গোটা বিশ্ব যখন ২০২০-২০২১ সাল ভুলে যেতে ব্যস্ত, পৃথিবী ও যেন আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে! প্যান্ডেমিকে অনেকরই মনে হয়েছে বছরদুটো যেন একটু বেশিই দ্রুত চলে গিয়েছে, চোখের পলকে কীভাবে কীভাবে যেন দিন কেটে গেল! কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই তাই! জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুসারে, গত ৫০ বছরে অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় ২০২১ সালটি ছিলো তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বছর এবং ২য় ছোট বছরটি ছিলো ২০২০।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে এটা কেন এবং কিভাবে হল? তাছাড়া গ্রহগুলোর গঠনের সাথে তাদের ঘূর্ণনের কী কোনো সম্পর্ক আছে? আর পৃথিবীর এরূপ অস্বাভাবিক দ্রুত ঘূর্ণন কি কি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে আমাদের উপর?
সৌরজগতের উদ্ভব সম্পর্কে কিছুকথা:
সৃষ্টিতত্ত্বের ক্ষেত্রে নীহারিকা অনুকল্প (Nebular Hypothesis) হল সৌরজগতের উদ্ভব ও বিবর্তন তথা অন্যান্য গ্রহব্যবস্থারও সৃষ্টিতত্ত্ব-ব্যাখ্যাকারী সর্বাধিক স্বীকৃত তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সূর্য-প্রদক্ষিণকারী গ্যাস ও ধুলোর থেকে সৌরজগতের উৎপত্তি ঘটেছিল। 1755 সালে ইমানুয়েল কান্ট তাঁর “বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক ইতিহাস ও অন্তরীক্ষ তত্ত্ব” গ্রন্থে এই তত্ত্বটি প্রথম প্রকাশ করেন। পরে 1796 সালে পিয়ের সিমোঁ লাপ্লাস এই তত্ত্বে কিছু পরিবর্তন সাধন করেছিলেন।
আদিতে সৌরজগতের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলেও গ্রহজগৎ উদ্ভবের প্রক্রিয়াটিকে এখন সমগ্র মহাবিশ্বেই ক্রিয়াশীল বলে মনে করা হয়। নীহারিকাতত্ত্বের সর্বাধিক স্বীকৃত আধুনিক রূপান্তরটি হল সৌর নীহারিকা চাকতি মডেল (Solar Nebular Disk Model) বা সৌর নীহারিকা মডেল (Solar Nebular Model)। এই তত্ত্বের মাধ্যমে গ্রহগুলির প্রায়-বৃত্তাকার ও একতলীয় কক্ষপথ এবং সূর্যের আবর্তনের সঙ্গে একই দিকে গ্রহগুলির গতিসহ সৌরজগতের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা করা যায়।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত গ্রহ গোলাকার কেন?
মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুই সবসময় স্টেবল অবস্থায় থাকতে চায়। দুইটি শর্ত পূরণের মাধ্যমে এটি অর্জন সম্ভব তা হল ন্যূনতম পৃষ্ঠতল (Surface Area) ও সর্বোচ্চ আয়তন (Volume) যা শুধুমাত্র গোলক (Sphere) আকারে সম্ভব। এমনটা হওয়ার কারণ হল পদার্থের অভ্যন্তরে অনু-পরমাণুর গতিশক্তির (Kinetic Energy) কারণে বস্তুতে একটি বিশেষ চাপ কাজ করে যেই চাপ বস্তুকে গোলাকার আকার ধারণ করতে ধাবিত করে।
মতান্তরে, গ্রহ সৃষ্টির সময় গ্যাসীয় রূপে অত্যন্ত আনস্টেবল থাকে এবং গ্র্যাভিটি সবসময় সেন্টার অফ পয়েট থেকে কাজ করে তাই গ্রহ গোলাকার আকৃতি ধারণ করে। একারণেই মহাবিশ্বের অনেক কিছুই গোলাকার আকৃতি ধারণ করে। অবশ্য পৃথিবী যদি তার বর্তমান গতির চেয়ে অনেক বেশি গতিতে ঘূর্ণন করত তবে গোলাকার না হয়ে ফ্ল্যাট ডিস্ক হত (গ্যালাক্সির মত)।
সৌরজগতের গ্রহসমূহ ঘূর্ণনশীল কেন?
আমাদের সৌরজগত একটি গ্যাস মেঘ থেকে তৈরি হয়েছিল, যাকে নীহারিকা বলা হয়। মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে ঘুরতে ঘুরতে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা বলেন, সৌরজগতের সবগুলো গ্রহই আদিতে একই দিকে, অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরত। কারণ গ্রহগুলোর উদ্ভব হয়েছিল সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান মহাজাগতিক ধূলিকণা থেকে। এই ধূলিকণাগুলো একটি থালার মতো তলে বিস্তৃত ছিল। পরে কিছু কিছু অংশের ধূলিকণা একত্র হয়ে গ্রহগুলোর উদ্ভব ঘটে। তাই ওগুলো সূর্যের চারপাশে একই দিকে, একই কক্ষতলে ও নিজ নিজ অক্ষরেখার একই দিকে আবর্তিত হতে থাকে।
পৃথিবীতে মোট দুই ধরনের গতি রয়েছে-
১। আহ্নিক গতি
২। বার্ষিক গতি
আহ্নিক গতি: আহ্নিক গতি মূলত একটি ঘূর্ণন গতি। কোন বিন্দু বা অক্ষকে কেন্দ্র করে যদি কোনো বস্তু ঘুরতে থাকে তখন বস্তুটির গতিকে ঘূর্ণন গতি বলা হয়। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে। আর এই উপবৃত্তাকার পথে ঘোরার সময় যে ঘূর্ণন গতি প্রদর্শন করে পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই গতিকে বলা হয়ে থাকে আহ্নিক গতি। আহ্নিক গতি দিনরাত সংগঠন, সমুদ্রস্রোত, জোয়ার-ভাটা ও বায়ু প্রবাহের জন্য দায়ী।
বার্ষিক গতি: সূর্যকে ফোকাস রেখে পৃথিবীর কক্ষপথে উপবৃত্তাকার ভাবে ঘোরার জন্য একটি গতি প্রয়োজন হয়। আর এ গতিকে বলা হয় বার্ষিক গতি। বার্ষিক গতির জন্য দিন রাতের দৈর্ঘ্য বাড়া কমা, ঋতুর পরিবর্তন ঘটে থাকে।
এখন চলুন পূর্বের প্রশ্ন গুলোর উত্তর অনুসন্ধান করি।
পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর একবার ঘুরতে যে সময় নেয় তা আমরা ২৪ ঘন্টা বা ৮৬,৪০০ সেকেন্ড হিসাবে সংজ্ঞায়িত করি। যাইহোক, পৃথিবী পুরোপুরি সমানভাবে ঘোরে না। কালের পরিক্রমায় পৃথিবীর গতি ক্রমশ ধীর হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণন মন্থর হলে দিনের দৈর্ঘ্য গড়ে প্রতি শতকে (১০০ বছরে) প্রায় ১.৮ মিলিসেকেন্ড বেড়ে যায়। এর মানে হল ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে একটি দিন মাত্র ২১ ঘন্টা স্থায়ী ছিল।
এটি চাঁদ ও সূর্যের কারণে সৃষ্ট জোয়ার-ভাটার প্রভাব, পৃথিবীর অভ্যন্তরে কোর-ম্যান্টল কাপলিং, গ্রহে ভরের সামগ্রিক বন্টন, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে।
লিপ ইয়ার, লিপ সেকেন্ড, নেগেটিভ লিপ সেকেন্ড:
পারমাণবিক ঘড়ির অবিশ্বাস্য নির্ভুলতার জন্য 1960 সাল থেকে বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক ঘড়িকে দিনের দৈর্ঘ্য পরিমাপের কাজে ব্যবহার করে আসছেন। আশ্চর্যজনকভাবে একটি কাল্পনিক নিখুঁত ঘড়ির সাথে পারমানবিক ঘড়ির সময়ের ব্যাবধান প্রতি বছরে মাত্র 0.0000001 সেকেন্ড।
সম্প্রতি Newsweek কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টাইমঅ্যান্ডডেট সংস্থার প্রধান গবেষক গ্রাহাম জোনস জানান, ”A new record has been recorded. 2021 is the shortest year. The past year has been approximately 65 milliseconds shorter than average.”
এক্ষেত্রে গ্রহের ঘূর্ণনের সাথে সময়কে সিনক্রোনাইজ করতে লিপ সেকেন্ড, নেগেটিভ লিপ সেকেন্ড ধারণার প্রবর্তন করা হয়। লিপ সেকেন্ডের ধারনার সাথে আমরা পূর্ব পরিচিত না হলেও লিপ ইয়ার ধারণার সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। লিপ ইয়ার– যেখানে আমাদের ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডারগুলি পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সামঞ্জস্য রাখে তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি চার বছরে একটি দিন ফেব্রুয়ারিতে যুক্ত করা হয়।
একইভাবে, লিপ সেকেন্ড, নেগেটিভ লিপ সেকেন্ডের ধারণাকে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োগ করা হয়। আমরা আমাদের ঘড়িতে একটি লিপ সেকেন্ড যোগ করি যাতে সেগুলিকে পৃথিবীর ধীর ঘূর্ণনের সাথে সিনক্রোনাইজ করা যায়। আর উল্টোটি হলে অর্থাৎ পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি বেড়ে গেলে তার সাথে আমাদের ঘড়িগুলোকে সিনক্রোনাইজ করতে নেগেটিভ লিপ সেকেন্ড ধারণাকে কাজে লাগানো হয়।
পৃথিবী গতি পরিবর্তনের কারণ ও তার প্রভাব:
2003 সালে পরিচালিত গবেষণা অনুসারে, পৃথিবী কত দ্রুত বা ধীর গতিতে ঘোরে তার উপর কিছু কারণ প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বা গ্রহনের মতো অনেক কারণের উপর নির্ভর করে, এটি চাঁদের কক্ষপথ এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব, গ্রহের আবহাওয়ার ধরন, মহাসাগরের গতি সাথেও সম্পর্কিত। এমনকি El Niño -এর মতো প্রবল ঝড় গ্রহের ঘূর্ণন কে প্রভাবিত করতে যথেষ্ট শক্তিশালী। এর অর্থ হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন গ্রহের ঘূর্ণন কে প্রভাবিত করতে পারে। New Scientist এর মতে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং দ্রুত ঘূর্ণনের মধ্যে কিছু প্রমাণিত সম্পর্ক রয়েছে। বরফের স্তুপ গলে যাওয়া এবং মহাসাগরের পানির স্তরের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি গ্রহের ভরের বন্টনে পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে।
আমরা সম্ভবত এই বছর পরিবর্তন অনুভব করব না, যদিও কিছু ইন্ডাস্ট্রি এবং সিস্টেম থাকবে যা ছোটখাটো সমস্যার সম্মুখীন হবে । USA Today রিপোর্ট করেছে যে কিছু কম্পিউটার সিস্টেম, বিশেষ করে জিপিএস নেভিগেশন, স্পেস ফ্লাইট, স্যাটেলাইট, স্টক মার্কেট এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ছোট দিনের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হবে। তবে সেখানেও যেখানে প্রভাবটি কোন গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়।
মোঃ গালীব হাসান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ Green Matters, Science Focus, Live Science, Space.Navy