈদ্যুতিক পালস সৃষ্টি করে যা এমপ্লিফায়ারে ধরা পরে। যা একটি ফোটন কণা অবস্থান নির্দেশ করে। এভাবেই Superconducting Nanowire Single-Photon Detector বা SNSPD কাজ করে। প্রায় দুই দশক পূর্বে মস্কো ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই পদ্ধতি উদ্ভাবনে সক্ষম হয়ে ছিলেন।
এই সুপার কন্ডাক্টিং ক্যামেরা ব্যবহার করে খুবই দুর্বল আলোক সংকেতও ক্যাপচার করা সম্ভব। হোক সে মহাকাশের দূরবর্তী কোনো বস্তু থেকে আলোক সংকেত কিংবা মানব মস্তিষ্কের কোন বিশেষ অংশ। এই সুপার কনডিক্টিং ক্যামেরার শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করতে পারলে জ্ঞানীদের পক্ষে গবেষণা করা আরো সহজ এবং নির্ভুল হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড ট্যাকনলজি, ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো এর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ এবং এর ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি একত্রে এই SNSPD প্রযুক্তি কে আরো উন্নত করে গড়ে তুলেছে। ফলে ফোটনের ছবি পূর্বের তুলনায় আরো পরিষ্কার ভাবে দেখা যাবে।
নতুন এই প্রযুক্তিতে পিক্সেল অ্যারেটি (অ্যারে ক্যামেরা হল একাধিক ক্যামেরার একটি সিস্টেম যা একই সাথে ছবি বা ভিডিও ক্যাপচার করার জন্য সিঙ্ক্রোনাইজ করা হয়) আগের বৃহত্তম ফোটন ক্যামেরার থেকে ৪০০ গুণ বড়। SNSPD একটি পাতলা (প্রায় ৫ ন্যানোমিটার) এবং সরু (১০০ন্যানো মিটার) ফর সুপার কন্ডাক্টিং ন্যানোওয়্যার দিয়ে তৈরি। এটিকে একটি নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়া হয় যাতে ফোটন এর আঘাত ভালোভাবে হয়। এরপর সেই ন্যানোওয়্যারটি কে যেই তাপমাত্রায় নিলে সুপার কন্ডাক্টর এর মত আচরণ করবে সে তাপমাত্রায় নেয়া হয়।
সাধারণত এই তাপমাত্রা হয় অনেক কম। পাশাপাশি এই ন্যানোওয়্যারটি কে একটি DC কারেন্টের বায়াস বা ঝোঁক দেয়া হয়। এই বায়াস বা ঝোঁক ন্যানোওয়্যারটির ক্রিটিকাল কারেন্ট আর খুবই কাছাকাছি হয়। একটি সুপার কন্ডাক্টর সর্বোচ্চ যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক প্রবাহ ঘনত্ব পরিবহন করতে সক্ষম তাকেই মূলত ক্রিটিক্যাল কারেন্ট বলা হয়।
ন্যানোওয়্যারতির এই অবস্থায় যখন একটি ফোটন কণা আঘাত করে তখন ইলেকট্রনের কুপার পেয়ারকে (বিপরীত স্পিন সম্পন্ন এবং একই গতি সম্পন্ন বিপরীতমুখীদুটি ইলেকট্রনের আছে একটি হালকা বন্ধন কাজ করে যাকে কুপার পেয়ার বলা হয়) ভেঙে দেয় এবং হঠাৎ করে তড়িৎপ্রাবাহ হ্রাস পায়। এমপ্লিফায়ারে এই রোধ ধরা পড়ে জার্মান প্রায় ৫০ ওহম ইনপুট ইম্পিডেন্সের চেয়ে বড়। মূলত এভাবেই একটি সিঙ্গেল ফোটন কণাকে চিহ্নিত করে তার চিত্র তুলে ধরা সম্ভব।
SNSPD টেকনোলজির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা প্রতিটি পিকচার থেকে আলাদাভাবে ডেটা ক্যাপচার করার পরিবর্তে সম্পূর্ণ শাড়ি বা পিক্সেলের কলাম থেকে ডাটা কালেকশন করার সুযোগ পায়। এর জন্য গবেষণা দলটি সুপার কন্ডাক্টিং ন্যানোওয়্যার গুলোকে সমান্তরালে রেখে তাতে বিদ্যুৎ পরিবহন করানো হয়। প্রতি পিক্সেলে যখন কি করে ফোটন কণা আঘাত করে তখন সেই জায়গাটি উত্তপ্ত হয়ে যায় এবং ছোট হটস্পট তৈরি করে। পরবর্তীতে দুটি হটস্পট এর মাঝখানে ভোল্টেজ এর পালস তৈরি হয় রিডারে ধরা পরে। এক সেকেন্ডের ৫০ ট্রিলিয়ন ভাগের একভাগ পরিমান সময়ের জন্যে আসা সংকেত কে এই প্রযুক্তিতে ধরা পড়ে। এভাবে প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ফোটন কণার তথ্য নেয়া সম্ভব।
NIST এর গবেষক বাখরম ওরিপভ এর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছেন। একই সংস্থার গবেষক অ্যাডাম ম্যাককগান এর মতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বড় ক্যামেরার জন্য সহজে কয়েক মিলিয়ন পিক্সেল ফোটন কণা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যেই এ পর্যন্ত ব্যবহারের চার লক্ষ্য মেগাপিক্সেলে ফোটন কণা দেখা সম্ভব হচ্ছে।
গবেষণা দলটির উদ্দেশ্য হলো আগামী বছর প্রোটোটাইপ ক্যামেরার ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করা। তার সাহায্যে সৌরজগতের ছায়াপথ বা গ্রহের ছবি, প্রথম ভিত্তিক কোয়ান্টাম কম্পিউটারের আলোক পরিমাণ নির্ধারণ কিংবা মানব টিস্যু পর্যবেক্ষণ এর মতো কাজগুলো আরো নিখুঁতভাবে করতে পারবে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের জগতে কোয়ান্টাম পর্যায়ে উন্নতির ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্ভাবন এবং গবেষণাগুলো কাজে লাগবে বলে আশা করা যায়।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ফিজিক্স.অর্গ, ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং