শেষ হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রতিবারের মতো নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়েছে। চলে যাওয়া পৌষের শীতে এই নির্বাচনের উত্তাপ আপনি-আমি অনুভব করি কিংবা না করি তাতে আমাদের চারপাশে প্রাকৃতিক পরিবেশের কী আসে যায়? তারা তো তাদের মতোই আছে।
আর কিছুদিন বাদে গাছের পাতা ঝরবে, বসন্তে নতুন পাতা গজাবে, কাকপক্ষী নিয়ম মেনে ভোরে জাগবে। আবার সন্ধ্যে হলে ফিরবে নীড়ে। মানব জগতে এই ক্ষমতার রদবদলের প্রক্রিয়া তারা বুঝে না।
কিন্তু আসলেই কি এর কোনোই প্রভাব প্রকৃতিতে নেই?
আজকের এই লেখা নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে নয় বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা দিক প্রকৃতির উপর প্রভাব নিয়ে। প্রতিবারই নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার প্রচারণায় ব্যবহার হয় অনেক পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট। যেদিকে চোখ যায় শুধুই সাদা কাগজে প্রার্থীদের ভোট চাওয়া।
শহর, মফস্বল, গ্রাম সমখানে ছেয়ে যাওয়া এসব পোস্টার-ব্যানার টেকসই করতে ব্যবহার হয় প্লাস্টিকজাত বা পলিথিনের আবরণ। এভাবে প্রচারপত্রে প্লাস্টিকজাত Thermal Lamination film বা পলিথিনের আবরণ কিংবা প্লাস্টিক ব্যানার (পিভিসি ব্যানার) বরাবরের মতোই পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
২০২১ সালে The World Bank প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ১৫ বছরে (২০০৫ থেকে ২০২০) বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার এর পরিমাণ বেড়েছে তিন গুন। ২০২০ সালে ৯৭৭০০০ টন প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে যার মাত্র ৩২ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়েছে।
এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের মধ্যে বেশির ভাগই সিংগেল ইউজ প্লাস্টিক যেমন শপিং ব্যাগ বা পণ্যে মোড়ক। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। সেখান থেকে নালা ও খাল হয়ে নদীতে পড়ছে। সর্বশেষ ঠাঁই হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে।
শুধু রাজধানী ঢাকাতেই বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার গড়ে ২২.২৫ কিলোগ্রাম যা সারাদেশের মোট শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার এর তুলনায় ৩ গুন বেশি। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্লাস্টিকের ব্যবহার বিপুল পরিমাণে হওয়ায় এই সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দিবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
The Business Standard এর ১০ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য। সেখানে দেয়া তথ্য অনুসারে,
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ভাষ্যমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে প্রায় ২৭ হাজার টন প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার, ব্যানার, কার্ড, লিফলেট ব্যবহৃত হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী শহরের প্রেসগুলোতে সার্ভে করে এসডো জানিয়েছে, ঢাকা শহরেই ১৭ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে।
এসডোর মহাসচিব ডা. শাহরিয়ার হোসেন জানিয়েছেন,
“সারাদেশে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার, ব্যানারের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। আমাদের কোনও সিটি কর্পোরেশনেরই সক্ষমতা নেই এসব প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল কিংবা সংরক্ষণ করার। ২০২০-এর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার টন।”
এক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক জনজীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলবে। প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক যত পণ্য যেখানে সেখানে পড়ে থাকলে তা থেকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। খাল, ড্রেন সহ বিভিন্ন নিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্লাস্টিক বাধার সৃষ্টি করে। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের মাটির নিচের কোনো কোনো প্লাস্টিক এক যুগের বেশি পুরোনো।
এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবেই জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরে বিরাট আকার ধারণ করে। আষাঢ়-শ্রাবণের ভারী বর্ষণে জনজীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, ডায়রিয়া ভয়াবহ আকার ধারণ করে যা বিগত বছরগুলোতে ঢাকাবাসী নিয়মিত সঙ্গীই বলা চলে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩০শে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ হাজার ১৩৮ জন মানুষ। এ সময়ে মারা গেছেন ২৪৬ জন। দিন শেষে মাটি-পানি এমনকি মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে দূষিত হচ্ছে চারপাশে বায়ু। এতে মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব তো পড়ছেই পাশাপাশি গাছপালা, পশু-পাখি, জলজ প্রাণীদের জীবনও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
নির্বাচনী প্রচারে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা পূর্বেই দিয়েছিলো নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে তা মানার ক্ষেত্রে গাফিলতি ছিল লক্ষণীয়।
সবদিক বিবেচনায় প্লাস্টিকের এত বেশি ব্যবহার আমাদের দেশের বিরাট ক্ষতির কারণ। এর থেকে উত্তরণের জন্য চাই যথাযথ ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা এবং নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি। প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক যত পণ্যের পরিবর্তে বায়োডিগ্রেডেবল পদার্থ পদার্থের ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি প্লাস্টিকজাত পণ্য পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল করার চর্চা করতে হবে।
জুম্মান আল সিয়াম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, বাংলাট্রিবিউন, টিবিএস