আমি যেভাবে দেখি আপনি কি সেভাবে দেখেন?
মানবদেহ বেশ রহস্যময়। যুগ যুগ ধরেই আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো কে নিয়ে বিস্তর আলোচনা গবেষণা হয়ে আসছে। বহু বিষয় নিয়ে এখনো গবেষণার সমাপ্তি টানতে পারেনি মানুষ নিজেই। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমরা। আর আমাদের এই মস্তিষ্ক ই তৈরি করলো পৃথিবীর সকল অবিশ্বাস্য আবিষ্কার। তারপরও আমাদের প্রত্যেকটি অঙ্গ নিয়ে শত শত বৎসর ধরে চলতে থাকা চুলচেরা বিশ্লেষণের কোনো ফলাফল আমরা এখনো পাইনি।
এতসব গবেষণার সুবাদেই সম্প্রতি হংকং এর গবেষকদের তৈরি করা কৃত্রিম চোখ বেশ সরগরম করে দিচ্ছে প্রযুক্তি বাজারকে। বহু আঙ্গিকে এটা বোঝানো হচ্ছে যে এই কৃত্রিম চোখ মানব চক্ষু অপেক্ষা বেশ ভালো ফলাফল দেবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। চলুন, আমাদের চোখ সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
চোখ আমাদের বাকি সকল অঙ্গ থেকে ভিন্ন। চোখ প্রাণীর আলোক-সংবেদনশীল অঙ্গ ও দর্শনেন্দ্রীয়। আমাদের চোখ শুধুমাত্র আলোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির পার্থক্য করতে পারে। যখন কোনো বস্তু হতে আলো আমাদের চোখে এসে পড়ে, তখন সেই সমান্তরাল আলোক রশ্মি চোখের কর্ণিয়ার ভিতর দিয়ে যেয়ে চোখের লেন্স অতিক্রম করার সময় বিভিন্ন কোণে আপতিত হয় এবং বেঁকে গিয়ে বিভিন্ন দিকে চলে যায়।
লেন্সের মধ্য দিয়ে এই বেঁকে যাওয়া আলোক রশ্মি আবার চোখের রেটিনার একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে একত্রিত হয়ে বস্তুটির একটি উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে। এখানে একটি বিষয় ভালো করে মনে রাখতে হবে, তা হলো, কোনো বস্তু হতে যদি আলো না এসে আমাদের চোখে না পড়ে তাহলে কিন্তু আমরা দেখতে পাব না, আর এই কারণেই আমরা অন্ধকারে একদম দেখতে পাই না।
রেটিনায় দুটি সংবেদী কোষ আছে- রড এবং কোণ। রেটিনার কোণ কোষ রঙ বুঝতে সাহায্য করে আর রডস্ কম আলোতে দেখতে সাহায্য করে। এই রড এবং কোণ কোষ আলোর ফোটনকে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে পরিণত করে, এরপর তা অপটিক নার্ভের মধ্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। মস্তিষ্কে এই ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যাল ইন্টারপ্রিটেড হয়ে উল্টো ইমেজ হয়ে যায় এবং সেটাই আমরা দেখি। আর এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দ্রুত ঘটে, যা আমরা বুঝতেই পারি না।
কৃত্রিম চোখ নিয়ে হংকং-এ যে প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে তা সম্পর্কে দাবী করা হয়েছে, এই চোখটি মানব চক্ষুর বিকল্প। এর গঠনও অনেকটা মানব চক্ষুর মতোই। এর হেমিস্ফেরিকাল রেটিনায় আছে আলোক সংবেদনশীল কিছু ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্রতর তার বা ন্যানোওয়্যার, যা সৌরকোষের একটি অপরিহার্য উপাদান পেরোভসকিট থেকে তৈরি। এটি মূলত মানবচক্ষুর ফটোরিসিপ্টর বা আলোকগ্রাহীর মতো কাজ করে।
মানবচক্ষুতে প্রতি বর্গ সে.মি তে ১ কোটি আলোকগ্রাহী কোষ থাকে। রেটিনার গম্বুজের ন্যায় আকৃতি মানবচক্ষুকে বেশ প্রশস্ত দর্শনের সু্যোগ করে দেয়। এটি প্রকটভাবে আলোক সংবেদনশীল।
হংকং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর লেইলিই গু এবং তাঁর সহকর্মীদের মতে, পুনর্নির্মাণ হিসেবে এই সিনথেটিক চোখ বেশ সাড়া জাগানিয়া হলেও এর বেশকিছু চ্যালেঞ্জ এখনো সমাধান করা বাকি। রেটিনার প্রকৃত আকার ও গঠন কৃত্রিম রূপ দেওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু তাদের কাছে আবার এর উত্তর আছে বলেও তারা উল্লেখ করেছে। “Nature” নামক পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে এই যন্ত্রটি রেস্পন্স করছে এটি তিনটি বর্ণের পুনর্নির্মিত প্রতিমূর্তি দেখতে পায়। তা হল, E,I,Y.
মূলত এর রেজুলেশন এখনো তাঁর শ্রেষ্ঠ পর্যায়ে পৌছাতে পারেনি। কারণ, যে তিনটি ন্যানো সাইজের তার ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো দিয়ে কেবল ১০০ মেগাপিক্সেল ধারণ করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু এটিও সত্য, উক্ত নকশা এতোটাই সম্ভাবনাময় যে এটি মানবচক্ষুর থেকেও বেশি রেজুলেশন ধারণ করতে পারার সম্ভাবনা রাখে। গবেষকদের মতে, উক্ত তার গুলোর ঘনত্ব মানবচক্ষুর আলোকগ্রাহী কোষগুলোর তুলনায় ১০ গুণ বৃদ্ধি করা যাবে। তবে এটিও সত্য, যেকোনো রোবটেই এই চোখ বেশি মানাবে।
“বিশেষভাবে Humanoid Robot গুলোর চোখ মানুষের অনুরূপ হওয়া উচিৎ যার মাধ্যমে মানুষ এবং রোবটের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। তার পাশাপাশি উক্ত রোবটের মধ্যে থাকবে উচ্চতর যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য”, এমন মন্তব্য প্রকাশ করেন উক্ত প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্কলার এবং বিজ্ঞানী।
উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হংগ্রুই জিয়াং বলেন, “Madison,US এ উক্ত বিষয়কে বেশ আগ্রহী এবং বেশ সম্ভাবনাময় বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কিন্তু আরো বেশকিছু বিষয়ে আলোকপাত করা উচিৎ। উল্লেখযোগ্য ভাবে যদি বলা প্রয়োজন হয় তবে তারগুলোর আকৃতি নিয়ে বলা যায়। তার গুলোর আকার আর ছোট হওয়া প্রয়োজন এবং উক্ত কৃত্রিম রেটিনার কার্যকর ক্ষমতা এবং সময়কাল দাঁড় করানো প্রয়োজন।”
বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে আগামী দশ বছরের মধ্যেই হয়তো চোখের সামনেই একটি কৃত্রিম চোখকেই দেখবেন আপনার চোখের তুলনায় ভালো সার্ভিস দিচ্ছে। আর এই প্রযুক্তি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য হয়ে উঠবে আশীর্বাদ।
ফাহাদ বিন এনাম/ নিজস্ব প্রতিবেদক