নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশে বন্যা অনেকটা স্বাভাবিক বিষয়। প্রতি বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা দেখা যায়। এছাড়া পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা পানি, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটিয়ে বড় ধরনের বন্যার সৃষ্টি করে। প্রতিবছর গড়ে দেশের প্রায় ২১ শতাংশ বা ৩১ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়।
তবে ২০২৪ সালে, বাংলাদেশ শিকার হয়েছে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির। এই আগস্ট মাস পর্যন্ত বন্যার ভয়াবহতার শিকার হয়েছেন ১৩০ লক্ষ মানুষ, পানিতে ডুবে গেছে দেশের প্রায় ৩০% অঞ্চল, এর পেছনের মূল কারণ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ রেমাল এবং অতিরিক্ত পানি প্রবেশ। এরই মাঝে দেখা দিয়েছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।
সপ্তাহব্যাপী প্রবল বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে মুহুরি, কাহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বড় অংশ ভেঙ্গে যাওয়ায় ফেনী জেলার প্রায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত। ফেনী জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যায় আক্রান্ত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে, ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৪০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ ৪৫টির বেশি গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রামে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২ আগস্ট বৃষ্টি এবং উজানের অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে মুহুরি, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি অংশে ভাঙনের ফলে লোকালয় প্লাবিত হয়েছিল। গত ২ জুলাই থেকে এই নিয়ে তৃতীয়বারের মত বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ফেনী।
ফেনীর বাসিন্দা সোলাইমান হাজারি জানান, গত মাসের শুরুতে মুহুরি, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর ১৫ স্থানে ভাঙন দেখা যায়। সেসব স্থানে মেরামতের পর চলতি মাসের শুরুতে বাঁধের আরও ১২ স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। বাঁধ ভাঙনে প্লাবিত হয় শতাধিক গ্রাম।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, মুহুরি নদীতে পানি বিপদসীমার প্রায় ৭০ সে. মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া মঙ্গলবার ফেনী জেলায় ১৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সরেজমিনে দেখা যাচ্ছে, গোমতি, কহুয়া নদীতেও পানি বিপদসীমার অনেক উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এজন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী নদীর উপর অবস্থিত ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুইচ গেইট খুলে দেয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বর্ষণের ফলে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয় ও পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ডুম্বুর জলাধারে পানি ধারণক্ষমতার চেয়ে বেড়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩১ বছর পর ডুম্বুর বাঁধের সুইচ গেট খুলে দিয়ে পানি উপচে পড়া মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে ১৯৯৩ সালে সর্বশেষ এই গেইট খুলে দেয়া হয়েছিল। তবে এই গেইট খুলে দেওয়ার ফলে পরিস্থিতি আরোও জটিল হয়েছে বলে মনে করেন কর্তৃপক্ষ। কারণ এতে নদীতে হঠাৎ করে অনেক বেশি পরিমাণ পানি চলে এসেছে এবং নদীর ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতি ভারত পেরিয়ে বাংলাদেশের নদীতেও প্রভাব ফেলেছে। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ ত্রিপুরার মতো উজানের অঞ্চলে অত্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাতের খবর দিয়েছে যেখানে মঙ্গলবার রাত ৮:৩০ টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৩৮০ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মেঘালয়ে ৩৫০ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বন্যার পানিতে তলিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ, ফসলের মাঠ ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। কিছু কিছু এলাকায় মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালেও ছুঁয়েছে বন্যার পানি। এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয় খুঁজছেন স্থানীয়রা। ফেনীর বাসিন্দা সোলাইমান হাজারি জানান, অবকাঠামো, ধান, ফসল ও মৎস্যে ক্ষতি ৩০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ১৫ দিনের মাথায় আবার দেখা দিয়েছে বন্যা।
কালীকৃষ্ণনগরের মো. শাহীন বলেন, “কয়েক দিনে তিনবার আমাদের বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। আমাদের বাড়িঘর সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ায় এলাকার সবাই কষ্ট পাচ্ছে।”
বীরচন্দ্রনগরের বাসিন্দা আতাউল উল্লেখ করেছেন, “আমাদের এলাকায় সাধারণত বন্যা হয় না, কিন্তু এবারের প্রবল বৃষ্টিতে আমাদের বাড়ি তলিয়ে গেছে।”
ফুলগাজী উপজেলার নীলাক্ষীর কৃষক আলী আজম তার ফসলের ক্ষতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের ধান ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে। আমরা নতুন বীজতলা রোপণ করেছি শুধ, এটি আবার তলিয়ে গেছে। গত দুদিনের ভারী বর্ষণে সবকিছু বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জমি আবার পানির নিচে।”
বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে মাঠে নেমেছে স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ফেনী জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, ত্রাণ সহায়তা ও উদ্ধার অভিযানে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা আজ বুধবার সকালে কুমিল্লা থেকে স্পিডবোট নিয়ে রওনা হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার।
স্থানীয়দের কাছ থেকে পরশুরামে একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। কয়েকটি ডিঙি নৌকায় পানিবন্দিদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। উদ্ধার কাজে এগিয়ে এসেছে ফায়ার সার্ভিস।
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, “উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নদীর ১২টি ভাঙন অংশ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। নদীর পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবারও ৫০ টন চাল মজুত রয়েছে।”
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভুঁইয়া বলেন, “বন্যার পানিতে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী রয়েছেন। এখনও প্রবল স্রোতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। উপজেলায় ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবারও ১৮ টন চাল মজুত রয়েছে।”
বর্তমানে ধীরে ধীরে বন্যায় ফেনী জেলার অবস্থা খারাপ হচ্ছে। একইসাথে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আশেপাশের জেলাগুলোতেও। ভয়াবহ এই বন্যা পরিস্থিতির ক্ষতি কমিয়ে আনতে বর্ন্যাত পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে সকল জনসাধারণকে।
মোহাম্মদ রিফাতুল ইসলাম মারুফ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: অবসার্ভারবিডি, টিবিএস নিউজ, ঢাকা ট্রিবিউন