স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধটি নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশন হচ্ছে প্রোস্টেট ক্যান্সারের কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে প্রতিকার হিসেবে সহায়তা করতে পারে।
গবেষকরা ওলাপরিব নামক ওষুধটি একটি সাধারন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় অ্যাডভান্সড প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং ড্যামেজড ডিএনএ মেরামতে যুক্ত একটি জিনের (যেমন বিআরসিএ–১ বা বিআরসিএ–২) জেনেটিক মিউটেশন হচ্ছে এমন ৪০০ জন ব্যক্তির উপর ব্যবহার করা হয়।
এই জিনগত ত্রুটিগুলো স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সার সহ কিছু নির্দিষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রতিকার করা কঠিন এমন প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৩০ শতাংশ রোগীর এই ধরনের জেনেটিক মিউটেশন দেখা যায়। বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনা করার জন্য ৩য় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় রোগীদেরকে তাদের জেনেটিক মিউটেশন অনুযায়ী ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো।
প্রথম গ্রুপের ২৪৫ জন রোগীর স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সারের সাথে যুক্ত এমন জিনে জেনেটিক মিউটেশন হয়েছিলো (যেমন বিআরসিএ–১, বিআরসিএ–২ এবং এটিএম) ; আর দ্বিতীয় গ্রুপের ১৪২ জন রোগীর ডিএনএ মেরামতকারী জিন গুলোতে জেনেটিক মিউটেশন হয়েছিলো।
প্রতি গ্রুপের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ ব্যক্তি ওলাপরিব নিয়েছিলেন। ওলাপরিব দেওয়া পুরুষদের দেহে ওষুধটি স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসার ওষুধের তুলনায় ধীরে কাজ করছিলো, যা ক্যান্সার কোষ গুলোকে টেস্টোস্টেরন হরমোন থেকে বঞ্চিত করেছিলো।
৩০ সেপ্টেম্বর, বার্সেলোনায় ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ মেডিক্যাল অনকোলজির একটি মিটিং এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এক বছর পর ওলাপরিব গ্রহণকারী ব্যক্তিদের ২২ শতাংশের স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা গ্রহণকারী ১৩.৫ শতাংশ ব্যক্তির তুলনায় ক্যান্সার বাড়ার কোনো লক্ষন দেখা যায়নি।
বিআরসিএ–১, বিআরসিএ–২ এবং এটিএম জিনে মিউটেশন হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই পার্থক্যটা আরো বড় ছিলো। ৯.৮ শতাংশ স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তির তুলনায় ওলাপরিব নেওয়া ২৮ শতাংশ ব্যক্তির দেহে ক্যান্সারের অগ্রগতির কোনো লক্ষণ ছিলোনা।
বিআরসিএ গ্রুপের পরিমাপযোগ্য টিউমার যুক্ত রোগীদের মাঝে স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণকারীদের ২.৩ শতাংশের তুলনায় ওলাপরিব গ্রহণকারীদের টিউমার এক–তৃতীয়াংশ পর্যন্ত সংকুচিত হয়েছিলো। ওলাপরিব একটি পিএআরপি বাধাদানকারী, যা পিএআরপি এনজাইমকে ব্লক করে যা ভাঙা ডিএনএ মেরামতে সাহায্য করে। ক্যান্সার সেল গুলো ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ এর সাথে যুক্ত হয়ে কোষগুলোকে ক্যান্সারোজেনিক করে ফেলে, কিন্তু পিএআরপি এনজাইম বাধাপ্রাপ্ত হবার কারনে কোষগুলো অনেকসময় নিজেকেই ধ্বংস করে দেয়।
মাহা হোসেইন, যিনি বার্সেলোনার সভায় এই পরীক্ষার ফলাফল গুলো উপস্থাপন করেছিলেন, বলেন, ” এই ওষুধটি প্রোস্টেট, স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সারে একইভাবে কাজ করে। একটি যথাযথ ওষুধ পাবার লক্ষ্যে কাজ করে আমি মনে করি আমরা এই সম্ভাবনাটি উন্মুক্ত করেছি।”
আমেরিকান খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সারের জন্য ওলাপরিব ব্যবহারের অনুমোদন দিলেও প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য দেয়নি। যদি এফডিএ এই রোগের প্রতিকারের জন্য ওষুধটি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়, সেক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য এটি প্রথমবারের মতো কোনো ব্যক্তির জিনের উপর ভিত্তি করে একটি থেরাপি হবে।
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি জানিয়েছে, আমেরিকাতে ৭ জন পুরুষের মাঝে ১ জন তার জীবদ্দশায় প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে। আমেরিকান পুরুষদের মাঝে এটি ত্বকের ক্যান্সারের পর সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে।
কিন্তু এটি চিকিৎসাযোগ্য।
চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রোস্টেট অপসারন করে বা রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সার কোষগুলো ধ্বংস করতে পারেন। বা তারা দেহে পুরুষ হরমোনের মাত্রা হ্রাস করে বা ক্যান্সারসেলের বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার ব্যাবস্থা করতে পারেন।
তবে, কিছু রোগীদের ক্ষেত্রে, এই থেরাপিগুলি কার্যকর হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩০,০০০ পুরুষ প্রতি বছর প্রোস্টেট ক্যান্সারে মারা যায়।
প্রায় সব পুরুষই, ওলাপারিব বা স্ট্যান্ডার্ড হরমোন জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করুক, রক্তাল্পতা, বমি বমি ভাব বা ক্লান্তির মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন। যাইহোক, ওলাপরিব গ্রহণকারীদের রক্তাল্পতার হার বেশি ছিল এবং তারা আরও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার রিপোর্ট করেছেন।
“অনুসন্ধানগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, এই নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশনযুক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ওলাপরিবের মতো একটি পিএআরপি ইনহিবিটর অন্য ধরণের হরমোনাল থেরাপির চেয়ে আরও ভাল কাজ করতে পারে,” বলেছেন বেথসডায় ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্রের ক্লিনিক্যাল গবেষণার বৈজ্ঞানিক পরিচালক ও অনকোলজিস্ট উইলিয়াম দাহুত।
তবে, এখন জেনেটিক মিউটেশন যাচাই করার জন্য প্রোস্টেট ক্যান্সার রোগীদের পরীক্ষা করা হয়না যতক্ষণ না ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে।
উইলিয়াম দাহুত বলেছেন, “আমি মনে করি এটি আরও অনেক পুরুষদের এই জিনগত অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য পরিচালিত করবে।” পুরুষদের যদি খুব প্রাথমিক পর্যায়ে এই জিনগত পরিবর্তনগুলোর জন্য পরীক্ষা করা হয়, তবে চিকিৎসকরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হতে পারেন কোন রোগী দ্রুত একটি PARP- ইনহিবিটার ড্রাগ শুরু করার ফলে উপকার পেতে পারে। “এটি অন্তত সম্ভব যে এই ওষুধগুলি আগে ব্যবহার করা, যা তাদের উপর আরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।”
তবে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি এখন পর্যন্ত পরীক্ষাধীন রয়েছে, আরো কিছু রোগী এখনো পর্যবেক্ষনে রয়েছেন। সবধরনের রোগীর ওপর এই ওষুধের প্রভাব ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত সময় এখনো আসেনি। ওলাপরিব প্রস্তুতকারী ওষুধ কোম্পানি গুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এই ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাটি ২০২১ সালের শুরু পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।