গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সমস্যা। সময়ের সাথে সাথে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন পরিবেশ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের জন্য একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মুলত মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রায় দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধি বুঝায়, প্রাথমিকভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আগের চেয়ে আরও দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, যাতে বিস্ময়করভাবে পরিষ্কার বাতাস অবদান রাখছে।
সাধারণত কয়লা, তেল, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বায়ুমণ্ডলীয় দূষণের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ হ্রাসের মাধ্যমে পৃথিবীর আকাশ আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে এবং আরও বেশি সূর্যালোক আমাদের কাছে সরাসরি পৌঁছাচ্ছে। যার অর্থ হলো পরিষ্কার আকাশই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধের পরিবর্তে এর বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন জলবায়ু মডেল নিয়ে গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের পৃথিবী পূর্বের তুলনায় কম সূর্যালোক প্রতিফলিত করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্রাবার এবং পরিষ্কার জ্বালানির কারণে আলো-প্রতিফলিত করে এমন দূষণের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। স্ক্রাবার হলো এমন একটি যন্ত্র যা কয়লা পোড়ানোর সময় ধোঁয়ার স্তূপের মধ্য দিয়ে যাওয়া গ্যাসসমূহ পরিষ্কার করে।
গবেষকরা বলেছেন, এসব কারণে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ হ্রাসের সাথে সাথে সূর্যালোক প্রতিফলিত করে এমন আবরণ তৈরি কমে যাচ্ছে ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ বহু বছর ধরেই মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি করে আসছে। প্রধানত কয়লা প্ল্যান্ট থেকে নির্গত সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) দ্বারা সৃষ্ট দূষণ নির্মূল করার অভিযান এর মাধ্যমেই SO2 নির্গমন প্রায় ৯০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং অনেক মানুষ দূষণজনিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অভিশাপ স্বরূপ এই দূষণই সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করে। এই বিষাক্ত ঢাল সৌর বিকিরণকে মহাকাশে বিক্ষিপ্ত এবং প্রতিফলিত করে।
সূর্য প্রচুর পরিমাণে শক্তি পৃথিবীতে প্রেরণ করে এবং এর বেশিরভাগই ইনফ্রারেড তাপ হিসাবে প্রতিফলিত হয় বা দ্রুত পুনরায় নির্গত হয়। দূষণ হ্রাস না পেলে বা গ্রিন হাউজ গ্যাস (GHG) না বাড়লে এই শক্তি মাত্রা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে। কিন্তু বায়ুমণ্ডল যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপ ধরে রাখে বা সূর্যের আলো কিছুটা কম প্রতিফলিত করে, তবে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা অনেক দ্রুত বেড়ে যায়।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণের ফলে সৃষ্ট সূক্ষ্ম কণা অ্যারোসলের উপস্থিতির উপর পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ থাকা নির্ভর করে। কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর সময় কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস।
কার্বন ডাই অক্সাইড বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অবদান রাখে। কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে থাকা ধোঁয়ার মধ্যে অ্যারোসল থাকে, যা সূর্যালোককে মহাকাশে প্রতিফলিত করে, যা গ্রহের উপর উল্লেখযোগ্য শীতল প্রভাব ফেলে। দূষণের মাত্রা হ্রাস পাওয়ায় এই শীতল প্রভাব ব্যাহত হয়েছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী পাওলো আর্টাক্সোর বলেছেন, অ্যারোসল গ্রহের তাপমাত্রার এক- তৃতীয়াংশ প্রতিরোধ করতে পারে। সালফার ডাই অক্সাইডের বিষাক্ত ঢালও সৌর বিকিরণকে মহাকাশে বিক্ষিপ্ত এবং প্রতিফলিত করে। সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাসের ফলে সূর্যালোক শোষণ এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
২০২০ সালে জাতিসংঘের শিপিং কর্তৃপক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) দ্বারা প্রবর্তিত জাহাজ থেকে নির্গমন হওয়া ধোঁয়া পরিশোধন করার জন্য নতুন নিয়মকানুনগুলো দূষণ মাত্রার ব্যাপক হ্রাস ঘটিয়েছে।
তাছাড়া গাড়ি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিভিন্ন শিল্প কারখানা থেকে ধোঁয়া নির্গমন কমানো, নির্গত ধোঁয়া পরিশোধিত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অনেকাংশে হ্রাস করেছে। জাহাজের জ্বালানি থেকে নির্গত সালফার কণাগুলোর মেঘ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে এবং ২০২০ সালের পর দূষণ হ্রাসের ফলে সূর্যালোক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশাল মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা তখন থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরের বৃহত্তর বিস্তৃতি গুলোতে এখন অতীতের তুলনায় বেশি সূর্যালোক শোষিত হচ্ছে, যা পূর্বের প্রত্যাশার বাইরে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করছে।
যদিও দূষণমাত্রা হ্রাস পরিষ্কার ও উজ্জ্বল আকাশের একমাত্র কারণ নাও হতে পারে। জলবায়ু মডেলগুলো অতিরিক্ত শোষিত আলোর ৪০% পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে অক্ষম ছিল এবং সিইআরইএস (Clouds and the Earth’s Radiant Energy System- CERES) এর তথ্য অনুযায়ী উত্তর ও দক্ষিণ উভয় গোলার্ধে প্রতিফলন হ্রাস পেয়েছে, যেখানে দূষণ উত্তরে সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ ইঙ্গিত করে যে, অন্যান্য আরও কারণ আছে যা পৃথিবীর প্রতিফলন ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।
পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরিবেশ দূষণের মাত্রা হ্রাস মানবজাতির জন্য আরেকটি মারাত্মক ঘটনা, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা বন্ধ করা উচিত কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এমন পরামর্শ দেন না যে বিশ্বকে বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত, কারণ এটি মানবজাতির জন্য একটি স্পষ্ট হুমকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বছরে প্রায় ৭০ লক্ষ অকাল মৃত্যুর কারণ হয় মারাত্মক বায়ু দূষণ। এর পরিবর্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী মিথেন গ্যাসের মতো গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন কমানোতে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
তাফহীমা ফেরদৌস / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সাইন্স, ইউরো নিউজ, ইন্টেলি নিউজ