পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ আবিষ্কার ছিলো বিশ্বজুড়ে সয়লাব হয়ে থাকা প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগের দুর্দান্ত বিকল্প। প্রতিবছর কোটি কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ভেসে বেড়ায় আমাদের পরিবেশে, দূষিত করে সমুদ্রও।
এক মিনিটের মধ্যে বিশ্বজুড়ে এক মিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার হয় এবং ইউরোপে এক বছরে ৩.৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের ব্যাগ উৎপাদিত হয় এবং গড়ে ইউরোপবাসী প্রতি বছরে প্রায় ৫০০ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে যা শত বছর সময় নেয় পরিবেশের সাথে মিশতে এবং এটি কেবল পরিবেশ দূষিত করে না, সরাসরি অনেক জীবিত প্রাণীরও ক্ষতি করে।
প্লাস্টিক পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি, যা পরিবেশের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। এর মধ্য থেকে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না, নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট করে ফেলে।
অন্যদিকে পাট হল প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ ফাইবার যা পাট গাছের বাইরের কাণ্ড এবং ত্বক থেকে তৈরি। চকচকে সোনালি রঙ এবং আর্থিক মূল্যের কারণে তা ‘সোনালি ফাইবার’ হিসাবে পরিচিত। পাটের আঁশ সম্পূর্ণরূপে বায়ো-ডিগ্রেডেবল এবং কম্পোস্টেবল আবার এটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। কীটনাশক বা সার ব্যবহার না করে পাট জন্মাতে পারে।
২০০২ সালে সরকার পলিথিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বিকল্প ছাড়া এই প্রয়াস সফল হবে না, বলেছিলেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী মোবারক আহ্মদ খান। বলেই ক্ষান্ত হননি। বিকল্প হিসেবে প্রথমেই আসে স্টার্চের কথা। এটা পাওয়া যায় ভাত, ভাতের মাড়, আলু। এই উপাদান থেকে পচনশীল পলিথিন বা প্লাস্টিক তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু খাবার সংগ্রহ জটিল। আর অনেক দেশেই খাবার থেকে অন্য উপাদান তৈরি নিষিদ্ধ।
২০১৬ সালে পাটের সেলুলোজ ব্যবহার করে তিনি পাটের পলিথিন ব্যাগ “সোনালি ব্যাগ” আবিষ্কার করেছিলেন যা বায়ো-ডিগ্রোয়েবল এবং বায়ো প্লাস্টিক প্রকৃতির, যা প্রচলিত পলি ব্যাগের বিকল্প। পানিতে এর ক্ষতি হবে না, তবে মাটিতে মিশে যাবে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণরোধে চলতে থাকা নানা কর্মসূচীর ক্ষেত্রে যা এক বিশাল মাইলফলক।
ডাঃ মোবারক আহমদ খানের মতে এই পণ্যটি গার্মেন্টস প্যাকেজিং, ফুড প্যাকেজিং, আইসক্রিম কভার, তৈরি পোশাক, চাল, চিনি এবং এমনকি দুধ প্যাকেজিং এর জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। তারা এর মান পরিবর্তন এবং দূষণ পরীক্ষা করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা করেছে কিন্তু কোনও দূষণ বা গুণগত সমস্যা পায়নি। অর্থাৎ ব্যাগটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়।
আবার এই পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগটি ব্যবহারের পর মাটিতে পুতে রাখলে এক থেকে ছয়াসের মধ্যে পঁচে যায়, পরে পরিণত হয় জৈব সারে। পানিতে ফেললে একমাসের মধ্যে পানিতে দ্রবীভূত হয়ে মাছের খাদ্যে রুপান্তরিত হয়ে যায়।
কিন্তু ২০১৬ সালে আবিষ্কৃত হলেও আজ পর্যন্ত নেই এর কোনো ব্যবহার। ব্যাপারটা এমন নয় যে এর উৎপাদন ব্যয়বহুল বা কাঁচামাল দূর্লভ। সোনালী ব্যাগকে পরিবেশবান্ধব বললেও নেই অনুমোদন! বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য অপসারণ ও পূনর্ব্যবহার করতে যা খরচ হয় তার তুলনায় সোনালী ব্যাগের উৎপাদন ব্যয় কমই। কিন্তু তারপরও আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় এত বছরেও শুরু হয়নি এর বাণিজ্যিকিকরণ। দেশীয় ও বিশ্ববাজারে তুমুল চাহিদা থাকা স্বত্বেও এ নিয়ে নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকরী উদ্যোগ।
আবিষ্কারের মতোই সবার চোখের আড়ালে রয়ে গিয়েছেন এই গুণী বিজ্ঞানীও। তিনি ১৭ টি বই এবং একটি পেটেন্টসহ ৬০০ টির বেশি প্রকাশনার লেখক, সহ-লেখক। কাজ করেছেন জার্মানিতে ডিএএডি এবং অ্যাভিএ’র সহকর্মী হিসেবে, জাপানে জেএসএসএস, এমআইএফ এর ফেলো হয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি) এবং অস্ট্রেলিয়ায় আইএইএ এর সহযোগী হিসেবে।
পাটের প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই ছিলো, যেখানেই যেতেন হাতে করে নিয়ে যেতেন একগুচ্ছ পাট। ১৯৯১ সালে পিএইচডি শিক্ষার্থী থাকাকালীন তিনি পাট নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, তার গবেষণার বিষয়ই ছিলো প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাঠ থেকে টেকসই কিছু তৈরি, যা থেকে তিনি পরবর্তীতে পাট নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। যা থেকে গাড়ি, দরজার কাঠামো ও শেষে সর্ববৃহৎ উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোইং এর বিমানের ভেতরকার দেয়াল তৈরির কাজও করছিলেন পাট দিয়ে।
প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে আরও অনেক আবিষ্কার আছে মোবারক আহ্মদ খানের। চিংড়ির খোসা দিয়ে বানিয়েছেন প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ, যা ফরমালিনের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিকের হাত থেকে বাঁচাবে। সামুদ্রিক শেওলা থেকে বানিয়েছেন উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক সার, যাতে চা–গাছের উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে, লালশাকের মতো সবজির উৎপাদন সময় অর্ধেক কমিয়ে এনেছে। গরুর হাড় থেকে তিনি আবিষ্কার করেছেন বিশেষ ধরনের ব্যান্ডেজ, যা পোড়া বা ঘায়ের ক্ষতে ব্যবহার করা যাবে। পাট থেকে তৈরি করেন টিন, রেয়ন।
আমেরিকার সকল সুযোগসুবিধা ছেড়ে নিজের জ্ঞান ও গবেষণাকে দেশের কাজে লাগাতে ২০০১ সালে ফিরে আসেন বাংলাদেশে, এরপর আবিষ্কার করেন সোনালী ব্যাগ, কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সচেতনতার অভাবে না কমছে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার, না উৎপাদিত হচ্ছে এই পরিবেশবান্ধব সোনালী ব্যাগ।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম পাট উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্বজুড়ে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা, আর তাই সুযোগগুলোকে জোরালো করতে বাংলাদেশের প্রয়োজন উদ্ভাবন, উৎপাদন এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক