পর্যায় সারণির ৬নং পর্যায় এবং ১৬নং গ্রুপে ৮৪ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট মৌলটির নাম ‘পোলোনিয়াম‘। স্কুল-কলেজের বইগুলোতে প্রতিদিন পর্যায় সারণির রঙিন ছবিটি দেখতে দেখতে এ বিষয়টা আর আমাদের জন্য খুব একটা নতুন বা আকর্ষণীয় কিছু নয়। কিন্তু এই পোলোনিয়ামের ইতিহাস -এর সাথেই জড়িয়ে আছে একটি পরাধীন জাতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা ও একটি জাতির অবিসংবাদিত নেতাকে হত্যার ইতিহাস।
মৌলটির আবিষ্কারক হলেন স্বয়ং ‘মেরি কুরি’। তিনি ইতিহাসের প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী। ১৮৬৭ সালে মেরি স্ক্লদভ্স্কা (মেরি কুরি-র স্লাভিক নাম) বর্তমান পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো তে জন্মগ্রহণ করেন। ঐ সময় পোল্যান্ড নামক স্বাধীন কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলনা। দেশটির বর্তমান ভূখণ্ডের বেশির ভাগ অংশ রাশিয়া (রুশ সাম্রাজ্য) এবং বাকি অংশটুকু প্রোশিয়া (জার্মান সাম্রাজ্য) এবং অস্ট্রিয়ার মাঝে বণ্টিত ছিল।
মেরি স্ক্লদভ্স্কার জন্মস্থান ‘ওয়ারশো‘ ছিল রুশ সাম্রাজ্যের দখলে। তৎকালীন রাশিয়ায় নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। ফলে ছোটো মেরির লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় মূলত তার বাবার মাধ্যমে। মেরি ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি পোল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথেও যুক্ত হন। তিনি মূলত শিশুদের ‘পোলিশ’ ভাষা শিক্ষা দিতেন, যাতে করে তারা রাশিয়ান ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে না ফেলে। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। সেখানে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফরাসি পদার্থবিদ পিয়ের কুরির সাথে। এভাবেই তিনি ‘মেরি স্ক্লদভ্স্কা’ থেকে হয়ে ওঠেন ‘মেরি কুরি’। এই দম্পতি ১৯০৩ সালে তাদের তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ক গবেষণার দ্বারা পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পান।
(নিউট্রন ও প্রোটন সংখ্যার তারতম্যের কারণে কিছু মৌলের নিউক্লিয়াসে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণা (হিলিয়াম নিউক্লিয়াস), বিটা কণা (উচ্চ গতির ইলেক্ট্রন), গামা কণা (উচ্চ শক্তির ফোটন) ইত্যাদি নির্গত হয়। এই ঘটনাকে মৌলের তেজস্ক্রিয়তা বলে।)
পোলোনিয়ামের ইতিহাস : যেভাবে আবিষ্কৃত হলো
তবে এতটুকুতেই মেরি কুরির অর্জন থেমে থাকেনি। তিনি ‘Pitchblende’ নামক ইউরেনিয়াম আকরিককে পরিশোধন করে বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম আলাদা করতেন। ইউরেনিয়াম আলাদা করার পর কিছু বর্জ্য বাকি থাকতো। একদিন মেরি বর্জ্যগুলোতে একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেন। তিনি দেখতে পান বর্জ্যগুলোর তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়াম থেকে প্রায় ৩০০ গুণ বেশি। ফলে মেরি কুরি ধারণা করেন, বর্জ্যগুলোর মধ্যে থাকা মৌলটি ইউরেনিয়াম নয় বরং এটি নতুন আরেকটি মৌল। কুরি দম্পতি এই অজানা মৌল আবিষ্কারের জন্য কয়েক টন পরিমাণ ‘Pitchblende’ পরিশোধন করা শুরু করে দেন। এক টন আকরিকে অজানা পদার্থটির শুধুমাত্র ০.০০০১ গ্রামই উপস্থিত ছিল। বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনি অবশেষে নতুন দুটি মৌল আবিষ্কারে সক্ষম হন। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯১১ সালে তিনি রসায়নে নোবেল পান।
আরোও পড়ুন: পর্যায় সারণির ১১৮টি মৌল একসাথে ঝাঁকালে কী হবে?
রাজনৈতিক মৌল হিসেবে পোলোনিয়ামের আত্মপ্রকাশ:
আবিষ্কারক হিসেবে মেরি কুরিকেই মৌলগুলির নামকরণ করতে বলা হয়। এমন সময় মেরি কুরির মধ্যকার দেশপ্রেম তাকে নাড়া দেয়। পোল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম তখনও চলছে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বে জনমত গড়ার লক্ষ্যে তিনি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। নতুন আবিষ্কৃত মৌলদুটির একটির নাম তিনি তাঁর মাতৃভূমি পোল্যান্ডের নাম অনুসারে রাখেন ‘পোলোনিয়াম’। কোন রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৌলের নামকরণ করার মতো ঘটনা ইতোপূর্বে কখনও ঘটেনি। এবং অপর মৌলটির নাম রাখা হয় রেডিয়াম।
রাজনৈতিক হত্যায় পোলোনিয়ামের ব্যবহার:
পোলোনিয়ামের ইতিহাস -এ বেশ কিছু দুঃখজনক ঘটনারও নজির মেলে। ২০০৬ সালের পহেলা নভেম্বর। আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো লন্ডনের মিলেনিয়াম হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’ এর একজন সাবেক সদস্য। তবে রাশিয়ান সরকারের সমালোচনা এবং রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল নিয়ে ‘Blowing Up Russia’ নামক বই লেখার কারণে তিনি দেশছাড়া হন।
সেদিন আলেকজান্ডারের মিলেনিয়াম হোটেলে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্দ্রেই লুগোভোই এবং দিমিত্রি কভতুন নামক দুই সাবেক কেজিবি সদস্যদের সাথে দেখা করা। তবে তিনি জানতেন না যে, এ দুজন ব্যক্তি মূলত তার মৃত্যুদূত হয়ে তার সামনে হাজির হয়েছে। দেখা করার পরের দিন তিনি প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় ২২ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অবশেষে নভেম্বরের ২৩ তারিখ তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা নিশ্চিত হন যে, ঐদিন হোটেলে আলেকজান্ডারের খাওয়া চা তে বিষ মেশানো ছিল। আর বিষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ‘পোলোনিয়াম-২১০’।
রাজনৈতিক হত্যায় পোলোনিয়াম ব্যবহারের এটিই একমাত্র নজির নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা কে? এ প্রশ্নের উত্তরে যার নাম আসে তিনি হলেন ‘মোহাম্মদ আবদেল রহমান আবদেল রউফ আরাফাত আল কুদওয়া আল হুসেইনী’ সংক্ষেপে ‘ইয়াসির আরাফাত’।
২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাত রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কারণ ঘাটতে গিয়ে গবেষকরা তার লাশে অস্বাভাবিক হারে পোলোনিয়াম-২১০ এর উপস্থিতি পান। ফলে ধারণা করা হয়, শত্রুপক্ষ কোনভাবে তার খাবারের সাথে পোলোনিয়াম-২১০ মেশাতে সক্ষম হয়, যা তার মৃত্যু ঘটায়। এটিও পোলোনিয়ামের ইতিহাস-এর সাথে জড়িত আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা।
হত্যার জন্য বিষ হিসেবে পোলোনিয়াম ব্যবহারের কারণ কী?
পোলোনিয়াম এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বিষাক্ত পদার্থগুলোর মধ্যে একটি। এটি হাইড্রোজেন সায়ানাইড(HCN) এর চেয়েও ট্রিলিয়ন গুণ বেশি বিষাক্ত। বাতাসে হাইড্রোজেন সায়ানাইড এর পরিমাণ 300 mg/m3 এর সমান বা বেশি হলে একজন সুস্থ মানুষ ১০ মিনিটের মধ্যে মারা যাবে। পোলোনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় মৌল কারণ এটি আলফা কণা নিঃসরণ করে। যদি পোলোনিয়াম মানবদেহে ঢোকে, তাহলে এই আলফা কণা নিঃসরণ সহজেই কোষের মধ্যে থাকা রাসায়নিক বন্ধন গুলো ভেঙে ফেলে এবং DNA এরও প্রচুর ক্ষতি সাধন করে।
বন্ধনের ভাঙ্গনের ফলে তৈরি হয় প্রচুর ফ্রি রেডিক্যাল। ফ্রি রেডিক্যাল বা মুক্ত মূলক এমন এক ধরনের মূলক (এক বা একাধিক পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে চার্জ বহন করলে এদের মূলক বলে) যার যোজ্যতা স্তরে বা সর্ববৃহস্থ স্তরে একটি ইলেকট্রনের ঘাটতি থাকে। ইলেকট্রনের এ ঘাটতি পূরণের জন্য তা আশেপাশের অন্য কোন অণু বা পরমাণু থেকে ইলেকট্রন টেনে নেয়। একইভাবে দেহে অতিরিক্ত ফ্রি রেডিক্যাল উৎপন্ন হলে সেগুলো দেহে থাকা বিভিন্ন কোষ থেকে ইলেক্ট্রন টেনে নিতে থাকে। ফলস্বরূপ কোষগুলো ধ্বংস হতে থাকে। শ্বেত রক্তকণিকা বা White Blood Corpuscle আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাতে মূল ভূমিকা পালন করে। ফ্রি রেডিক্যালের কারণে এদেরও ক্ষতিসাধিত হয়। শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে দেহের এই প্রতিরক্ষাতন্ত্র দুর্বল হয়ে আসে এবং একপর্যায়ে ভেঙে পড়ে।
পোলোনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার ফলে নিঃসৃত আলফা কণা চুলের ফলিকলেও আক্রমণ করে। মূলত এ কারণে মৃত্যুর পূর্বে আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোর মাথার সকল চুল ঝরে যায়।
শেষ কথা:
১৯১৮ সালে প্রায় ১২৩ বছরের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর পোল্যান্ড রুশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। পোলোনিয়ামের নাম রাখা হয়েছিল পোল্যান্ডের নামানুসারে। বর্তমান পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটিই দেশ বাণিজ্যিকভাবে পোলোনিয়াম উৎপাদন করে। দেশটি নিশ্চয় পোল্যান্ড, ঠিক না? -না। বর্তমানে রাশিয়া হলো পৃথিবীর একমাত্র পোলোনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ। অথচ এই রাশিয়াই এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পোল্যান্ডের স্বাধীনতা খর্ব করেছিল।
তথ্যসূত্র:
২। Daily JSTOR, PubChem, Medical News Today, WHO, TheFactSource, LibreText, Britannica, NiePodLegla
নিজস্ব প্রতিবেদক/ আতিক হাসান রাহাত