কখনও কি কোনো পাখি বা প্রজাপতি দেখে আপনার মাথায় এসেছে, “ইশশ, যদি আমি এর সাথে কথা বলতে পারতাম, তাহলে এর অনুভূতিগুলো মানুষের মতোই আমাকে জানাতে পারতো!” ভাবুন তো, কেমন হবে যদি আপনার এই পছন্দের প্রাণী কিংবা পোষা প্রাণীর সাথে মানুষের মতো করে মত বিনিময় করতে পারেন? অসাধারণ এক অনুভূতি হতো, তাইনা?
দারুণ বিষয় হচ্ছে, এখন অসাধারণ এই অনুভূতির ধারণা হয়তো বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হবে এআই এর কল্যাণে। পশুপাখির সাথে কথা বলার জন্যে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বেছে নিয়েছেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং পোর্টেবল সেন্সর।
১৯৭০ সালে কোকো নামে একটি তরুণ গরিলা মানুষের ভাষার কিছু প্রতীক ব্যবহার করে পুরো বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। গরিলা ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীদের মাঝে শিম্পাঞ্জী এবং ডলফিন নিজেদের মধ্যে কিছু প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করতো। তাদের এই প্রতীকী সংকেত গুলো তারা নিজেরা ঠিক কতোটুকু বুঝতো সেটি নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিলো। তখন এই প্রতীকী সংকেতের বাস্তবিক কোন ব্যাখ্যা না থাকায় নিরর্থক ধরা হতো।
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কারেন বেকার সম্প্রতি তার বিবৃতিতে জানান, “প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে বর্তমানে আমাদের দুইটি দল গবেষণার কাজ করছে। গবেষকদের একদল পর্যবেক্ষণে দেখতে পান যে, প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্যে প্রতীকী সংকেত ব্যবহার করে এবং অন্যদল দাবি করে যে, প্রাণীদের এই সংকেত গুলো এনথ্রোপোমোরফাইজিং (মানুষের মতো করে হাসি, আবেগ, অভিব্যক্তি প্রকাশ করা)। তিনি আরো বলেন,
“পশুপাখির সাথে যোগাযোগ করতে হলে আমাদের তাদের মতো করে আচরণ করা উচিত।”
বেকারের নতুন বই The Sounds of Life: How Digital Technology Is Bringing Us Closer to the Worlds of Animals and Plants-এর একটি সেক্টর হলো “Digital Bioacoustics”। যেখানে বিজ্ঞানীদের পুরো গাছপালা এবং প্রাণীদের বিস্তৃতি জুড়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে এডভান্স সেন্সর এবং এআই টেকনোলজি ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এছাড়াও প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করার ব্যাপারে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা কিভাবে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণীদের অন্যান্য প্রজাতি, যেমন বাদুড়, মৌমাছি সহ অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়া যায় সেই প্রসঙ্গে বেকারের সাথে কথা বলেছেন।
যেভাবে প্রাণীদের সাথে মানুষের যোগাযোগ শুরু হয়:
বেশ কিছু সময় আগেও পশুপাখির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো মানুষ কেন্দ্রিক। আমরা পশুপাখিদের আমাদের মতো করে কথা বলানোর চেষ্টা করতাম, অথচ আমাদের প্রয়োজন ছিলো তাদের সামর্থ্য নিয়ে চিন্তা করা, যে তারা ঠিক কতটুকু মানুষের আচরণ নিতে পারবে প্রাণি হিসেবে! বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে অনেকবারই গরিলাদের মানুষের ভাষা শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। তবে সেই চেষ্টা কিছুটা ব্যর্থ এবং বিতর্কিত ছিলো।
কারেন বেকারের বইয়ে The Notion of Umwelt এ প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ-এর ধরন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। ধরুন, আপনি মৌমাছির সাথে কথা বলতে চান, এরজন্য অবশ্যই মৌমাছি কিভাবে আচরণ করে সেটি সম্পর্কে আগাম ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেমন, মৌমাছির সঙ্গে কথা বলতে হলে তাদের আচরণ সম্পর্কে, যেমন: ভনভনে কম্পমান শব্দ এবং একই সময়ে তাদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত থাকা প্রয়োজন।
কি ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এই ডিজিটাল বায়োঅ্যাকোস্টিকসে?
ডিজিটাল বায়োঅ্যাকোস্টিকস প্রযুক্তি হলো খুবই ক্ষুদ্র, সহজেই বহনযোগ্য ডিজিটাল রেকর্ডার যার মধ্যে ক্ষুদ্রাকৃতির মাইক্রোফোন বসানো হয়। বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিটি আর্কটিক থেকে আমাজনে জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জীবজন্তু যেমন কচ্ছপ, তিমির পিঠে বসান। এছাড়াও সমুদ্রের গভীরে, পাহাড়ের উচ্চতায়, পাখির গায়ে বসিয়ে পরীক্ষা করেন। এই আধুনিক চিপটি কোনো প্রকার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে অনবরত রাতদিন ২৪ ঘন্টা শব্দ সংগ্রহ করতে পারে।
তারপর এই ইন্সট্রুমেন্টটি হতে প্রাপ্ত তথ্য ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিংয়ের এলগরিদম ব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) মাধ্যমে মানুষের কাছে গুগল ট্রান্সলেটরের মতো পরিবর্তিত ভাষায় বোধগম্য করে তোলা হয়।
এখন পর্যন্ত পশুপাখির সাথে যোগাযোগের কিছু নমুনা:
ইয়োসি ইয়োভেল তার গবেষণায় প্রায় ২৪ টি মিশরীয় ফল-খেকো বাদুড়ের উপর গবেষণা করে, আড়াই মাস ধরে বাদুড়ের কন্ঠস্বরের শব্দগুলো রেকর্ড করেন, যেখানে তার টিম প্রায় ১৫০০০-এরও বেশি শব্দের বিশ্লেষণ করেন। এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে গবেষকরা বাদুড়সহ অন্যান্য প্রজাতির শব্দ সংরক্ষণ করে বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রেণীবিন্যাস করেন। এই শব্দগুলো ভিডিও ফুটেজে ধারণকৃত তাদের একের অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করার সময় নির্দিষ্ট শব্দের সাথে এআই অ্যালগরিদম সম্পর্কযুক্ত করে।
সেখানে দেখা যায়, দুটি বাদুড় খাবারের জন্যে একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া বেঁধেছিলো। এছাড়াও বাদুড়রা খাবার নিয়ে ঝামেলা ছাড়াও দেখা যায় লিঙ্গ নিয়ে মতভেদ করছে, তারা ব্যক্তিগত নাম ধরে ডাকছে, এছাড়াও মা বাদুড় তাদের বাচ্চাকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্যে ভাষা শিখাচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যেখানে মানুষ তাদের বাচ্চাদের সাথে কথা বলার সময় উচ্চস্বরে বলে, মা-বাদুড় তার বাচ্চার সাথে মৃদুস্বরে শিখাচ্ছে।
ঐ গবেষণায় আরো দেখা যায় বাদুড়রা খুব দ্রুত মত বিনিময় কিংবা কথা বলে। তবে কম্পিউটার কোনো সমস্যা ছাড়াই খুব দ্রুত ধরে নিতে পারে, সেগুলো বুঝার জন্যে ভিডিওর গতি ও ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে শুনতে হয়েছিলো গবেষকদের। তারপরে এআই এলগরিদমটি প্রসেসিং করে আবার বাদুড়দের কাছে বার্তা পাঠায়। এই জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমানে গবেষকরা তথ্য আদান প্রদান করছে।
গবেষকরা কীভাবে মৌমাছির সাথে কথা বলছেন?
মৌমাছি নিয়ে গবেষণা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো ছিলো, যার ফলে বিজ্ঞানীরা এআই এবং পশুপাখি মাঝে যোগাযোগের পদ্ধতিতে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। গবেষক টিম ল্যান্ডগ্রাফ তার গবেষণায় জানান, “মৌমাছিরা যখন একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে তখন তাদের নড়াচড়া এবং ভনভন শব্দের মাধ্যমেই তথ্য আদানপ্রদান করে থাকে।” তারপরে কম্পিউটারের ডিপ লার্নিং ল্যাংগুয়েজ প্রতিটি মৌমাছির অবস্থান এবং কম্পমান শব্দগুলো খুব ভালোভাবে চিহ্নিত করে। ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিংয়ের সমন্বয়ে মৌমাছি গুলো একে অপরের সাথে কি নিয়ে মত বিনিময় করছে, তা নিখুঁত ভাবে নির্ধারণ করা হয়। পরে শব্দগুলো ডিকোড করে তাদের কিছু নির্দিষ্ট সংকেত পাওয়া যায়।
টিম ল্যান্ডগ্রাফ দেখতে পান, মৌমাছিরা চুপ করতে কিংবা থামতে অথবা বিপদ আপদ দেখলে আলাদাভাবে সংকেত দিয়ে থাকে। এছাড়াও তারা কোনোকিছু ঝাঁকড়ানো কিংবা কাঁপানোর জন্যেও ভিন্ন সংকেত ব্যবহার করে।
ল্যান্ডগ্রাফ এই শব্দগুলোকে এনকোড করে একটি রোবট তৈরি করেন, যার নাম “রোবোবি” দেন। তারপর তিনি ৭/৮ টি রোবোবি মৌচাকে প্রবেশ করান। মূলত পরিকল্পনা ছিলো, রোবোট মৌমাছিটি যেভাবে নির্দেশ করবে তারা সেভাবে সাড়া দিবে। যেমন তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাচ ওয়াগল, যেটি ব্যবহার করা হয় তাদের মধুর উৎসের অবস্থান জানতে।
ল্যান্ডগ্রাফের এই সহজ এক্সপেরিমেন্টটিতে তিনি একটি মধুর উৎস রাখেন, যা সম্পর্কে ঐ মৌচাকের কোনো মৌমাছি আগে জানতো না। তারপর তিনি ঐ রোবোটকে দিয়ে মৌমাছিদের ল্যান্ডগ্রাফের রাখা মধুর উৎসে যাওয়ার পথ দেখান। মজার ব্যাপার হলো মৌমাছি গুলো রোবোটটির নির্দেশ ঠিকমতো ফলো করে এবং মধুর সন্ধান পায়। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, এটি শুধুমাত্র একবারই ঘটে, এবং বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত না এই এক্সপেরিমেন্টটি পরবর্তীতে কেনো কাজ করেনি। যাইহোক, এটি এখন পর্যন্ত এআই-এর বিস্ময়কর ফলাফল।
এই প্রযুক্তি প্রকৃতির উপর কি ধরনের প্রভাব ফেলছে?
এই এআই ব্যবহার নিয়ে বিচক্ষণতার কিংবা নৈতিকতার দিক থেকে অনেকগুলো প্রশ্ন আসতে পারে। তবে অন্যভাবে চিন্তা করলে, এই এআই ব্যবহার করে মৌমাছিদের রক্ষা করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৌমাছিদের নিরাপদ মধু সংগ্রহে নির্দেশ দেওয়া যায়, যেসব মধুর উৎসে দূষিত পদার্থ থাকে অথবা প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে যেসব স্থানে না যাওয়ার জন্যে অনুৎসাহিত করা যায়।
এছাড়াও পূর্বে যেসব বন্য প্রাণীদের গৃহপালন করা সম্ভব হয়নি, সেসব প্রাণীরদের সাথে যোগাযোগ-এর জন্যে এআই একটি হাতিয়ার হতে পারে। এআই ব্যবহার করে অন্যান্য বন্য প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণও নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। পরিশেষে, মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে যোগাযোগের ভাষার অনন্য এক ক্ষমতা হতে পারে।
ডিজিটাল বায়োঅ্যাকোস্টিকস-এর অগ্রগতি অনেকটাই মাইক্রোস্কোপের অনুরূপ। যখন ডাচ বিজ্ঞানী এ্যান্টোনি ভ্যান লিউয়েনহুক মাইক্রোস্কোপে অনুজীব দেখছিলেন, তখন তিনি এতে আবিষ্কার করেন ভবিষ্যতের অগণিত যুগান্তকারী অগ্রগতি। নিশ্চিতভাবে অণুবীক্ষণ যন্ত্র আমাদের দেখা এবং কল্পনা উভয়ই নতুনভাবে ভাবতে সক্ষম করেছে।
একইরকম ভাবে, ডিজিটাল বায়োঅ্যাকোস্টিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় আমাদের নতুন করে শোনা এবং কল্পনা করার ব্যাপারে বিপ্লব এনেছে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আস্তে আস্তে মানুষের সাথে পশুপাখির মধ্যে যে দূরত্ব ছিলো সেটি কমিয়ে আনবে। সেইসাথে মানুষ এবং গাছপালার সাথেও নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করার উপায় আনবে। হয়ত, এটি প্রকৃতির সাথে আমাদের বন্ধন সুদৃঢ় করার নতুন আরেকটি উপায়!
মোঃ শরীফুল ইসলাম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, দ্যা সান