এবার সময় চলে এসেছে প্লাস্টিক দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার। কারণ বিজ্ঞানীরা একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যেখানে প্লাস্টিককে রূপ দেয়া হচ্ছে সাবানের। ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটির একটি দল প্লাস্টিক ব্যাগকে গরম এবং ঠান্ডা করে এমন একটি পদার্থ তৈরি করেন যা সাবানের প্রধান উপাদান। এবার প্লাস্টিক ব্যবহৃত হবে হাত ধোয়ার কাজে।
প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার প্রায় ৬০ শতাংশই দিনশেষে যায় ভাগাড়ে। প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র এক-দশমাংশই পুনর্ব্যবহার করা হয়, যার অধিকাংশই ব্যবহার করা হয় পার্কের বেঞ্চ তৈরির জন্য নিম্নমানের উপাদান হিসাবে। তাই রসায়নবিদরা প্লাস্টিককে আরও মূল্যবান কাঁচামালে পরিণত করার উপায় খুঁজছেন। গবেষকরা “Science” পত্রিকার ১০ আগস্টের সংস্করণে রিপোর্ট করেছেন যে পুরোনো প্লাস্টিককে সার্ফ্যাক্টেন্টে পরিণত করার একটি উপায় আছে৷
সারফ্যাক্ট্যান্ট হলো একটি রাসায়নিক যৌগ যা দুটি তরল বা একটি তরল এবং একটি গ্যাস অথবা একটি তরল এবং একটি কঠিনের মধ্যে পৃষ্ঠের টান হ্রাস করে। এটি ওয়েটিং এজেন্ট, ডিটারজেন্ট, ফোমিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে। সারফ্যাক্ট্যান্ট হলো লুব্রিকেন্ট, স্কি ওয়াক্স, ডিটারজেন্ট এবং সাবানের মতো কয়েক ডজন পণ্যের মূল উপাদান।
বাইরে থেকে দেখে প্লাস্টিক এবং সাবানের মধ্যে কোনো প্রকার মিল খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আণবিক স্তরে এই দুই পদার্থের মধ্যে একটি আশ্চর্যজনক সংযোগ রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলির মধ্যে একটি হলো পলিথিলিন (Polythylene)। আকর্ষণীয়ভাবে এটা ফ্যাটি এসিডের মতো যা সাবানের অন্যতম রাসায়নিক উপাদান।
পলিথিলিন এবং ফ্যাটি অ্যাসিড উভয় উপাদানই দীর্ঘ কার্বন চেইন দিয়ে তৈরি। তবে ফ্যাটি অ্যাসিডের চেইনের শেষে অতিরিক্ত একগুচ্ছ পরমাণু রয়েছে।
ভার্জিনিয়া টেকের রসায়নের সহযোগী অধ্যাপক এবং Science জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের লেখক গুওলিয়াং লিউ দীর্ঘদিন ধরে ভাবছিলেন যে এই মিলটি ইঙ্গিত দেয় যে পলিথিলিনকে ফ্যাটি অ্যাসিডে এবং তারপরে সাবানে রূপান্তর করা সম্ভব। সমস্যাটি ছিল আণবিকভাবে প্লাস্টিক আকারে খুব বড়, প্রায় 3,000 কার্বন পরমাণু লম্বা।
যেখানে ফ্যাটি অ্যাসিড আকারে অনেক ছোট। চ্যালেঞ্জ ছিল কীভাবে দক্ষতার সাথে একটি দীর্ঘ পলিথিলিন চেইনকে ঐ আকারের ছোট চেইনে ভাঙা যায়। লিউ বিশ্বাস করতেন যে, একটি নতুন পুনঃব্যবহার পদ্ধতির সম্ভাবনা রয়েছে যেখানে কম-মূল্যের প্লাস্টিক বর্জ্যকে উচ্চ-মূল্যের দরকারি পণ্যে পরিণত করা যাবে।
সমাধানটি লিউর কাছে এসেছিল একেবারে হঠাৎ করেই।
তিনি বলেন,
“সেটি বড়দিনের সময় ছিল আর আমি অগ্নিকুণ্ড দেখছিলাম। যখন জ্বালানীকাঠ (Firewood) পোড়ানো হয় তখন তা থেকে জ্বালানি কাঠের ছোট কণা দ্বারা গঠিত ধোঁয়া নির্গত হয়। আমি ভাবছিলাম প্লাস্টিক পোড়ালেও একই ফলাফল পাওয়া যাবে কিনা। জ্বালানি কাঠ মূলত সেলুলোজ জাতীয় পলিমার দিয়ে তৈরি।
জ্বালানি কাঠের দহন প্রথমে এই পলিমারগুলোকে ছোট ছোট চেইনে ভাঙ্গে। তারপর এটি সম্পূর্ণ জারণের মাধ্যমে কার্বন ডাইঅক্সাইডে রূপান্তরিত হওয়ার আগে চেইনগুলোকে ছোট বায়বীয় অণুতে ভেঙে দেয়। যদি আমরা একইভাবে সিন্থেটিক পলিথিলিন অণুগুলোকে ভেঙে ফেলি কিন্তু প্রক্রিয়াটি ছোট গ্যাসীয় অণুতে ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই বন্ধ করে দেই, তাহলে আমাদের পলিথিলিনের মতো শর্ট-চেইন অণু পাওয়া উচিত।”
যদিও নিরাপত্তা এবং পরিবেশের কারণে প্লাস্টিককে কখনই অগ্নিকুণ্ডে পোড়ানো উচিত নয়।
তাই লিউ ভাবতে শুরু করেন,
যদি পলিথিনকে নিরাপদভাবে পরীক্ষাগারে পোড়ানো যায় তাহলে কী হবে?
পলিথিলিনের অসম্পূর্ণ দহন কি কাঠ পোড়ানোর মতোই ধোঁয়া উৎপন্ন করবে?
কেউ যদি সেই ধোঁয়া ধরতে পারে, তাহলে তা কী দিয়ে তৈরি হবে?
লিউ তার ল্যাবে কর্মরত রসায়নের দুইজন পিএইচ.ডি. ছাত্র জেন জু এবং এরিক মুনিয়ানেজা এর সহায়তায় একটি চুল্লি তৈরি করেন যা নিরাপদে প্লাস্টিক পোড়াতে ব্যবহার করা যাবে। চুল্লিটি এমনভাবে তৈরি যেন এর নীচের অংশের তাপমাত্রা পলিমার চেইনগুলোকে ভেঙে ফেলার জন্য যথেষ্ট গরম থাকে কিন্তু উপরের অংশটি এমনভাবে ঠান্ডা থাকে যেন চেইনগুলো খুব বেশি ভেঙে না যায়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় থার্মোলাইসিস। এই থার্মোলাইসিসের পর বিজ্ঞানীরা প্লাস্টিকের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করেন এবং তারা যে পণ্যটি পান তা হলো শর্ট-চেইন পলিথিলিন যা এক ধরনের মোম।
এই শর্ট-চেইন পলিথিলিনকে কে আবারো প্লাস্টিকে পরিণত করাসহ আরো অনেক বিস্তৃত কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে তবে গবেষকরা সাবান এবং ডিটারজেন্ট তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেন। কারণ অন্যান্য ফ্যাটি অ্যাসিড পণ্যের তুলনায় সাবান বেশ দামি যা প্রক্রিয়াটিকে অর্থনৈতিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে। এছাড়াও চাহিদার কথা চিন্তা করলে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী সাবানের চাহিদা প্লাস্টিকের মতোই উচ্চ।
লিউ বলেন,
“প্লাস্টিককে সাবানে পরিণত করার জন্য একটি পদ্ধতি বিকাশের এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ”।
স্যাপোনিফিকেশন সহ আরও কয়েকটি ধাপ যুক্ত করার পরে, দলটি প্লাস্টিক থেকে বিশ্বের প্রথম সাবান তৈরি করেছে। স্যাপোনিফিকেশন এমন একটি প্রক্রিয়া যা চর্বি, তেল বা লিপিড (অ্যাসিড) কে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড (বেস) এর সাথে একত্রিত করে সাবানে রূপান্তর করে। প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য দলটি গণনামূলক মডেলিং, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং আরও অনেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়েছে।
লিউ বলেন,
“এটি বিশ্বের প্রথম প্লাস্টিক থেকে তৈরি সাবান। আমাদের গবেষণা অভিনব অনুঘটক বা জটিল পদ্ধতি ব্যবহার না করে প্লাস্টিক আপসাইক্লিংয়ের জন্য একটি নতুন রাস্তা দেখায়। এই কাজে আমরা প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করার জন্য একটি বাস্তবিক কৌশলের সম্ভাব্যতা দেখিয়েছি।”
যদিও এই প্রকল্পটিকে অনুপ্রাণিত করেছিল পলিথিলিন নামক প্লাস্টিক। কিন্তু আপসাইক্লিং পদ্ধতিটি পলিপ্রোপিলিন নামে পরিচিত আরেক ধরনের প্লাস্টিকের উপরও কাজ করতে পারে। প্লাস্টিক পণ্যের প্যাকেজিং থেকে শুরু করে খাদ্যের পাত্র থেকে নিয়ে পরিধেয় কাপড়, প্লাস্টিক ভোক্তারা প্রতিদিন মুখোমুখি হন এই দুই বহুল ব্যবহৃত প্লাস্টিকের। লিউ-এর আপসাইক্লিং পদ্ধতির একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল যে এটি এই দুটি প্লাস্টিকে একবারেই ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্লাস্টিক দুটিকে একে অপরের থেকে আলাদা করার প্রয়োজন নেই।
আপসাইক্লিং কৌশলটির আরেকটি সুবিধা হল যে এর জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান দুটি খুবই সহজলভ্য: প্লাস্টিক এবং তাপ। যদিও প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপগুলিতে মোমের অণুগুলিকে ফ্যাটি অ্যাসিড এবং সাবানে রূপান্তর করার জন্য কিছু অতিরিক্ত উপাদানের প্রয়োজন হয় তবুও প্লাস্টিকের প্রাথমিক রূপান্তরটি একটি সরল প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। এটি পদ্ধতির ব্যয়-কার্যকারিতার পাশাপাশি এর পরিবেশের উপর তুলনামূলক কম প্রভাবে অবদান রাখে।
লিউয়ের পদ্ধতির একটি সুবিধা হলো এটি অনেক পুরোনো প্লাস্টিকের উপরও কাজ করে, যা স্বাভাবিক উপায়ে পুনর্ব্যবহার করা যায় না। পদ্ধতিটি এমনভাবে তৈরি যেন এটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বড় স্কেলেও ব্যবহার করা যায়।
গবেষণার সহ-প্রধান লেখক ঝেন জু বলেছেন,
“এটা উপলব্ধি করা উচিত যে প্লাস্টিক দূষণ শুধু কয়েকটি মূলধারার দেশের সমস্যা না বরং একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। কোনো পরিশীলিত প্রক্রিয়া এবং জটিল অনুঘটক বা রিএজেন্টের তুলনায় একটি সাধারণ আপসাইক্লিং প্রক্রিয়া বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে ব্যবহারের উপযোগী। আমি আশা করি এটি প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধের জন্য একটি ভালো শুরু হতে পারে।”
আপসাইক্লিং প্রক্রিয়াকে একটি বৃহৎ পরিসরে কার্যকর করার জন্য চূড়ান্ত পণ্যটিকে অবশ্যই যথেষ্ট মূল্যবান হতে হবে যাতে এর ব্যবহারকারী সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার খরচ মেটাতে পারে এবং একে অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিকল্পের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
তাই লিউ বলেন,
“এই গবেষণাটি ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে অন্যান্য দরকারি পদার্থ তৈরি করার মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর একটি নতুন উপায়ের ভিত্তি তৈরি করে।”
তিনি আশা করেন যে সময়ের সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে পুনর্ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই কৌশলটি বাস্তবায়ন শুরু করবে। যদি তাই হয়, তাহলে ভোক্তারা একদিন প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস করার মতো বিপ্লবী সাবান পণ্য কেনার সুযোগ পাবেন বলে আশা করা যায়।
শাহলীন রাহনুমা / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ফিজিক্স অর্গ, দ্য গার্ডিয়ান
–